#আমাকে_ঘুড়ি_ভেবে_ওড়াস_না ।।১৬।।

0
161

#আমাকে_ঘুড়ি_ভেবে_ওড়াস_না
।।১৬।।
রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসার সময় উদয় চেয়ার টেনে দিলো জিনিয়ার জন্য, বসতে বসতে কেমন অন্য রকম অনুভূতি হলো জিনিয়ার। নিজেকে কেমন বিশেষ মনে হতে লাগল।
সামনে বসে একবার হাই তুলল উদয়।
“খুব টায়ার্ড লাগছে না রে?” সহানুভূতির সাথে বলল জিনিয়া।
“হ্যাঁ, একটু তো লাগেই! কাল রাতে ঘুম হয়নি তো! কেন তোর লাগছে না?”
“হ্যাঁ, আমি তো লাইব্রেরিতে টেবিলে মাথা দিয়ে ঘুমাইছি আধা ঘন্টা!”
“আহা, তাহলে পরে কোনো একদিন বের হতাম? আজকে রেস্ট নিতি তাহলে!”
“তুই তো আজকেই আসতে চাইলি!”
“হ্যাঁ, অফিসে একটা প্রবলেম হচ্ছে। শেয়ার করার কেউ নাই তো। তোর সাথে শেয়ার করতে চাইছিলাম।“
“কী প্রবলেম?”
“আমার কলিগ আফসানা, তোকে আগের দিন বললাম না যে আমার প্রেজেন্টেশন, ডাটা শিট সবকিছু ডিলিট করে দিছিল?”
“হ্যাঁ বলছিস কিন্তু কারণটা বুঝি নাই আমি!”
“আসলে ওর সাথে আমার একটা রিলেশন চলছিল!“
ঠোঁট গোল করে শিস দিলো জিনিয়া। “তাই নাকি মামা?”
“কেন চলতে পারে না? বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী বিয়ের বয়স হইছে না আমার?”
হাসতে লাগল জিনিয়া। “হ্যাঁ তা তো হইছেই। তো এখন ওর প্রবলেমটা কী, আমি?”
“হ্যাঁ তুই। সেদিন হসপিটালে এসে তোকে দেখার পর আর আন্টির কথা শোনার পর অসম্ভব জেলাস হয়ে গেছে সে। কিছুতেই কোনো কথা শুনতে রাজি হচ্ছিল না। আর গতকাল রাতে তোর বাসায় ছিলাম শোনার পরে রীতিমত ফায়ার হয়ে গেছে সে। থ্রেট দিয়ে গেছে খবর করে ফেলবে আমার!”
“কী করতে পারবে সে তোর?”
“সেটাই ভাবতেছি!”
“খুব সাবধান থাকতে হবে এখন থেকে তোর!”
“হু!” বলতে গিয়ে আচমকাই খেপে উঠল উদয়, “তুই আসার পর থেকে শুরু হইছে এই সব যন্ত্রণা!”
কথাটা সত্যি, তাই কোনো প্রতিবাদ না করে অপরাধী মুখ করে চুপচাপ বসে রইল জিনিয়া। “স্যরি!”
“থাক, আর স্যরি বলতে হবে না! কী করা যায় সেই রকম কোনো বুদ্ধি থাকলে দিতে পারিস!”
জিনিয়া কিছু ক্ষণ চিন্তা করে বলল, “অন্য ডিপার্টমেন্টে শিফট করা যায় না?”
“হ্যাঁ এই বুদ্ধিটা অবশ্য খারাপ দিস নাই! একটু চিন্তা করে দেখা যায়।“
কফির কাপে চুমুক দিয়ে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বাইরে তাকাল জিনিয়া। বাইরে রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামে স্থবির হয়ে আছে সব।
তারা এখানে এসে বসার পর টিপ টিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে বিনা নোটিশে। অসময়ের বৃষ্টিতে নগরবাসী সবার গতিবিধিতে বিরক্তির ছাপ।
বেশিরভাগ রিকশায় পর্দা ঘেরা, থেমে থাকা যানবাহনগুলোর ফাঁক দিয়ে বৃষ্টির ছাট থেকে বাঁচতে দ্রুত পায়ে হেঁটে রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছে ঘরমুখী মানুষ। কারো হাতে অফিসের ব্যাগ, এক মায়ের হাত ধরে রাস্তা পার হচ্ছে স্কুল ব্যাগ কাঁধে একটা বাচ্চা।
ও পাশে নিচে এক বাসার কার্নিশের নিচে গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে আছে একটা কাক, পালকগুলো ফুলে আছে বৃষ্টির পানি লেগে।
“আচ্ছা অফিসের ঝামেলা নাহয় গেল, বাসায় কী বলব, কিছু ঠিক করলি?”
জোর করে নিজেকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনল জিনিয়া। বাইরে থেকে চোখ ফিরিয়ে এনে বলল, “কী ব্যাপারে?”
“আমাদের বিয়ে!”
“আপাতত কিছুই বলব না আমরা। সময় চাইব। আমি আমার পড়া শেষ হওয়ার কথা বলব। আর তুই বলবি জবে আরেকটু সেটল হওয়ার কথা। অফিসে কোনো ব্যস্ততার কথা বলবি।“
খাওয়া শেষ, শূন্য কফির কাপ টেবিলে নামিয়ে রেখে উদয় বলল, “বৃষ্টি পড়ছে, বাসায় যাব কীভাবে?”
“নামিয়ে দিচ্ছি আমি, গাড়ি আছে তো সাথে!”
“জ্যামে যে বসে থাকা লাগবে কতক্ষণ…”
কাঁধ ঝাঁকাল জিনিয়া, “স্যরি ইয়ার, ওইটা তো আর আমার হাতে নাই!”
বের হতে হতে একটা স্যাণ্ডউইচ পার্সেল নিয়ে নিল জিনিয়া, গাড়িতে উঠে আশিকের দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, “আশিক ভাই এটা আপনার জন্য!”
যন্ত্র চালিতের মতো হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নিল আশিক, পাশের সিটে রেখে দিয়ে নিষ্প্রাণ গলায় বলল, “থ্যাংকস!”
“সুন্দর একটা গান চালান তো, যে জ্যাম, যেতে অনেকক্ষণ লাগবে! গান ছাড়া সময় কাটবে না।“
গান চালিয়ে দিলো আশিক,
লেট মি টেইক ইউ ফার এওয়ে
ইউ উড লাইক আ হলিডে…
গান শুনতে শুনতে বাইরে আকাশের দিকে চোখ ফেরাল জিনিয়া। অনেক দিন পর সুন্দর একটা সন্ধ্যা কাটল ওর।
আম্মু আব্বু তো কোথাও যেতেই দেয় না ওকে।
ছোট বেলাতেই ভালো ছিল। নিকেতনে ওরা যেখানে থাকত, আশেপাশে সবাই পরিচিত ছিল।
বিকেলে নিচে নামতে পারত, ছাদে উঠতে পারত। যতই বড়ো হয়েছে ততই বেড়েছে পাহারা।
কাঁচ ভেদ করে বাইরে দেখা যাচ্ছে আকাশ জুড়ে রঙের ছড়াছড়ি। কোনো খেয়ালি শিল্পী যেন ছবি আঁকবার ফাঁকে ফাঁকে তুলি মুছবার কাপড় হিসেবে ব্যবহার করেছে আকাশটাকে।
আকাশ থেকে চোখ ফিরিয়ে এনে উদয়ের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে গিয়ে দেখল, সিটে অদ্ভুত বাঁকাভাবে মাথা রেখে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে উদয়। আহারে, এতটাই ক্লান্ত ছিল তাহলে কী প্রয়োজন ছিল আজকে আসবার?
আর কীভাবে ঘুমিয়েছে পাগলটা, ঘাড় ব্যথা করবে তো! উদয়ের যেন ঘুম না ভাঙে এমনভাবে খুব সন্তর্পণে ধীরে ধীরে আলতো করে মাথাটা ঠিক করে দিলো জিনিয়া।
সামনের লুকিং গ্লাস দিয়ে দৃশ্যটা চোখ এড়াল না আশিকের। একটা দীর্ঘ শ্বাস সযত্নে গোপন করে গেল সে।
——————————————————————————————————————————
একটা একটা করে জিনিস গুছিয়ে বড়ো ব্যাগটায় ভরছে আশিক। এ জায়গার পাট ওঠাতে হবে আস্তে আস্তে।
এক তারিখ থেকে জয়েনিং। অফিসের কাছেই একটা মেস ঠিক করে এসেছে সে।
এ বাসা থেকে যত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া যায় ততই ভালো। দরজায় টোকা পড়ছে।
দরজা খুলে রুক্ষ স্বরে বলল আশিক, “কী চাও?”
মুন্নি ভেতরে ঢুকে চতুর্দিকে ছড়ানো আশিকের জিনিসপত্র দেখে বলল, “চইলা যাইতাছেন?”
“কী বলতে আসছ বলে চলে যাও!”
“কিছু না। দেখলাম যে বড়ো ব্যাগ আনছেন একটা, তাই জিগাইতে আইছিলাম বড়ো ব্যাগ দিয়া কী করবেন! অহন তো দেখলামই নিজের চোখে!”
“আচ্ছা। দেখছ তো। দেখা হইছে না? দেখা শেষ হলে এখন বিদায় হও।“
মুন্নি আহত গলায় বলল, “আফনে সব সময় আমার সাথে এমন করেন ক্যান?”
আশিক গলা নামিয়ে বলল, “মনটা ভালো নাই মুন্নি! কিছু মনে করো না। কথা বলতে ভালো লাগছে না।“
“মন ভালা থাকব কেমনে? ছোট আফার যে রঙ ঢঙ! ওই দিন ঘরে গিয়া দেখি দুইজনে নিচে বইয়া হাসাহাসি করতেছে!”
আশিক একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মুন্নির দিকে চোখ তুলে তাকাল। মুন্নি অপরাধী গলায় বলল, “যাইতেছি ভাইজান! রাইতে তো খাইলেন না ঠিক মত, এক গ্লাস দুধ আইনা দেই?’
“না দুধ খাব না মুন্নি, সন্ধ্যায় হাবিজাবি খেয়েছি। খিদে নাই এখন।“
মুন্নি চলে গেলে বিছানার সাথে হেলান দিয়ে মাটিতে বসল আশিক। মুন্নি বলার আগেই সে জানে।
সেদিন যদিও জিনিয়া তার সিক্রেট ঘটনা বলেছিল আশিককে, উদয় যে আসলে তার ছোট বেলার ফ্রেণ্ড, তাদের মধ্যে অন্য রকম কিছুই নেই এটাও বলেছিল, কিন্তু কিছু না থাকলেও হতে আসলে বেশি সময় লাগে না। আজ সন্ধ্যায় এক সাথে খেতে গিয়েছিল ওরা দুজন, গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিল আশিকই।
সম্পর্ক দানা বাঁধছে ধীরে ধীরে, ওদের দুজনের গল্প করার অনেক কমন বিষয় আছে। ছোট বেলার অনেক মিষ্টি মধুর স্মৃতিতে ওরা এক সাথে হাসতে পারে, প্রাণ খুলে।
বিপরীত দিকে ভাবতে গেলে, আশিকের ছোট বেলা কেটেছে কষ্ট আর যন্ত্রণায়। উদয়ের পরিবারটাও গোছানো।
আশিক কে? সবে মাত্রই একটা চাকরি পেয়েছে, তাছাড়া বিয়ে করে জিনিয়াকে নিয়ে তুলবে কোথায়? উদয়ের তো তাও যা হোক একটা ঘর আছে, একটা সুন্দর পরিবার আছে। অন্যদিকে জিনিয়ার পরিবারের অনুগ্রহের ওপরে নির্ভর করে চলেছে আশিকের গোটা পরিবার।
এখানে থাকতে পারবে না আশিক। চলে যাবে, সরে যাবে চোখের আড়ালে, তারপর জিনিয়ার যা ইচ্ছে হয় করুক, কে দেখতে যাচ্ছে?
তবুও, কষ্ট তো হয় একটু হলেও। জিনিয়ার হাসি, হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলবার ভঙ্গি সবই ঘোরাফেরা করে বেড়ায় চোখের সামনে।
এ জায়গা যত তাড়াতাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া যায় ততই সবার জন্য মঙ্গল।
(রমজানে রাইনার স্কুল, নিজের ডিউটি সব মিলিয়ে পর্বগুলো আসতে দেরি হচ্ছে, সেজন্য দুঃখ প্রকাশ করছি।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here