#আকাশেও_অল্প_নীল #পর্বঃ০৯ #আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

0
483

#আকাশেও_অল্প_নীল
#পর্বঃ০৯
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

২৩,
“দেখুন মাহাদ ভাই আমার বোনের সাথে যেহেতু বিয়ে টা হবে, সো আই থিংক আপনাদের আমাদের পরিবারের সব খুঁটিনাটি জানা উচিত। বিয়ের মতো পবিত্র বন্ধন, কারোর ঠুনকো কথায় যেনো আপনাদের মাঝে কোনো দূরত্ব সৃষ্টি না করতে পারে, আমি সবকিছু আগে ভাগেই বলে এরপর বিয়ের দিনতারিখ নিয়ে নিশ্চয়তা দিতে চাচ্ছি। কারণ একটা সম্পর্ক গড়তে যতোটা সময় নেয়, কারোর ঠুনকো কথায় ২সেকেন্ড সময় লাগবেনা ভাঙতে। একটা সম্পর্ক গড়াও যেমন সহজ, ভাঙাও তেমন সহজ। কঠিন শুধু আগলে রাখা, আকড়ে ধরে বাঁচা। তাই জানানোটা জরুরী মনে করছি।”

মাহাদের কথার উত্তরে দিগন্ত উত্তর দেয়। মাহাদের সাথে সাথে সাহিরা বেগম, শাহনাজ বেগম সহ রাইমাও একটু অবাক হয়। দিগন্তের গম্ভীর কথার মানে বুঝতে না পেরে মাহাদ বললো,

“তোমার বোনকে যখন গত ৮বছরেও ছাড়িনি, ভরসা করতে পারো আগীম সময়গুলোতেও যতোই কঠিন সময় আসুক, আমি ছাড়বোনা। আমি অতীতের কিছু জানতে চাইনা, ইচ্ছেও নেই। তবুও যদি তুমি বলে শান্তি বোধ করো। বলতে পারো, আমরা শুনছি।”

“হ্যাঁ বাবা, তোমার যদি মনে হয় বলা জরুরী, তবে বলো।”

শাহনাজ বেগম মাহাদের কথার পরপরই কথাটা বললেন। রাইমা দিগন্তের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, এই লোক আবার উল্টোপাল্টা কিছু জানিয়ে বিয়েটা না ভেঙে বসে। কেমন একটা ভয় লাগতে শুরু করেছে রাইমা। সে স্নেহার দিকে দৃষ্টি ফেরায়। স্নেহা মাথা নিচু করে বসে আছে। দিগন্ত হালকা হেসে বলতে শুরু করে,

“আপনাদের মানসিকতা অনেক উন্নত আন্টি। আমার বোন ভালো থাকবে আমি বুঝে গিয়েছি। তবুও বলার প্রয়োজন মনে করছি, কারণ মানুষের ভালো মানুষ আর সহ্য করতে পারেনা। আর সেখানে স্বার্থে আ”ঘাত লাগলে তো আরও পারেনা। আমাদের মা আমার পাঁচ বছর বয়স বছর হবে হয়তো,আপুর তখন ৭বছর চলছে, তখনই আমাদের বাবাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যান৷ কারণ ছিলো আমার বাবার গুরুতর অসুখ হয়েছিলো। পুরো বেড রেস্টে পরে গিয়েছিলেন উনি। জীবনের ভরসা ছিলো না৷ বাবা নিজের সবকিছু আমাদের দুই ভাইবোনের মাঝে আর আমার ফুফু আছেন একজন, উনার যা হক তা দিয়ে দেন। মায়ের নামে বাবা আর মায়ের বিয়ের সময়ই বাবা একখণ্ড জমি লিখে দিয়েছিলেন। যার উপর একটা এতিমখানা তৈরি করেছিলেন আমার বাবা। দেখাশোনাও করতেন উনি আর্থিক সবদিক৷ মাকে নতুন করে আর কিছু দেননি বাবা৷ আমার নানী আমার মা-কে নিয়ে চলে যান বাবার গুরুতর অবস্থা দেখে। চাচ্চু আর ফুফু মিলে না আগলিয়ে রাখলে হয়তো আমরা আজ এই জায়গায় থাকতাম না। শেয়াল কুকুরে রাস্তায় ছিড়ে খেয়ে ফেলতো। সেসব দিকে না যাই। তো আমার মায়ের সাথে বাবার ডিভোর্স হলে মা চলে যান। বাবা যদি মা”রা যায়! এই সম্পর্কে মায়ের ফিউচার কি! বাবাও মা’কে কিছু দেননি, আমরা দু ভাইবোন যদি বড়ো হয়ে মা’কে না দেখি! বাবা হীন আমরা যদি বিগড়ে যাই। এটাই ছিলো চিন্তা আমার নানীর। নানী উনার মেয়ের কথা ভেবেছেন, মা-ও তার মায়ের কথা শুনে ভেবে সম্পর্ক ছেদ করে চলে গিয়েছিলেন৷ নানী দেখেশুনে বিয়ে দিয়েছিলেন, উনিই ডিভোর্স করিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। একজন মা চাইলেই পারেন সব গড়তে, আবার চাইলেই পারেন ভাঙ’তে। নানীও সেটাই করেছেন, যেটা উনি উনার মেয়ের জন্য ভালো বুঝেছেন। বাবা সময়ের সাথে একটু দেরি হোক, কিন্তু সুস্থ হোন চলাফেরা করার মতো। এরপর ফুফু, চাচা গ্রামে চলে যান। বাবা আর বিয়ে করেননি, আমাদের দু ভাইবোনকে মানুষের মতো মানুষ করার পাল্লায় নামলেন। মানুষ হলাম, কিন্তু বাবাকে আগলে রাখতে পারলাম না৷ উনার হায়াত শেষ, উনি রবের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গিয়েছেন৷
২৪,
আমার মা ২য় বিয়ে করেছিলেন। সেখানে উনি সন্তান নিতে পারেননি, কারণ উনার ২য় স্বামীরও ১ম ঘরে সন্তান ছিলো। যদি মায়ের সন্তান হয়, আগের সন্তানগুলোকে তো উনি হয়তো অবহেলা করবেন। এই কারণে মায়ের সন্তান নেওয়া হয়নি। আমার মা ফিরে আসতে চাইলে বাবা আর ফিরিয়ে নেননি। মা আমার আপাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো। আপাও যায়নি, বাবাও দেননি। বাবা মা’রা যাবার পর থেকে মা আমাদের কাছে আসতে চান, কারণ বাবা থাকতে আমাদের দুজনের সামনে উনিই ঢাল ছিলেন। আমি আর মা’কে মানতে পারিনি, হয়তো পারবোও না। কারণ আমার যখন মা’কে প্রয়োজন ছিলো, আপার যখন প্রয়োজন ছিলো! উনি অন্যরে সন্তানকে আগলে গেছেন তখন৷ এখন মা যখন বাবা মা’রা যাবার পরও আমাদের কাছে ফিরতে পারলেন না, তখন ঐ এতিমখানার এতিম বাচ্চাদের থাকার জায়গাটুকু উচ্ছেদ করার ভয় দেখালেন। আপার বিয়েটা আমাদের মামাতো ভাই আছে, তার সাথে দিতে চেষ্টা করলেন। যেনো আপাকে একটু যখন ইচ্ছে গিয়ে দেখতে পারেন। এখানে তো আসতে পারেন না। আমি মা’কে সহ্য করতে পারিনা এজন্য। মাহাদ ভাইকে বিয়ে না করতে চাওয়ার এগুলোই কারণ ছিলো। আমি জানি আমার মা বিয়ে ভাঙার চেষ্টা অবশ্যই করবেন। তাই এতো ইতিহাস জানানো। আমি এগুলো বড় হওয়ার পরপর আপা, বাবা দুজনের থেকে জেনেছি৷ আর মায়ের অন্য সংসারের অশান্তিগুলো যখন বাবার কাছে ফিরতে চেষ্টা করতেন মা, কান্না করে বলতেন৷ তাই বলতে পারলাম৷ আমাদের পরিবার টা এমনই। এখন যদি মনে হয় এমন পরিবারের সাথে আত্মীয়তা করা উচিত, তাহলে আগামী শুক্রবারের পর শুক্রবারে বিয়েটা হোক৷ কারণ সেদিনই নতুন একটা এতিমখানা তৈরি করেছি বাচ্চাদের জন্য। ওখানে তাদের পার করে দিবো। কারণ আমি এটাও আন্দাজ করতে পারি মা বিয়েটা না ভাঙতে পারলে বাচ্চাদের থাকার জায়গা উচ্ছেদ করার ভয় দেখাবেন৷ আমি চাচ্ছি সেদিনই বাচ্চাদের নিয়ে এসে আপার বিয়ের অনুষ্ঠানে তারাও অংশ গ্রহণ করুক।”

দিগন্ত দীর্ঘ সময় নিয়ে কথাগুলো বললো। এরপর থামে সে। রাইমা এক ধ্যানে তাকিয়ে দিগন্তের কথাগুলো শুনলো। এই লোকটা ভেতরে ভেতরে মা হারানোর শোক জমিয়ে রেখেছে, দেখলে বোঝা যায় না তো! রাইমা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মাহাদ স্নেহাকে দেখছে, এই মেয়েটা এতো কষ্ট জমিয়ে রেখেছে ভেতরে, কখনও তাকে টের পেতেও দেয়নি! সে শুধু জানতো, স্নেহার বাবা মা নেই, একটা ভাই আছে শুধু । ভাইয়ের খেয়াল রাখতে সে বিয়ে টা করতে চায়না৷ কিন্তু এতো কথা তো কখনও জানায়নি! সে কি এতোটাই পর ছিলো স্নেহার! নাকি সে আপন হতে পারেনি! মাহাদ একটু অভিমান করে স্নেহার উপর।

২৫,
সব শুনে শাহনাজ বেগম বলেন,

“আজ থেকে তোমাদের মা বাবা নেই, এই কথা ভাবার দরকার নেই। আমি তোমার আংকেল যতোটা পারবো বাবা মা তো হতে পারবোনা, কিন্তু তাদের মতো আদর দেওয়ার চেষ্টা করতে পারি। তোমার কথাই রইলো, সেই দিনই বিয়েটা হবে।”

“আলহামদুলিল্লাহ।”

দিগন্ত মুচকি হেসে বললো। রাইমাও খুশি হয়, স্নেহার গলা জড়িয়ে ধরে বলে,

“যাক একজোড়া ভালোবাসার কপোত-কপোতী অবশেষে এক হবে। আলহামদুলিল্লাহ।”

রাইমা স্নেহা ছেড়ে দিয়ে বসলো ঠিকঠাক হয়ে। দিগন্ত আড়চোখে দেখছিলো তাকে৷ সেজন্য ছেড়ে দিয়ে বসলো। নয়তো আরও কিছু সময় জড়িয়ে ধরে বসে থাকতো।

“আজ তবে উঠি আমরা। অনেক সময় পেরিয়ে গেলো আসার৷”

শাহনাজ বেগম বললেন কথাটা। সাহিরা বেগম তাল মিলিয় বললেন,

“হ্যাঁ কথাবার্তা যখন মিটলো, এবার যাওয়া দরকার আমাদের।”

“আন্টি একটা রিকুয়েষ্ট আছে।”

স্নেহা নিচু স্বরে কথাটা বললো। সাহিরা বেগম হবু পুত্রবধুর থুতুনিতে ফের হাত রাখলেন। মুখটা উচু করে ধরে বললেন,

“অনেক তো আন্টি বললে! এবার একটু মা ডাকা প্রাক্টিস করো। আমার সন্তান একটাই, একজনের মুখে তো মা ডাক শুনে আত্মা শান্তি হয়না। তোমারও বলতে হবে।”

“আচ্ছা চেষ্টা করবো, আমি আপনাদের জন্য ছোট্টখাটো কিছু আয়োজন করেছি। সেগুলো খেয়ে এরপর বাসায় ফিরবেন আজ। প্লিজ না করবেন না।”

স্নেহা আদুরে গলায় অনুরোধ করে বললো কথাটা। শাহনাজ বেগম বললেন,

“আচ্ছা ঠিক আছে। তোমার অনুরোধ আমরা রাখবো।”

স্নেহা খুশি হলো। দিগন্ত বললো,

“আপনারা এখানে আড্ডা দিন, আমি টেবিল সাজিয়ে ডাকবো।”

শাহনাজ বেগম ব্যস্ত হয়ে দিগন্তের কথার উত্তরে বললেন,

“আমরা আমরাই তো! সবাই একসাথে গুছিয়ে নিয়ে খেতে বসি!”

“আপনারা আজ আমাদের বাসায় প্রথম আসছেন, আজকের দিনটা আমি করি! এরপর না হয় মায়ের হাতের রান্না খেতে ইচ্ছে করলে আমি গিয়ে আপনাদের জ্বা”লাতন করবো!”

“আচ্ছা বাবা আচ্ছা। মেনে নিলাম তোমার কথা।”

দিগন্ত মুচকি হাসলো শাহনাজ বেগমের কথায়। উঠে চলে গেলো ডাইনিং টেবিলের দিকে। রাইমা কিছু একটা ভেবে উঠে দাড়ালো। মাহাদ তা দেখে বললো,

“কোথায় যাবে? উঠলে যে!”

“আমি একটু উনাকে হেল্প করি ভাইয়া। একা একা কাজ করতে গিয়ে কিছু ভেঙে বসলে! ছেলে মানুষ তো! কি করতে কি করে বসে! আর ফলমূল এসব তো আর কেউ খাবেনা এখানে। নিয়ে যাই আমি।”

রাইমা কথাটা বলেই দ্রুত গতিতে সব গুছিয়ে নিয়ে চলে গেলো। কাউকে কিছু বলার সুযোগও দিলো না৷ স্নেহা একবার বারণ করতে চাইলো। পরে সেও কিছু কথা ভেবে বাধা দিলো না৷ রাইমা চলে যেতেই স্নেহা শাহনাজ বেগমের দিকে তাকিয়ে ভীতু গলায় বললো,

“আন্টি একটা অনুরোধ করবো? রাখবেন? যদিও জানিনা আমি, আমার কথাটা কিভাবে নিবেন! তবুও কেনো জানি মনে হলো আমার এই বিষয়টা হতেই পারে৷ দারুণ হবে।”

মাহাদ ভ্রু কুচকে তাকালো স্নেহার দিকে। কি ভাবলে আবার স্নেহা! শাহনাজ বেগম একবার বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে স্নেহার দিকে তাকালেন। এরপর স্নেহার হাত ধরে বললেন,

“কি অনুরোধ মা?”

“আমি তো আপনার বোনের ঘরে চলে যাবো বউ হয়ে। আমার ভাই একলা পরে রবে এই এতো বড়ো বাসায়। তার দেখাশোনা আমি করি, আমি চলে গেলে কে করবে? বলছি আন্টি, আমায় আপনাদের ছেলের জন্য নিয়ে যাচ্ছেন, আমার ভাইটার জন্য আপনাদের মেয়েকে দিবেন? আমিও ওয়াদা করছি, আপনাদের মেয়ে আল্লাহ সহায় থাকলে ভালো থাকবে, খারাপ নয়।”

উপস্থিত তিনজনই পুরোপুরি হতবাক হয়ে গেলো স্নেহার কথায়। স্নেহা যে এমন কথা বলবে! কেউ কল্পনাই করেনি৷ স্নেহা সবার হতবাক চাহনী দেখে কাঁপা গলায় বলে,

“আমি কি অন্যায় আবদার করলাম আন্টি?”

চলবে?

ভুলত্রুটি মার্জনীয়। চোখ আর হাতের যা অবস্থা লেখাই কঠিন। যতটুক পারলাম দিলাম। রিচেইক করিনি, ভুলগুলো ক্ষমা করবেন।আর দিগন্তের মায়ের বিষয়টা আমার কাছের একজনের মায়ের চরিত্র থেকে তুলে আনা। তাই বিষয়টা খারাপ লাগলেও আমি দুঃখিত।আসসালামু আলাইকুম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here