#আমাকে_ঘুড়ি_ভেবে_ওড়াস_না ।।১৭।।

0
250

#আমাকে_ঘুড়ি_ভেবে_ওড়াস_না
।।১৭।।
লাঞ্চ আওয়ারের ঠিক আগে আগে মেইলটা এসে ঢুকল সবার মেইলে। জার্মানে তিন মাসের অফিশিয়াল ট্রেনিং এর জন্য অফিস থেকে তিনজনকে সিলেক্ট করা হয়েছে। এই তিনজনের মধ্যে উদয়ের নাম আছে।
এত বড়ো একটা খবর। প্রথমেই বাসায় ফোন করে জানানো উচিত।
অথচ উদয় প্রথম ফোনটা করল জিনিয়াকে। অবশ্য ওর নাম্বারটা কল লিস্টে ওপরেই ছিল।
এটাও একটা কারণ হতে পারে। একটা রিং বাজতেই ফোন ধরল জিনিয়া।
“হ্যালো!”
“হ্যালো জিনি! আমার একটা সুখবর আছে।“
“প্রমোশন হয়েছে নাকি?”
“অফিস থেকে তিনজনকে তিন মাসের ট্রেনিং এর জন্য জার্মানিতে পাঠাচ্ছে। তিনজনের মধ্যে আমি একজন।“
“ওয়াও, কংগ্র্যাচুলেশন্স! পার্টি হবে না?”
“হবে তো! জিনি, সব তোর জন্যই হলো!”
তিন মাস! আচমকাই একটু মন খারাপ হতে শুরু করল জিনিয়ার।
“কবে যাওয়ার ডেট?”
“আগামী মাসে। এখনো শিডিউল দেয়নি।“
“ওকে, জানাইস তাহলে!”
ফোন রেখে সামনে তাকাল উদয়। সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আফসানা।
আফসানা অন্য দিকে তাকিয়ে বলল, “কংগ্র্যাচুলেশন্স!”
“থ্যাঙ্ক ইউ!”
“স্যরি, আমি যা করছি ঠিক করি নাই!”
“শুনে ভালো লাগল। কী জানো, ভালোবাসায় বন্ধুত্ব ব্যাপারটা খুব বেশি জরুরি। তুমি যাকে ভালোবাসো তার ক্ষতি করার চিন্তা কর কীভাবে? আর কাউকে কি আটকে রাখা যায়?”
“না। যায় না।“
“তুমি ভালো থেকো আফসানা। নো হার্ড ফিলিংস।“
আফসানা অল্প হাসল।
জেসমিন বললেন, “শুনছিস, উদয় নাকি জার্মানি চলে যাচ্ছে তিন মাসের জন্য?”
সন্ধ্যায় ক্লাসের ল্যাব শিটগুলো গুছিয়ে রাখছিল জিনিয়া। গোছাতে গোছাতেই বলল, “হ্যাঁ, শুনলাম।“
“আমি কল করলাম ভাবীকে, এনগেজমেন্ট করিয়ে রাখব কিনা জিজ্ঞেস করতে। উনি বলল উনারা নাকি এখনই সে রকম কিছু ভাবছে না।“
“হ্যাঁ, সেটাও জানি!”
“তোদের ব্যাপারটা কী বল তো আসলে? সেদিন আমাদের বাসায় আসবার আগে পর্যন্ত তো ভাবীকে খুব ইন্টারেস্টেড মনে হচ্ছিল। এখন কেমন জানি গা ছাড়া মনে হচ্ছে! তোদের কি ঝগড়া টগড়া হইছে নাকি?”
জিনিয়া শিট গোছানো বন্ধ করে বলল, “কারণ আমাদের মধ্যে আসলে সেরকম কিছু নাই! উদয় আন্টিকে বোঝাতে পারছে মনে হয়, তাই আন্টিকে গা ছাড়া মনে হচ্ছে!”
“তাহলে সেদিন বাসা থেকে বের হয়ে গেলি কেন?”
“সেদিন একটা ভুল হতে যাচ্ছিল আম্মু! একটা ভুল যেটা থেকে উদয় আমাকে সেভ করছে, এজ এ ফ্রেণ্ড! ফ্রেণ্ডরা ফ্রেণ্ডদের জন্য করেই, যেমনটা আমি করছি ওর প্রেজেন্টেশনে হেল্প করে!”
জেসমিন বিড়বিড় করে বললেন, “কিছু বুঝলাম না! তোদের কি দুজনের দুজনকে এখন আর পছন্দ হচ্ছে না?”
“পছন্দ হবে না কেন? ও তো অপছন্দ করবার মতো মানুষই না!”
জেসমিন নরম গলায় বললেন, “দেখ বিয়ে তো করতেই হবে, কখনো না কখনো! আমি তো বিয়ের আগে তোর আব্বুকে দেখিও নাই ভালো করে! আর এক সাথে থাকতে থাকতে, চলতে চলতে, মিশতে মিশতে সেই ফিলিংস চলেও আসবে, যেটা এখন মিসিং মনে হচ্ছে!”
“তা অবশ্য ঠিক। আর অচেনা কাউকে বিয়ে করবার চাইতে চেনা বন্ধুকেই বিয়ে করা ভালো অপশন।“
“তাহলে কী করব আমরা? তোর আব্বুও তো অসুস্থ!”
জিনিয়া হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, “দেখো ওর সাথে কথা বলে দেখো! যেটা ভালো মনে কর!”
আশিকের চলে যাওয়ার কথা শুনে তুলকালাম করলেন জেসমিন।
“চলে যাবা? এখন চলে যাবা মানে? বলা নাই কওয়া নাই হুট করে বললেই হলো চলে যাবো?”
“আমার এক তারিখ থেকে জয়েনিং, এখান থেকে অফিস করতে অসুবিধা হবে!”
“নিমকহারাম আর কাকে বলে!”
“আমি জিনিয়ার বিয়ের সময় এসে সব কাজ করে দিয়ে যাব!”
“কোনো দরকার নাই! জিনিয়ার বিয়ের সময় কেন, তোমার মামা মরলেও তোমার আসার দরকার নাই!”
জিনিয়া মৃদু স্বরে বলল, “আহা আম্মু, এভাবে বকতেছ কেন? মানুষের সুবিধা অসুবিধা থাকে না?”
“থাকে! স্বার্থপর মানুষ নিজের সুবিধাটাই সবার আগে দেখে!”
“তাহলে তো তুমিও কম স্বার্থপর না, আম্মু! একটা গ্র্যাজুয়েট ছেলেকে তুমি ড্রাইভারের চাকরি দিয়ে আটকায়ে রাখতেছ কোন যুক্তিতে?”
“তুই ওর উকিল হইছিস কবে থেকে?”
“আমি উকিল হই নাই কারো! যুক্তির কথা বললাম। বেটার অপশন পেলে সব মানুষই চলে যাবে, এটাই স্বাভাবিক।“
আশিক বলল, “আমি তো এখনই যাব না মামি! কয়েক দিন পর যাচ্ছি!”
“কয়েকদিন পর কেন? বের হয়ে যাও! চলে যাও এই মুহূর্তে!”
জেসমিন রণচণ্ডী মূর্তিতে আশিকের ঘরে ঢুকে সব ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতে শুরু করলেন।
“আম্মু তুমি কী করতেছ এই সব?”
কোনো প্রতিবাদ করল না আশিক। তার জিনিসপত্র গোছানোই ছিল প্রায় সব।
“এই ভাইয়া আপনি রাখেন তো! কই যাচ্ছেন?”
“চিন্তা করো না, মেসে আমার সিট নেওয়া আছে!”
চলে যাওয়াটা হয়ত আরেকটু সুন্দরভাবে হতে পারত, সেটা হওয়াই উচিত ছিল। কিন্তু হলো না।
বাসা থেকে বেরিয়ে এসে শেষ বারের মতো পেছনে তাকিয়ে দেখল আশিক। এতগুলো বছরের স্মৃতি তো সহজেই মুছে ফেলা যাবে না।
মুন্নি এসে দাঁড়িয়ে রইল দরজা ধরে। খুব বেশি টাকা ছিল না আশিকের পকেটে।
তাও দুশো টাকা বের করে মুন্নির হাতে দিয়ে বলল, “ভাবছিলাম বেতন পাওয়ার পর কিছু কিনে দিব তোমাকে! কিন্তু যদি আসতে না পারি, তাই দিয়ে গেলাম! তুমি কিছু একটা কিনে নিও!”
কেঁদে ফেলল মুন্নি।
“কী হলো, নাও, ধর!”
মুন্নি নিল না টাকাটা। কাঁদতে কাঁদতে ছুটে চলে গেল বাসার ভেতরে।
সেদিন রাতে ঘুম আসছিল না জিনিয়ার। একটা মানুষ এতগুলো দিন ধরে থাকল, সাধ্য মতো সব কিছু করল।
তার এভাবে চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছে না সে। গভীর রাতে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আশিকের ঘরে এসে ঢুকল জিনিয়া।
কিছুই নেই। শুধু আলনায় পড়ে আছে একটা জরাজীর্ণ লাল গামছা।
শূন্য ঘরের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ঠেলে বেরিয়ে এলো জিনিয়ার বুক চিরে। আচমকাই চোখ চলে গেল টেবিলের নিচে।
সেখানে পড়ে আছে একটা ডায়েরি। কী লিখত আশিক ভাইয়া ডায়েরিতে, সেটা জানবার কৌতূহল হলো তার।
ডায়েরিটা খুলে অবশ্য তেমন কিছুই পেল না সে। এটাতে বোধ হয় ক্লাস নোট তোলা হতো।
টুকিটাকি হিসাব লিখবার কাজেও ব্যবহার করা হয়েছে। হয়ত জিনিসপত্র ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার সময় কোনো ভাবে নিচে পড়ে গেছে ডায়েরিটা।
ডায়েরিটা বন্ধ করে রেখে দিতে গিয়েও শেষ পাতায় এসে থমকে গেল জিনিয়া। শেষ পাতা জুড়ে বিভিন্ন রঙের কালিতে শুধু তার নাম লেখা।
পাতা জুড়ে লেখা- “জিনিয়া, জিনিয়া, জিনিয়া, জিনিয়া…”
হয়ত কলম চালু করতে কিংবা প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া কলমে আর কালি আছে কিনা সেটা পরীক্ষা করে দেখতেই তার নাম এতবার লেখা হয়েছে। কিন্তু অন্য কিছু না লিখে তার নামটাই লিখবার প্রয়োজন পড়ল কেন সেটাও একটা প্রশ্ন।
এনগেজমেন্টের তারিখ ঠিক করা হলো উদয় চলে যাওয়ার আগে আগে। ক্যাম্পাসে সবাইকে দাওয়াত দেওয়ার সময় দেখা হলো রাইসার সাথেও।
“তুই না বলছিলি তোদের মধ্যে কিছু নাই?” জিজ্ঞেস করল রাইসা।
“কিছু তো নাইই! কিন্তু কাউকে না কাউকে তো বিয়ে করতেই হবে, কখনো না কখনো! সো হোয়াই নট উদয়?”
“ও! তোকে একটা কথা বলব, যদি কিছু মনে না করিস!”
উদয়কে অফিস থেকে জার্মানিতে ট্রেনিং এর জন্য সিলেক্ট করেছে।“
“ও! “কী কথা?”
“তোর ড্রাইভার মানে তোর কাজিন, তোর খোঁজ নিতে এসেছিল।“
“আশিক ভাইয়ের কথা বলছিস?”
“হ্যাঁ, আমার ধারণা উনি তোকে পছন্দ করেন।“
“তোকে বলল সেটা?”
“আমাকে বলেনি। হাবভাবে বুঝলাম।“
মাথা নাড়ল জিনিয়া। অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলে যাচ্ছে এখন।
(পরের পর্ব ইদের দিন ইন শা আল্লাহ্‌)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here