#আমাকে_ঘুড়ি_ভেবে_ওড়াস_না
।।১।।
“মামা, কোথায় যাবেন?”
“শাহবাগ!”
“ভাড়াটা?”
লোকাল বাসে উঠে অভ্যাস নেই, কোনো রকমে কসরত করতে করতে ভারসাম্য বজায় রাখতে রাখতে কাঁধের পার্স খুলে মানি ব্যাগের সন্ধানে হাতড়াল জিনিয়া। তিন খোপের পার্সের মাঝখানের খোপেই সব সময় রাখে মানিব্যাগটা, কিন্তু সেখানে পেল না সেটা।
মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল তার, কারণ এই মাত্র তার মনে পড়ল মানি ব্যাগ আনেনি সে!
আসবার আগে তাড়াহুড়ো করে আসতে গিয়ে মানি ব্যাগ রেখেই চলে এসেছে!
এখন? কী হবে?
দুর্বল গলায় বলার চেষ্টা করল জিনিয়া, “মামা আমি ভুল করে মানি ব্যাগ রেখে চলে আসছি!”
কণ্ডাক্টর এমন একটা মুখ ভঙ্গি করল যেন তার আগেই জানা ছিল।
“সমস্যা নাই, নাইম্যা যান!”
“এইখানে?” রীতিমত আঁতকে উঠল জিনিয়া।
বাসা থেকে এক কিলোমিটারও যেতে পারেনি সে। সেটা সমস্যা না, সমস্যা হচ্ছে বেরিয়ে আসবার আগে আর ফিরে আসবে না এই মর্মে একটা চিরকুট লিখে পড়ার টেবিলে রেখে এসেছে।
ওর জন্য শাহবাগ অপেক্ষা করার কথা নাহিদের, সেই মতো বাসে উঠেছে জিনিয়া। রাইসার পার্টিতে পরিচয় হয়েছিল নাহিদের সাথে, দুদিন দেখা করেছে বসুন্ধরা সিটিতে।
আজকে বাসায় গেস্ট আসবার কথা, ফুপির বান্ধবীকে আম্মু কেন দাওয়াত করবে এই ভেবে প্রথম থেকেই সন্দেহ হচ্ছিল তার। পরে জমিলা বুয়ার কাছ থেকে জানা গেল ফুপির বান্ধবীর একটা বিবাহযোগ্য ছেলে আছে আর তার গলায় জিনিয়াকে লটকে দেওয়ার হালকার ওপর ঝাপসা একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছে।
শোনার পর থেকেই রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে জিনিয়ার। এমন একটা কথা, তাও তার জমিলা বুয়ার কাছ থেকে শোনা লাগল?
কিছুটা আম্মুর ওপরে রাগ করেই সে ঠিক করল চলে যাবে নাহিদের সাথে। অনেক দিন ধরেই বলছিল অবশ্য।
পরীবাগে ওর বোনের বাসায় গিয়ে উঠবে প্রথমে। তারপর কালকে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করা যাবে।
উচিত শিক্ষা হবে আম্মুর একটা!
কিন্তু, এখন কী হবে? কণ্ডাক্টর তো এখনই নামিয়ে দিতে চাইছে!
“এই যে মামা” বলে পেছন থেকে ভাড়া এগিয়ে দিলো একজন।
“কে?” ঝটকা দিয়ে পেছনে ঘুরল জিনিয়া, কে তার এমন হিতৈষী, চেহারাটা দেখার জন্য।
“আমি!” দাঁত বের করে হাসল ছেলেটা। “এখনো আগের মতই আওলাঝাওলা আছিস?”
“ওহ!” নিঃশ্বাস ফেলল জিনিয়া। “তাও তো ভাগ্যিস সিএনজি না পেয়ে বাসে উঠেছি, সিএনজি ভাড়া দিতে না পারলে কী হতো বল তো?”
চিন্তা করেই শিউরে উঠল জিনিয়া।
“সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু গাড়ী কই তোদের?”
“তার আগে বল তুই যাচ্ছিস কোথায়?”
“আমি তো আসছিলাম ডিসিসিতে কেনাকাটা করতে, এখন বাসায় যাচ্ছি! কিন্তু তুই যাচ্ছিস কোথায়?”
দ্রুত হিসাব কষতে শুরু করল জিনিয়ার মস্তিষ্ক। উদয়কে সবকিছু খুলে বলবে কি বলবে না?
একজন নেমে যাওয়ায় একটা সিট ফাঁকা হয়েছে উদয়ের পাশে, বসল না উদয়। জিনিয়াকে ইঙ্গিত করে বলল, “বস!”
সাধাসাধি করতে হলো না জিনিয়াকে, ধপ করে বসে পড়ল সে।
“আহা অমন ধপাস করে বসিস কেন? পেরেক টেরেক বের হয়ে থাকে, জামা ছিঁড়ে গেলে বুঝবি তারপর!”
উত্তর দিলো না জিনিয়া, এত ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর বসতে পেরে কেমন অবশ অবশ লাগছে শরীরটা।
“এবার বল গাড়ি কি গ্যারেজে?”
উদয়ের চোখে চোখে তাকাল জিনিয়া। “বলব, সব বলব! তার আগে প্রমিস কর কাউকে বলবি না?”
“ঠিক আছে, প্রমিস করছি!”
গলা নামিয়ে বলতে শুরু করল জিনিয়া। উদয় যে তার পর, ব্যাপারটা এমন নয়।
উদয় তার ছোট্ট বেলার বন্ধু আর প্রতিবেশী।
নিকেতনে পাশাপাশি বাসায় থাকত তারা প্রায় আট বছর, বিকেলে এক সাথে খেলত দুজন। তখন নিকেতনে এতটা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ছিল না, আর রাস্তার মাঝখানে জায়গায় জায়গায় ছিল গর্ত।
একটু বৃষ্টি হলেই পানি জমে যেত। তারা যে রাস্তায় খেলত, সেখানে একটা সাইনবোর্ডও টানানো ছিল।
“এই রাস্তায় গাড়ী স্লো করবেন
এখানে বাচ্চারা খেলাধুলা করে”
সময়ের পরিক্রমায় বদলে গেল সবই, গুলশানে জিনিয়াদের ফ্ল্যাটের কাজ শেষ হয়ে গেলে ওরা চলে এলো গুলশানে, আর কী একটা অসুবিধার কারণে বন্ধ হয়ে গেল উদয়ের আব্বুর অফিস।
খরচ কুলাতে না পেরে উদয়রা শিফট হয়ে গেল মহাখালী দক্ষিণ পাড়ায়। ছোট থাকায় ব্যাপারগুলো তখন ভালো বুঝতে পারেনি জিনিয়া, পরে আস্তে আস্তে বুঝেছে।
আম্মুর সাথে আন্টির যোগাযোগ ছিল হালকা পাতলা, দুজন এক সাথে বাণিজ্য মেলায় যেত। অনেক দিনের প্রতিবেশী তাই হৃদ্যতা ছিল।
কিন্তু তারপর যা হয়, আস্তে আস্তে যোগাযোগ কমেছে। হালকা হতে হতে এক সময় শূন্য হয়ে গেছে যোগাযোগ।
উদয় ফেসবুকে এড আছে জিনিয়ার সাথে, তাই চেহারা দেখেই সাথে সাথে চট করে চিনে ফেলেছে। নাহয় চিনতে পারত না।
ফেসবুক জিনিসটা মাঝে মাঝে ভালোই, জিনিয়ার মনে হয়।
ছোট বেলার বন্ধুকে অনেক দিন পর সামনাসামনি পেয়ে একটু বোধ হয় স্বস্তি পাচ্ছে জিনিয়া। ব্যাপারটা কারো সাথে শেয়ার করতেও ইচ্ছা করছিল আবার কার সাথে শেয়ার করবে সেটাও ভেবে পাচ্ছিল না।
জিনিয়া গলা নামিয়ে বলল, “শোন, আমি তো বাসা থেকে চলে এসেছি!”
“মানে?”
“মানে একবারে চলে এসেছি, আর ফিরে যাব না!”
“ফাজলামি করিস?”
“ফাজলামি না, সত্যি!”
“যাচ্ছিস কোথায়?”
“এই বাস কোথায় যাচ্ছে?”
“শাহবাগ?”
“হ্যাঁ সেখানেই।“
“সেখানে কোথায়? কোনো হোস্টেলে?”
“না, আপাতত নাহিদের বোনের বাসায়!”
“নাহিদ কে?”
“আমার বয়ফ্রেণ্ড!”
হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল উদয়। “তোর কী হইছে জিনিয়া? ছোট বেলায় তো তোর কিছু হলেও বুদ্ধি শুদ্ধি ছিল!”
রেগে উঠল জিনিয়া, “ঠিক আছে, এখন নাই! হইছে? খুশি হইছিস?”
“কী করে সেই পোলা? খাওয়াতে পারবে তোকে?”
“তা জেনে তোর কী?” ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে মুখ ঘুরিয়ে নিল জিনিয়া।
পাশের সিটে বসে একজন হাঁ করে জিনিয়ার প্রত্যেকটা কথা যেন গিলছিল, সেদিকে চোখ পড়তেই ফিক করে হেসে ফেলল উদয়।
“তুই হাসতেছিস? শালা, তোকে বলাই আমার ভুল হইছে!”
মহাখালী চলে এসেছে, নেমে গেল জিনিয়ার পাশের সিটের মানুষটা। উদয়ের বাসা এখানেই, ওর এখানে নেমে যাওয়ার কথা।
তার বদলে সে জিনিয়াকে বলল, “চাপ, আমি বসব!”
“তুই বসবি কেন? তোর বাসা চলে আসছে না?”
“আমি তোর সাথে যাব!”
“কেন?”
“এমনিই, শখ হইছে তোর আশিককে দেখতে!’
“আমি তোকে নিব না! সর, আমি নেমে যাচ্ছি!”
“নেমে গিয়ে?”
“অন্য একটা বাসে উঠব!”
ফিক করে হেসে ফেলল উদয়।
“হাসিস কেন? ওই, হাসিস কেন?”
“টাকা আছে তোর কাছে? অন্য একটা বাসে উঠলে তোমার ভাড়া কে দিয়ে দিবে মামা?”
হতাশ হয়ে আবার বসে পড়ল জিনিয়া। জানালা দিয়ে তাকাল বাইরে।
বাইরের দিকে দৃষ্টি রেখেই বলল, “তুই কী করছিস আজকাল?”
“তেমন কিছুই না। চাকরি করছি, মাস্টার্স করছি।“
বয়সে উদয় জিনিয়ার সমবয়সী হলেও জিনিয়া ছোট বেলায় প্লে গ্রুপ, নার্সারি, কেজি ওয়ান, কেজি টু সব পড়েছিল বলে উদয়ের থেকে এক ক্লাস পিছিয়ে গিয়েছে। তাই উদয়ের গ্র্যাজুয়েশন শেষ হয়ে গিয়েছে আগেই।
“বাসায় আসিস না কেন?’
উদয় প্রসঙ্গ পালটে বলল, “ছবি আছে তোর নায়কের? ফোনে ছবি নাই?”
“তা আছে কিন্তু ফোন তো অফ করে রেখেছি! তোর ফোনে ফেসবুক বের করে দে, আমি ফেসবুক থেকে দেখাচ্ছি!”
পকেট থেকে ফোন বের করে ফেসবুক খুলে দিলো উদয়। ফেসবুকে সার্চ করে নাহিদের আইডি খুঁজে বের করল জিনিয়া।
“এই যে, দেখ!”
“রিকোয়েস্ট দেবো?”
“কী দরকার?”
“নাহ, তেমন কোনো দরকার নাই।“
জ্যামের জন্য বাস এগোচ্ছে না, আরাম করে হেলান দিয়ে সিটে বসল উদয়। রিল্যাক্স ভঙ্গিতে বলল, “এবার বল!”
ঘুরে তাকাল জিনিয়া, “কী বলব?”
শ্রাগ করল উদয়। “এই তো। কীভাবে পরিচয়, কী করে, সব বল। বাসা থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়োজন হলো কেন সেটাও বল।“
(আপনাদের ভালো লাগলে চলবে)