#আমাকে_ঘুড়ি_ভেবে_ওড়াস_না
।।১২।।
বড় হলরুমে ফাইনাল রিহার্সাল করার কথা আজ, আগামীকাল এখানেই হবে ফাইনাল প্রেজেন্টেশন। অনুষ্ঠানটা একদম ফাইনাল প্রোগ্রামের মতো করেই সাজানো হয়েছে।
কাল এটারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে, শুধুমাত্র বাইরের অতিথিদের সামনে। সব ডিপার্টমেন্টের শেষে উদয়ের ডিপার্টমেন্টের প্রেজেন্টেশন হওয়ার কথা, মোটামুটি মিড লেভেল থেকে শুরু করে সব স্টাফ উপস্থিত।
দর দর করে ঘামছে উদয়, সকাল থেকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না প্রেজেন্টেশনটা। শুধু পাওয়ার পয়েন্ট না, ওয়ার্ড ফাইল, স্ট্যাটিসটিক্সের চার্ট সবই ফোল্ডারসহ গায়েব।
এগুলো সবই গত দশ পনের দিনের পরিশ্রম, চট করে বানিয়ে ফেলা সম্ভব নয়। ব্যাক আপ যেখানে রাখা সেখান থেকেও উধাও হয়ে গেছে সবকিছু।
আফসানা কথা বলছে না তার সাথে, তারপরও নিরুপায় হয়ে লাঞ্চ আওয়ারে আফসানাকেই আটকাল সে, “তোমার মেইলে আমার প্রেজেন্টেশনটা পাঠিয়েছিলাম না? দাও তো ওইটা!”
নিষ্ঠুর হাসি ফুটে উঠল আফসানার মুখে, “কেন দিব? দিব বলে কি তোমার ডেস্কটপ থেকে সব ডিলিট করলাম নাকি?”
আকাশ থেকে পড়ল উদয়, “হোয়াট? তুমি ডিলিট করেছ! বাট হোয়াই?”
“বিকজ ইউ চিটেড মি, দ্যাটস হোয়াই!”
“তুমি কি জানো যে তুমি মেন্টালি সিক?”
“ও আচ্ছা! আমি মেন্টালি সিক তাই না? ওকে! ফাইন! তুমি ভালোভাবে কথা বলে স্যরি বললে হয়ত দিয়ে দিতাম আমি প্রেজেন্টেশনটা! কিন্তু এখন আর কিছুতেই দেবো না! ইউ জাস্ট গো টু হেল!”
“আফসানা প্লিজ! এটা আমাদের মান সম্মানের প্রশ্ন! তোমার পারসোনাল রাগের জন্য হোল ডিপার্টমেন্ট সাফার করবে?”
“হ্যাঁ করবে! কারণ তুমি আমাকে সাফার করিয়েছ!”
সবার প্রেজেন্টেশন শেষ, উপস্থাপক উদয়ের নাম ঘোষণা করলেন। ধীর পায়ে স্টেজে উঠল উদয়।
মাইক্রোফোনটা হাতে নিয়ে কিছু বলার নিষ্ফল চেষ্টা করল। তারপর হুড়মুড় করে গড়িয়ে পড়ল মঞ্চের ওপরে।
হাত থেকে মাইক্রোফোনটা ছিটকে পড়ল বিকট শব্দে। স্পিকার অন করা ছিল বলে সবার কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড়।
অফিসের মেডিকেল টিম ছুটে এসে উদয়কে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বলল, “হুট করে ব্লাড প্রেশার কমে যাওয়ায় এ রকম হয়েছে।“
প্রেজেন্টেশন বাতিল হয়ে গেল। বস উদ্বিগ্ন মুখে বললেন, “কালকে তুমি সরাসরি প্রেজেন্টেশন করতে পারবা? কোনো রিহার্সাল ছাড়া?”
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল উদয়। বস আর ঘাঁটালেন না।
অফিসের বাস ছাড়তে দেরি আছে আরো কিছুটা সময়, একটা উবার ডেকে উদয়কে তুলে দেওয়া হলো তাতে। “ভালোই হলো”, ভাবল উদয়, আর কিছু ক্ষণ আফসানাকে চোখের সামনে দেখে সহ্য করতে পারত না সে। মেরেই বসত হয়ত।
বাসায় যাওয়ার পথে শূন্য দৃষ্টিতে পথের দিকে তাকিয়ে আছে উদয়, ফোনটা বেজে উঠল আচমকা। স্ক্রিনে তাকিয়ে রাগে ক্ষোভে ফোনটা আছাড় মেরে ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে হলো ওর।
কল করেছে জিনিয়া, ওর জীবনের শনি! ওর জন্যেই তো এত সব কিছু গণ্ডগোলের সূত্রপাত!
রিং বেজে বেজে থেমে গেল, ধরল না উদয়। নাছোড় বান্দার মতো ফোন করতেই থাকল জিনিয়া।
কল রিসিভ করে ঝাঁঝিয়ে উঠল উদয়, “আবার কী চাস?”
থমকে গেল জিনিয়া। “কী চাই মানে? এভাবে কথা বলতেছিস কেন?”
আক্রোশে ফেটে পড়ল উদয়, “তোর জন্য, বুঝলি, শুধু তোর জন্য! আমার এত মাসের পরিশ্রম সব বরবাদ হয়ে গেল শুধু তোর জন্য!”
“আরে বাপ এত নাটক না করে কী হইছে বল না!”
রাগ সামলে ঘটনাটা মোটামুটি খুলে বলল উদয়। কথার মাঝে কোনো বাধা না দিয়ে জিনিয়া চুপচাপ শুনে গেল পুরোটা।
উদয়ের কথা শেষ হলে বলল, “তোর কথা কি শেষ হইছে নাকি আরো কিছু বলবি?”
“কী আর বলব? বলার আর আছে কী!”
“অফিসের ডেস্কটপ ছাড়া আর কোথাও নাই ওইগুলা?”
“না, আর কোথায় থাকবে?”
“ভালো মতো মনে করে দেখ!”
“ওয়েট, ওয়েট! আমি মনে হয় লাস্ট ড্রাফটের আগের ড্রাফটটা মেইল থেকে আমার বাসার ল্যাপটপে নামায়ে রাখছিলাম!”
“তাহলে তো হলোই! সেটা একটু এডিট করে ঠিকঠাক করে নিতে পারবি না?”
আবার ভেঙে পড়ল উদয়, “কিন্তু অনেকগুলো ডাটা ইনপুট দিতে হবে, আবার অনেকগুলো চার্ট করতে হবে! এক রাতের মধ্যে কি শেষ করতে পারব আমি?”
“আমি যদি হেল্প করি তোকে?”
“তুই হেল্প করবি আমাকে?”
“কেন করব না? দুজন মিলে করলে ঠিক শেষ হয়ে যাবে!”
“কিন্তু কোথায় বসে করব?”
“আমাদের বাসায়!”
“তোদের বাসায়? মানে? আংকেল আন্টি কিছু মনে করবে না?”
“কী মনে করবে? আরে শোন শোন, আমি তো সেই জন্যই কল করলাম তোকে! আসল কথাই তো বলা হয় নাই!”
“বল কী বলবি!”
“আজকে আম্মু আব্বু আংকেল আন্টি মানে তোর আম্মু আব্বুকে আমাদের বাসায় দাওয়াত করছে।“
“কী বলিস এগুলা? আংকেল না অসুস্থ?”
“রিলিজ দিয়ে দিছে আজকে দুপুরেই। আর তাদের মধ্যে কী কথা হইছে জানি না। কিন্তু আমার না খুব ভয় হচ্ছে জানিস!”
“কীসের ভয়?”
নিচের ঠোঁট কামড়ে এক মুহূর্তের বিরতি নিল জিনিয়া। ফোনের অন্য পাশ থেকে উদয়ের চেহারাটা দেখতে পাচ্ছে না সে।
দেখতে পেলে ভালো লাগত এই মুহূর্তে।
‘শোন, যদি আমাদের বিয়ের কোনো কথা ওঠে, আমি কিন্তু তোকে বিয়ে করতে পারব না, ওকে?”
হো হো করে হেসে ফেলল উদয়।
“হাসতেছিস কেন তুই? হাসতেছিস কেন? এই, আমি হাসির কী বললাম হ্যাঁ?”
“না, তুমি আমাকে বিয়ে করবা কেন? তুমি তো বিয়ে করবা কোনো ফ্রড ভ্যাগাবণ্ডকে!”
লজ্জা পেল জিনিয়া। “উপকার করে এইভাবে খোঁটা দিলে উপকারের সোয়াব কমে যায় তুই জানিস না?”
“তোর সোয়াব তুইই রাখ! আমি সোয়াবের আশায় কিছু করি নাই। আর হ্যাঁ”, এক মুহূর্ত থেমে যোগ করল উদয়, “তোকে বিয়ে করার জন্য আমিও মরে যাচ্ছি না!”
“যাক বাবা, বাঁচলাম!” স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল জিনিয়া।
“মানে? আমি কি এতই খারাপ পাত্র!”
“আরে না না, ওই রকম কিছু না!” আশ্বস্ত করল জিনিয়া, “আসলে বিয়ে করলে ফ্রেণ্ডশিপ নষ্ট হয়ে যায় তো, তাই।“
“বাবা, এত কিছু জানিস তুই!”
লজ্জা পেয়ে হাসল জিনিয়া। “আর তুই থাক না আমার সেভিয়ার ফ্রেণ্ড হয়ে। বিয়ের পর জামাই তেড়িবেড়ি করলে ঠ্যাঙানি দেওয়ার জন্যেও তো একটা ফ্রেণ্ড লাগে!”
“আমার ঠেকা পড়ছে তোর জামাইরে ঠ্যাঙানি দিতে!”
কথায় কথায় গাড়ী চলে এসেছে উদয়ের বাসার কাছে।
“আচ্ছা শোন আমি রাখি এখন। চলে আসছি বাসার কাছাকাছি।“
“আচ্ছা, তুই জাস্ট আসার সময় তোর ল্যাপটপ আর ডাটাগুলি নিয়ে আসিস। বাকি আমরা ম্যানেজ করে ফেলব! আম্মু আব্বুরা গল্প করতে করতে হয়ে যাবে!”
“ঠিক আছে!”
ফোন রেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল উদয়। হয়ত অতটা ভালো হবে না তবে আপাতত মান সম্মান তো বাঁচল।
আফসানার কথা মনে পড়তেই রাগে বিরক্তিতে ছেয়ে গেল মনটা। এটা একটা কাজ হলো কোনো?
বাসায় ঢুকে উদয় দেখল সবাই মোটামুটি রেডী হয়েই বসে আছে। শুধু তার জন্য অপেক্ষা।
উদয় ঢুকতেই হড়বড় করে বললেন নাসরিন, “আসছিস? এখন রেডি হয়ে নে তাড়াতাড়ি! আমরা দেখতে যাব জিনির আব্বুকে!”
উদয় আড় চোখে উদিতার দিকে তাকিয়ে বলল, “রোগী দেখতে যাবা তো এমন বিয়ে বাড়ির সাজ দিছ কেন?”
নাসরিন ধমক দিয়ে বললেন, “বিয়ে বাড়ির সাজ দিব না তো কি মরা বাড়ির সাজ দিব? সাজের তুই কী বুঝিস? বেশি কথা না বলে রেডী হ এক্ষণ!”
সারা দিন ধরে অনেক ঘেমেছে দুশ্চিন্তায়, একবারে গোসল করে ফেলল উদয়। কী মনে করে সুন্দর করে শেভ করে আফটার শেভ লোশনও লাগাল।
নিজেকে বোঝাল মন ফ্রেশ থাকলে কাজ করতেও ভালো লাগে, সামনে অনেক কাজ বাকি প্রেজেন্টেশনের।
পাঞ্জাবি পরার জন্য জোরাজুরি করছিলেন নাসরিন, রাজি হলো না উদয়। রিচ ম্যানের নতুন একটা স্কাই ব্লু শার্ট ছিল, রওনা হলো সেটা পরেই।
ওদের বাসায় যাওয়ার পর অনেক ডাকাডাকি করার পরেও বাইরে আসছিল না জিনিয়া। খুব লজ্জায় পড়ে গেলেন জেসমিন।
গজগজ করতে করতে বললেন, “আজকালকার পোলাপানদের ঢং দেখলে গা জ্বলে যায়! এমনিতে আপনাদের বাসায় গিয়ে থাকতে পারল, আর এখন নাকি সামনেই আসতে পারবে না! লজ্জা লাগতেছে! তখন কই ছিল লজ্জা?”
হেসে গড়িয়ে পড়লেন নাসরিন। “আহা বাদ দেন না ভাবী!”
উদয়ের সহ্য হচ্ছিল না এই সব। কালকের প্রেজেন্টেশন রেডি করতে হবে।
সময় ফুরিয়ে আসছে দ্রুত।
উঠে দাঁড়াল উদয়, “জিনির রুমটা কই আন্টি?”
সামান্য অবাক হলেও সেটা প্রকাশ করলেন না জেসমিন, “এই তো এদিকে, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি!”
জিনিয়ার ঘরের দরজায় নক করল উদয়, “ঢং না করে দরজা খোল এখন, টেনশনে মরে যাচ্ছি আমি!”
একবারেই দরজা খুলল জিনিয়া, আর তাকে দেখে একটা হার্ট বিট মিস হলো উদয়ের। কাকতালীয়ভাবে সেও একটা আকাশী নীল শাড়ি পরে আছে।
মুখে কোনো প্রসাধন নেই, নেই সারা গায়ে এক টুকরো গয়নাও। তারপরও চোখে মুখে ছড়িয়ে আছে অদ্ভুত স্নিগ্ধতার পরশ।
(পরের পর্ব পরশু দিন ইন শা আল্লাহ্)