#আকাশেও_অল্প_নীল
#পর্বঃ২৬
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি
৮০,
“আসলে কি বল তো! গতকাল যে আমায় ইফরাদ তার মায়ের কথায় আমায় তাদের বাসায় নিয়ে গেলো! সেখানে কথাবার্তার এক পর্যায়ে ইফরাদ আমার প্রতি বিরক্ত হয়ে জিগাসা করে, আমার এতো ন্যাকামি আসে কোথা থেকে! ব্যস কথাটা সোজা মনে গিয়ে লেগেছে রাই৷”
শার্লিনের উত্তরে রাইমা চিন্তিত হয়ে পরে। ইফরাদ সহজে এমন ভাবে বলার মানুষ না। রাইমা চিন্তিত স্বরে শার্লিনকে জিগ্যেস করলো,
“তুই কি এমন করেছিলি? যে ইফরাদ ভাই এমন বললো?”
“তেমন কিছু নয়, মাহিশাকে দেখার জন্য পিক চেয়েছিলাম। দিচ্ছিলো না, তাই জেদ করায় তা ইফরাদের কাছে বাচ্চামি লেগেছে। বাদ দে সেসব। তোর বিয়ের আর বাকি তো আছে ৪দিন। গ্রামে যাবি কবে?”
রাইমা শার্লিনকে ঘাটালো না। আপাতত চুপ থাকলো, পরে ইফরাদের সাথে কথা বলে বিষয়টা দেখা যাবে। শার্লিনের কথার উত্তরে রাইমা বললো,
“আজই দুপুরের পরপর বেরুনো হবে। মা সব গুছিয়ে নিয়েছে। এখান থেকে বেরিয়ে মাহাদ ভাইদের বাসায় গিয়ে সবাইকে নিয়ে এক সাথেই যাওয়া হবে।”
“দিগন্ত ভাইয়ের পরিবার বলতে তো শুধু স্নেহা ভাবী। ভাবীও কি তোদের সাথেই যাবে?”
“না, ভাবী আর মাহাদ ভাই দিগন্ত সাহেবের সাথেই থাকবে। ওরাও নিজেদের গ্রামেই যাবে। ওখানে তো উনার ফুফি, চাচা সবাই আছে। বেশি আয়োজন না হলেও মাঝামাঝি পর্যায়ের ধুমধাম হবেই।”
“বাহ রাই, দিগন্ত সাহেব!! ভালোই তো সম্মোধন টা! এতোদিন তো আমি খেয়াল করিনি। করবোই বা কি করে? আমার সামনে তো তোরা কথাও বলিস না৷ দারুণ দারুণ।”
শার্লিন রাইমার মাথার চুল এলেমেলো করে দিয়ে হেসে কথাটা বললো। রাইমা শার্লিনের মুখে হাসি দেখে যেনো হাফ ছেড়ে বাচলো। এই মেয়েকে চুপচাপ, হাসিখুশি বিহীন একদম মানায় না। একে হাসিতেই সুন্দর লাগে। শার্লিন এরমাঝেই হাসি থামিয়ে গালে হাত দিয়ে ভাবুক ভঙ্গিতে কিছু একটা ভাবতে শুরু করেছে। রাইমা তা দেখে জিগাস্যা করে,
“কি ভাবছিস?”
“ভাবছি, তুই এখনও দিগন্ত ভাইকে আপনি ডাকিস, এটা নরমালই লাগে। বাট দিগন্ত ভাই তোকে আপনি বলেই সম্মোধন করে যতোদূর খেয়াল করেছি। দিগন্ত ভাইয়ের তো উচিত তোকে তুমি বলা। যেহেতু তুই উনার ছোটো+বউও হয়ে যাচ্ছিস।”
“কিছু সম্পর্ক আপনি ডাকেই সুন্দর। তার যেটায় কমফোর্ট ফিল হয় বলুক। আমি অযথা কিছু বলে উনাকে অসস্তিতে ফেলতে চাই না।”
“বাহ, প্রেম জমে ক্ষীর তবে। দুই ঝগরুটে, পাড়ার কিছু কিছু টক্সিক কাকিমাদের মতো ছিলো! তাদের মাঝে ভালোবাসা জন্ম নিচ্ছে। বিষয়টা দারুণ।”
শার্লিন মুখে হাত দিয়ে হাসতে হাসতে কথাটা বললো। রাইমা বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে শার্লিনের পিঠে হালকা চাপড় মে”রে বললো,
“ধ্যাত, একদম আজেবাজে কথা বলবিনা।”
“তোমরা প্রেমে পরছো, তাতে কিছু না৷ আমি বললেই যতো দোষ। ব্যাপারটা হলো, যতো দোষ, শার্লিন ঘোষ।”
৮১,
শার্লিনের কথা ফুরোতেই রাইমা শব্দ করেই হেসে উঠলো। শার্লিন রাইমার হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। এরপর ব
আনমনা হয়ে বললো,
“তোর বিয়ে হওয়ার পর আমাদের জীবন টা কেমন পাল্টে যায় তাই না রাই? দিনের ১৪ঘন্টা যার সাথে হাহা হিহি করছি, মন খারাপ হলে ছুটে আসছি, বকবক করতে করতে মন খারাবি উধাও করে দিচ্ছি, কিছু হলে ফোন দিয়ে মাথা ন”ষ্ট করে দিচ্ছি, যখন ইচ্ছে, তখনই একে অপরের বাসায় এসে দুজনে আড্ডা দিচ্ছি, একটু মনে হলো বাইরে যাবো, ছুটে যাচ্ছি। একটা সময় আসবে, এসব বন্ধ হয়ে যাবে। মন খারাপ হবে! এসব তখন স্মৃতি হয়ে মন পাড়ায় একাদোক্কা খেলবে। চাইলে আর তোরে জড়িয়ে ধরে কাঁদা যাবেনা, ফোন দিয়ে একটু মন হালকা করতে চাইবো, পারবোনা। হয়তো তুই সংসার জীবনে ব্যস্ত থাকবি! নয়তো আমি৷ ইশশ কি নিদারুণ যন্ত্রণা৷ আমরা আর এক রকম শাড়ি পরে চাইলেই পারবোনা ঘুরতে, পারবোনা বিকেল হলে রাস্তার পাশ ঘেটে হেটে বেড়াতে। পাড়ার শেষের মাঠটায় গিয়ে ঘাসের উপর বসে বাচ্চাদের লাফালাফি দেখতে। চাইলেও পারবোনা তোর উপর অধিকার দেখিয়ে আমার কাছে রাখতে। তোকে আমি চাইলেও আর তখন ছুতে পারবোনা, হাসতে হাসতে তোর উপর গড়িয়ে পরবোনা, কথার ছলে কি”লও মারতেও পারবোনা। পারবোনা বুদ্ধি করে ক্লাসের শেষ বেঞ্চটায় বসে গল্প করতে ক্লাসে মনোযোগ না দিয়ে। আমাদের হুট করে একদিন দেখা হবে, দুজনের সংসারের গল্প হবে। হবে নিজেদের ব্যস্ততার গল্প। হবেনা শুধু এই সুন্দর সময়গুলো ফিরে পাওয়া। এই এতো এতো না পাওয়ার ভীড়ে আমাদের পাওয়া এই সুন্দর সময় গুলো হারিয়ে যাবে। জীবন টা অদ্ভুত না রাই? আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে রাই। আমার ভীষণ ভীষণ কান্না পাচ্ছে। এই তো এখনই তোকে জড়িয়ে আমি কাঁদতে পারবো। ক’দিন পর আর তোকে জড়িয়ে কাঁদাও যাবেনা। জীবন এতো বিভীষিকা কেনো রাই? আমরা যেটায় খুশি থাকি! তা দীর্ঘস্থায়ী কেনো হয়না বলতো?”
শার্লিন একদমে কথাগুলো বলে থামলো। রাইমা এতোক্ষণে ফুফিয়ে কান্না শুরু করে দিয়েছে। শার্লিন তাকে ধরে কান্না জুড়ে দেওয়ার আগেই সে শার্লিনের মাথা ধরে বুকের মাঝে বাচ্চাদের মতো আগলে ধরে কান্না শুরু করেছে। সত্যিই তো জীবন এতো বিভীষিকাময় কেনো? কেনো সারাজীবন সুখের ছোয়া যেসব মানুষে, তারা স্থায়ী হয়না! রাইমার কাছে এসবের উত্তর নেই। শার্লিন তো বাচ্চাদের মতোই রাইমা জড়িয়ে ধরায় জোড়ে শব্দ করে কান্না করে দিয়েছে। আরফান আর শাহনাজ বেগম এবং আজাদ সাহেব এসেছিলো রাইমার কাছে । কিন্তু শার্লিন তখন কথা বলায় ব্যস্ত থাকায় ওনারা আর রুমে ঢুকেননি। দরজায় দাড়িয়ে ছিলেন। আরফানও মায়ের হাত আকড়ে ধরে দাড়িয়েছিলো মায়ের সাথে। তারা এসেছিলেন মেয়ের সাথে একটু একান্ত সময় কাটিয়ে হাতে হাতে রাইমার সব জিনিস গুছিয়ে নিতে। এরপর তো বিয়ের ব্যস্ততায় রাইমার সাথে সময় টুকুও ঠিকমতো কাটানো হবে না। শার্লিনের কথা শুনে উনারাও কেঁদে ফেলেছেন৷ দুজনের কান্না থামাতে উনারাও চোখ মুছে রুমে ঢুকলেন। শাহনাজ বেগম শার্লিন আর রাইমার মাথায় হাত বুলিয়ে কান্নাভেজা গলায় বললেন,
“কষ্ট তোমার একার হচ্ছে মা! আমাদের হচ্ছে না? এভাবে কেঁদো না মা। আমরা নিজেদের শক্ত রাখবো কি করে বলো তো?”
বাবা-মা, ভাইকে দেখে রাইমা আরও ভেঙে পরে শার্লিনকে ছেড়ে মা’কে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। আজাদ সাহেব আড়ালে চোখ মুছলেন। বাবা তো! উনাকে শক্ত থাকতেই হবে। নিজের মায়ের আসনে বসানো মেয়েটাকে অন্যের হাতে তুলে দিতে হবে! এরপরও কান্না করা যাবেনা। উনি যে বাবা! বাবাদের কাঁদতে হয় আদৌও? কাঁদলেই তো সন্তানকে নিজের কাছে বেঁধে রাখা যাবেনা। আরফান বাচ্চা মানুষ, এতোটাও সম্পর্কের অনুভূতি গুলো বুঝে উঠেনি। তবুও সে কান্না থামাতে পারছেনা। বোনকে আর কাছে পাবেনা কিছুদিন পর থেকে! এই কঠিন বাস্তবটা সেও বুঝে গিয়েছে। কান্নারত না আর বোনকে সেও দুহাতে যতোটা পারছে জাপ্টে জড়িয়ে ধরেছে। রাইমা কাঁদতে কাঁদতে বলতে শুরু করে,
৮২,
“শক্ত থাকতে পারছিনা মা! কি করে শক্ত থাকি বলোতো? তোমার আঁচলের তলায় বড়ো হয়ে, বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে তোমার হাতে হাতে কাজ শেখা, একসাথে সময় কাটানো, সকালে উঠে তোমার হাতে হাতে নাস্তা বানানো, কতো শখ আহ্লাদ তোমায় বলা। অসুস্থ হলে তোমার একেকটা নির্ঘুম রাত। তোমার আমার বন্ডিং টাই তো এক্সপ্লেইন করা পসিবল না মা। বাবার সাথে এতো শতো খুনশুটি, আরফানের সাথে ঝগড়া। আমি এসব না করে থাকবো কি করে? ও মা, আমায় বিয়ে দিও না মা। আমায় তোমাদের সাথে রেখে দাও। আমার বুকের ভিতর জ্ব”লছে মা। আমার তোমাদের ছেড়ে থাকতে হবে ভাবতেই তো কলিকাটা ছিড়ে যাচ্ছে মা। কয়দিন ওর রমজান আসবে! আমায় তো কেউ ধাক্কিয়ে সাহরীতে তুলবে না মা। ঈদের দিন তোমার হাতের সেমাইটা খাওয়া হবে না। এতো যন্ত্র”ণা নিয়ে বাঁচা যায় মা?”
“ধুর পাগলি মেয়ে! আমিও তো আমার মা বা পরিবার ছেড়ে তোর বাবার হাত ধরে এই সংসার সাজিয়েছি। আমি জানি আমার মেয়ে হয়ে তুইও পারবি সংসার সাজাতে। মেয়েরা বিয়ের আগে তোর মতোই বলে কিভাবে থাকবো! বিয়ের পর এমনিই নিজেদের মায়ের কথা ভেবে ধৈর্য এসে যায়৷ আমাদের কি কষ্ট হয় না? হয় তো! কিছু ভালোমন্দ রান্না করলে, মেয়ের প্রিয় খাবারটা রান্না করলে আমাদের গলা দিয়ে নামতে চায়না, কিছু করতে গেলে তাতে মেয়ের স্মৃতি থাকলে আমাদের হাত নড়ে না৷ কিন্তু দিব্যি জীবন টা কেটে যায়। এটাই বাস্তবতা, আমাদের নিয়তি। আর বাস্তবতা জিনিসটা বড্ড তিক্ত হয় রে মা।”
শাহনাজ বেগম নিজেকে সামলে মেয়ের কথার উত্তর দেন। আজাদ সাহেব পরিবেশ টা স্বাভাবিক করতে হইচই করে৷ শার্লিনের উদ্দেশ্যে বলেন,
“শার্লিন মা, তুমি তো সবাইকে চুটকিতে হাসাও। তুমিই কাঁদছো! এটা মানা যায় না মা। নেও সবাইকে নরমাল করোতো। এরপর তোমার এই ইমোশনাল বান্ধবীকে থামিয়ে, তার যা যা প্রয়োজন গুছিয়ে নিতে বলো। গাড়ি আসছে,রাস্তায় আছে। এসে পরবে শিগগিরই। তুমিও বাসায় গিয়ে ব রেডি করে নাও। তুমি আর মিসবাহ আজই যাবে। ভাই আর ভাবীর সাথে আমার কথা হয়েছে। উনারা গায়ে হলুদের দিন যাবেন। তোমার বাবার অফিসের ছুটি কম। পাবেনই না, তবুও রিকুয়েষ্ট করে ছুটি নিয়েছেন, আমার কথা রাখতে। কিন্তু তোমাদের তো আর অফিস নেই। যাও ঝটপট রেডি হয়ে এসো।”
“জি আংকেল যাচ্ছি।”
শার্লিন নিজের চোখ মুছে বসা থেকে উঠে দাড়ায়। রাইমার কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“আর কাঁদিস না। তোর বিয়ে নিয়ে আমার সব আনন্দ করার প্ল্যান মন খারাপের কান্নার জলে ভেসে যাবে। আমি রেডি হই, তুইও রেডি হ। মাফ চাই বইন ইমোশনাল করার জন্য। এবার কান্না থামা।”
শার্লিনের কথায় নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে রাইমা। মা’কে ছেড়ে হাসার চেষ্টা করে। শার্লিন রাইমার গাল টেনে দিয়ে বলে,
“এই তো আমার গুড ফ্রেন্ড। এবার রেডি হ, বিয়েতে দুলাভাইয়ের পকেট ফাঁকা করবো গেইট ধরে, জুতা চুরি করে। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে।”
শার্লিন রাইমার গাল ছেড়ে লাফাতে লাফাতে চলে যায়৷ এই মেয়ে যে কি! এই কাঁদে তো এই হাসে। ওর কান্ড দেখে রাইমা হাসে, তার সাথে বাকিরা। এরপর ব্যস্ত হয়ে পরে নিজেদের কাজ গুছিয়ে নিতে। প্রায় দুপুর আড়াইটা বেজে যায় তারা সব রেডি করে বের হতে হতে। শার্লিন আর রাইমা পাশাপাশি বসে নিজেদের সীটে গা এলিয়ে দিয়ে গল্প করতে ব্যস্ত হয়ে পরে। এরমাঝেই রাইমার হাতে থাকা ফোন টা বেজে উঠে। স্নেহার ফোন এসেছে।
চলবে?
ভুলত্রুটি মার্জনীয়, রিচেইক দেইনি, আলসেমি লাগে।😑 সামনে ঈদ, বুঝতেই পারছেন সময়টা কতোটা ব্যস্ততাময়। এই পর্ব লিখতে গিয়ে লিটারেলি আমি নিজেই কান্না করে দিয়েছি।😑🤧সাধারণ একটা পর্ব, তবুও কেনো জানি আমার কান্না পেলো। তাই বেশি বড়ো করিনি। তবুও ১৪০০+ওয়ার্ড লিখেছি। ইনশা আল্লাহ চেষ্টা করবো রাতে আরও একটা পার্ট দেওয়ার৷ আসসালামু আলাইকুম।