#কখনো_মেঘ_কখনো_বৃষ্টি
#পর্ব_৩
আশিক ভেতরে ভেতরে আতংকে অস্থির হয়ে যায়। লারা অবশ্য পূর্ণার মানসিক অস্থিরতার ব্যাপারে কিছুই জানে না। তাই স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলতে থাকে। আশিক লারাকে তাড়া দেয়,
“লারা, তোর ফাইলটা আমি দেখে রাখবো। আর লামিয়া মামনীর স্কুলের ব্যাপারেও খোঁজ নেব। তোর দেরি হচ্ছে না? চাইলে উঠতে পারিস।
পূর্ণা বাঁধা দিয়ে বলে,
“লারা আপুর দেরি হলে আপুই উঠবেন। এতক্ষণ গল্প করছিলে তখন দেরি হচ্ছিল না। আর আমি আসতেই আপুকে ভাগিয়ে দিচ্ছ কেন বলতো?
“আরে না পূর্ণা,আমি মাত্রই আসলাম। আর আসলেই উঠবো। মেয়েটার স্কুলের ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে হবে।”
তারপর আশিকের দিকে ফিরে বলে,
“Thanks a lot দোস্ত। এখানে আসার পর থেকে তোর কাছে যতটা সাহায্য পেয়েছি, নিজের আত্মীয় স্বজন হলেও এতটা করতো না। আর হ্যাঁ বাসাটা কিন্তু খুব ভালো হয়েছে। লামিয়ার খুব পছন্দ হয়েছে। পূর্ণা তুমি খুবই লাকি মাশাল্লাহ। ”
আশিক ফ্যাকাসে মুখে মাথা নাড়ে। আজ না জানি পূর্ণা কী সিনক্রিয়েট করে!
“জ্বি আপু, আমি আসলেই লাকি। আমার স্বামীকে সবাই এত পছন্দ করে। বিশেষ করে তার নারী ভক্তের শেষ নাই।”
“হা হা! কন্যা রাশির ছেলেদের মনে হয় নারী ভক্ত বেশি থাকে। তবে ভার্সিটিতে কিন্তু ওকে এমন ছুপা রুস্তম মনে হয়নি। শান্ত শিষ্ট ছেলে ছিল। এখন তো দেখি এই কর্পোরেট কোম্পানিতে সে চটপটে তরুণ কর্মকর্তাদের একজন।”
“আমারও ওর চরিত্রের এই দিক অজানা ছিল আপু। আমিও জানতাম ও সহজ সরল একজন। এখন দেখি একই অঙ্গে কত রূপ।”
“মানে?”
“দুষ্টুমি করলাম আপু। বাসা নিয়েছেন নাকি আপু? আঙ্কেল আন্টির সাথে থাকছেন না?”
“আমার আব্বা আম্মা আসলে আমার এভাবে চলে আসার ব্যাপারটা একদম নিতে পারছেন না। জানো তো আমি রাগ করে চলে এসেছি। ওনারা তাই আমার উপর রাগ করে আছেন। ওনাদের সাথে থাকলেই বারবার ফিরে যেতে চাপ দিবেন। তাই আপাততঃ মেয়েকে নিয়ে ছোটো একটা বাসায় উঠতে চাইছিলাম। কিন্তু নিরাপত্তা একটা বড়ে ইস্যু জানো তো।”
“তা তো অবশ্যই। আপনি একা একজন। চাইলে আমাদের বাসায় উঠতে পারতেন লারা আপু। আমাদের নিজেদের বিল্ডিং। আপনার জন্য একটা ফ্ল্যাট খালি করে দিতাম।”
“নাহ্। আর প্রয়োজন নেই। বাসা পেয়েছি। এই তো অফিসের কাছেই। আশিকের চাচা যে বিল্ডিং এ থাকেন সেখানেই। আশিক নিয়ে ওনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। খুবই আন্তরিক মানুষ। লামিয়া তো ওনাদের পেয়ে সেই খুশি। ওনাদের মেয়ে দু’জনই খুবই মিশুক।”
“বাহ্ আপু। আসলেই ওনারা খুব ভালো। ভালোই হলো আপনি ওনাদের সাথে উঠছেন। আশিকও নিশ্চিন্ত হলো। আচ্ছা আপু আমি আজ উঠি। বাসায় আসবেন কিন্তু।”
এভাবে হাসিমুখে লারার সাথে পূর্নাকে কথা বলে বিদায় দেখে বুকের উপর থেকে পাথরটা যেন নেমে যায় আশিকের। নিঃশ্বাস ছাড়ে স্বস্তির।
“ও কী পূর্ণা! লাঞ্চ বক্স নিয়ে যাচ্ছ যে?”
“এটা তো আর লাগবে না আপু। আপনারা নিশ্চয়ই বাইরে লাঞ্চ করবেন।”
“আরে নাহ। আমি তো যাচ্ছি। বরং তুমি আর আশিক চাইলে বাইরে লাঞ্চ করতে পারো। লাঞ্চ বক্সটা চাইলে আমাকে দিতে পারো। আমার দুপুরের খাবার হয়ে যাবে। এমনিতেও তোমার রান্না কিন্তু দারুণ। মিস করতে চাই না।”
বলে হাসে লারা।
“আপনি আমার রান্না কবে খেলেন আপু?”
“এই যে তুমি লাঞ্চ বক্স দাও না। কত যত্ন করে খাবার দাও মাশাল্লাহ। এমনি এমনি কী আর আশিককে লাকি বলি! কত গুণবতী বৌ।”
“গুণ কে ভালোবাসে আপু? গুণবতী বৌয়ে মানুষের মন ভরে না। আচ্ছা আমি উঠি।”
আশিক তাড়াতাড়ি বলে ওঠে,
“বসো পূর্ণা। লাঞ্চ করবো একসাথে। এই ফাইলটা রেখেই উঠছি। চলো ক্যাপ্টেনসে যাই। প্লিজ।”
“আরে পূর্ণা বসো তো। এই লাঞ্চ বক্স আমি নিলাম। তুমি আজ আশিকের সাথে লাঞ্চ করে আসো। এত সুন্দর করে কেউ আমাকে প্লিজ বললে না করতে পারতাম না।”
“তাই? আচ্ছা আমি প্লিজ বলছি আপু। চলুন আপনিও আমাদের সাথে একসাথে লাঞ্চ করবেন।”
“আজ না পূণা আরেকদিন। উঠি হ্যাঁ।”
“আপু যাওয়ার আগে একটা প্রশ্ন করতে পারি? একটু ব্যক্তিগত। কিন্তু আমার জানা প্রয়োজন।”
“হ্যাঁ বলো।”
লারা পূর্ণার কথা বলার ধরনে একটু অবাক হয়।
“লারা আপু, আপনি স্বামীকে ছেড়ে এসেছেন কেন?
আশিকের সাথে কি আপনার সম্পর্কটা শুধুই বন্ধুত্বের? না এর বাইরেও কিছু আছে? থাকলে বলতে পারেন। আমি আপনাদের মাঝে বাঁধা হবো না।”
আচমকা এমন প্রশ্নে লারার মুখের রঙ পরিবর্তন হয়ে যায়, নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তর দেয়,
“না পূর্ণা, আশিক শুধুই আমার ক্লাসমেট আর বন্ধু। আমার হ্যাসবেন্ড বরং আমার ভালোবাসার মানুষ ছিল,
কিন্তু বিয়ের পর আমাদের বনিবনা হচ্ছিল না। ওর বেশকিছু অভ্যাস আছে যা আমার পছন্দ না। এগুলো নিয়েই সমস্যা। ওকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য আমি এখানে মেয়েকে নিয়ে চলে এসেছি। কিন্তু এখনো আমি ওকেই ভালোবাসি। আশিকের সাথে আমার বন্ধুত্বের বাইরে অন্য কোন সম্পর্ক নেই পূর্ণা।”
“বন্ধু আমাদেরও আছে আপু। কিন্তু কী জানি এমন বন্ধুত্বগুলো বুঝি না। কেমন জানি গাছেরটাও খাওয়া, তলারটাও কুড়ানো। নিজের স্বামীকে ভালোবাসেন, তাকে ধরে রাখতে, শিক্ষা দিতে এখানে এসে আরেকজনের স্বামী নিয়ে মজেছেন। ছিঃ!”
“পূর্ণা! এসব কী কথা বলছো! একটা শিক্ষিত মেয়ে হয়ে এত নিচু তোমার ভাবনা! আশিক আমি আজ উঠি। যা করেছিস তার জন্য ধন্যবাদ। তবে আমি তোর চাচার বাসায় উঠছি না।”
নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখেই নিচু গলায় বলে লারা। অফিসে, পাবলিক প্লেসে তামাশা করতে চায় না। এখানে কোন তামাশা হলে কালি ওর গায়েই বেশি ছিটবে। আশিকও পূর্ণার এই হঠাৎ আক্রমণাত্মক আচরণে ভীষণ বিব্রত হয়, এই ভয়ই সে মনে মনে পাচ্ছিল। কিন্তু পূর্ণাকে তার থামাতেই হবে, ”
“পূর্ণা এসব কী উল্টোপাল্টা বলছ? মাথা ঠিক আছে তোমার? তুমি আসলে এইটা সন্দেহপ্রবণ সাইকো। স্যরি লারা তুমি কিছু মনে করো না। পূর্ণার মাথা ঠিক নেই”
আশিকের কথায় তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে পূর্ণা, চিৎকার করে বলে,
“আমি সাইকো! আমার মাথা ঠিক নাই! আর তুমি ঠিক? তোমরা সবাই ঠিক। নির্লজ্জ, চরিত্রহীন এই মহিলার জন্য তুমি আমাকে সাইকো বলো! বন্ধুত্ব শেখাও আমাকে! অবশ্য আমার স্বামীরই চোখ খারাপ। অন্যের কথা কী বলবো। ঘরের কাজের মেয়ে থেকে শুরু করে শ্যালিকা, কাজিন, কলিগ সবার দিকে নজর। কপালদোষে আমিও এমন স্বামীই পেলাম!”
অফিসের লোকজন উঁকিঝুকি মারতে শুরু করেছে। আশিকের মনে হচ্ছে ধরণী দ্বিধা হও! লারাও হতভম্ব হয়ে গিয়েছে। এমন কিছু হবে তা তার ধারণায়ও ছিল না। তাহলে পূর্ণা আসা মাত্র বের হয়ে যেত। তবু পূর্ণাকে শান্ত করার চেষ্টা করে।
“পূর্ণা, প্লিজ শান্ত হও। তুমি কী বলছো তুমি নিজেও জানো না। আশিক আর আমার পাশাপাশি তুমি নিজের সম্পর্কও শেষ করছো। দেখ সবাই দেখছে, শুনছে। কী ভাবছে সবাই! তুমি যা ভাবছো, তা ভুল। আমাদের মাঝে এমন কিছু নাই। আজকের পর থেকে আমি আশিকের সাথে আর কোন যোগাযোগ করবো না। তুমি নিশ্চিত থাকো। প্লিজ পূর্ণা, শান্ত হও।”
“আপনি যোগাযোগ না রাখলেও আশিক ঠিকই রাখবে। আশিক কিন্তু আপনাকে বেশ পছন্দ করে। বাসায় গেলে শুধু আপনার গল্প। আপনার একাকিত্ব নিয়ে তার খুব চিন্তা। দেখেন না আপনার সাথে এক গাড়িতে আসার জন্য সকালে নাস্তা না করেই বের হয়ে যায়।”
হাসতে হাসতে বললেও পূর্ণার চোখে পানি।
“ধরনী দ্বিধা হও! দ্বিধা হও!”
মনে মনে জপে আশিক। এইজন্য রোজ সকালে পূর্ণা এমন করে,ওর ধারণা আশিক লারার সাথে গাড়িতে যায়, তাই গাড়ি মিস করতে চায় না!
“পূর্ণা তুমি ভুল বুঝছ। আশিক তোমাকে খুব ভালোবাসে, আর তুমিও বাসো। কিন্তু সম্পর্কে বিশ্বাস খুব জরুরি পূর্ণা। আচ্ছা আমি উঠি আশিক।”
লারা চলে গেলে আর একটা কথাও বলে না আশিক।
“পূর্ণা বাসায় চলো, আমিও যাবো তোমার সাথে।”
(চলবে)