#আমাকে_ঘুড়ি_ভেবে_ওড়াস_না
।।১৩।।
“ঢং না করে ভেতরে ঢুকতে দে, টেনশনে মরে যাচ্ছি আমি!”
দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়াল জিনিয়া। থমথমে মুখে বলল, “আয়।“
“মুখ বানায়ে রাখছিস কেন?”
“আম্মু সাজতে বলছিল, তাই!”
উদয় কাঁধের ব্যাগ জিনিয়ার টেবিলে নামিয়ে রেখে ল্যাপটপ অন করতে করতে বলল, “সাজতে বলছে সাজবি, আর ইচ্ছা না করলে সাজবি না! মুখ বানানোর কী আছে? আমার তো মনে হয় মেয়েরা সাজতে পছন্দই করে!”
“কাউকে দেখানোর জন্য সাজার মধ্যে একটা অপমানজনক ব্যাপার আছে, তুই বুঝবি না!”
“কাকে দেখানোর জন্য সাজতে হবে?”
“গাধা নাকি তুই? সহজ কথা বুঝিস না কেন? তোরা আসছিস দেখে আমাকে সাজতে বলল, আমি পারব না বলায় একগাদা কথা শুনায়ে দিলো!”
হেসে ফেলল উদয়।
“কথা শুনাইছে শুধু এই জন্য না, বাড়ী থেকে না বলে চলে যাওয়ার জন্যেও! কাজটা ঠিক হয় নাই তোর, স্বীকার কর!”
“আমি তো অস্বীকার করছি না! আমার ভুল হইছিল!”
“প্রিয়জনরা যখন কথা শোনায় তখন আগের জমানো কথাগুলোও একবারে বলে দেয়! তাই বেশি হয়ে যায় কখনো কখনো! কিছু দিন যাক, দেখবি সবাই এটা ভুলে গেছে আবার!”
এদিক ওদিক তাকিয়ে ল্যাপটপে চার্জ দেওয়ার পয়েন্ট খুঁজতে লাগল উদয়।
“কী খুঁজতেছিস?”
“পেয়ে গেছি”, বলে ল্যাপটপের চার্জার বের করে জিনিয়ার টেবিলের নিচের পয়েন্টে ঢোকানোর জন্য উবু হয়ে বসল উদয়। কিন্তু গুঁতাগুঁতি করেও ঢোকাতে পারল না।
“দাঁড়া পারবি না, একটা সিস্টেম আছে ওটার!”
জিনিয়াও হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসল উদয়ের পাশে।
“আমি তোর থেকে কম সিস্টেমবাজ না”, বলে আবারও চার্জারটা সকেটে ঢোকানোর চেষ্টা করল উদয়। এবং ব্যর্থ হলো।
জিনিয়া টান দিয়ে ওর হাত থেকে চার্জার কেড়ে নিয়ে ঢুকিয়ে দিলো সকেটে। টানাটানি করতে গিয়ে উদয়ের মাথার সাথে জোরে বাড়ি খেল জিনিয়ার মাথা।
“উফ!” করে উঠল দুজনেই। তারপর হাসতে শুরু করল।
দরজায় টোকা পড়ল সেই সময়। পর মুহূর্তেই খুলে গেল দরজা।
দরজায় দাঁড়িয়ে আছে মুন্নি। সেখানে দাঁড়িয়ে থেকেই কিছু ক্ষণ সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখল তাদের দুজনকে।
“কী চাস?” হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করল জিনিয়া।
“ছোট আফারে ডাকে!”
“বল গিয়ে কাজ করতেছি, পরে আসব!”
বলতে বলতেই উঠে দাঁড়াল জিনিয়া। “নাস্তা টাস্তা যা দিছিস ড্রয়িং রুমে, সব দিয়ে যা এই রুমে! আমরা এখন কাজ করব! কালকে এসাইনমেন্ট আছে!”
মুন্নি চলে গেলে ল্যাপটপ অন করতে করতে উদয় বলল, “এসাইনমেন্ট?”
“এসাইনমেন্ট বললে ও বুঝবে সহজে, আমার প্রায়ই থাকে তো!”
“আচ্ছা। এখন আয় শুরু করি, সময় কম।“
শুরু করার পর কাজ এগোতে লাগল দ্রুত। কাজ শুরু করার পর জিনিয়া ভুলে গেল ও ঘরে যাওয়ার কথা।
সময় কীভাবে গড়াতে লাগল টেরই পেল না দুজন। রাত নয়টায় টেবিলে খাবার দেওয়ার পর আবার ডাকতে এলো মুন্নি।
“খালাম্মা আফনেরারে এক্ষণই যাইতে কইছে!”
“এখন পারব না, বিরক্ত করিস না তো! ডাটা এন্ট্রি দেওয়ার মাঝখানে আছি।“
মুন্নি চলে যাওয়ার পর কিছু ক্ষণ পর আবার দড়াম করে খুলে গেল দরজাটা। জেসমিন এসে থমথমে মুখে বললেন, “কী ব্যাপার? তুই তো এত বেয়াদব ছিলি না আগে!”
নাসরিন পেছন পেছন এসে উদয়ের সামনে খোলা ল্যাপটপ দেখলেন, জিনিয়ার হাতে ডাটা শিট দেখলেন। পরিস্থিতি অনুমান করে বললেন, “থাক ভাবী ওরা তো কাজ করছে। করুক।“
জিনিয়া কৈফিয়তের সুরে বলল, “উদয়ের কাল প্রেজেন্টেশন আছে!”
‘আচ্ছা করুক কাজ। বড়দের কথার মধ্যে এমনিতেই ওদের কাজ নাই”, বলে জেসমিনকে টেনে নিয়ে গেলেন নাসরিন।
রাত সাড়ে দশটায় নাসরিন এসে উঁকি দিয়ে বললেন, “কী অবস্থা? কত দূর হয়েছে?”
উদয় অসহায় ভঙ্গিতে বলল, “এখনো অনেক বাকি!”
“বাকিটা বাসায় গিয়ে করিস, নাকি? রোগীর ঘর, এখন তো ওরা শুয়ে পড়বে!”
জেসমিন এসে বললেন, “ও তো খেলও না কিছু, না খেয়েই চলে যাবে?”
“আন্টি কালকে ফরেন ডেলিগেটদের সামনে প্রেজেন্টেশন, আমি এখন কিছু খেতে পারব না! গলা দিয়ে ঢুকবে না আমার!”
“কী যে করিস না! এই রকম কাজ কেউ লাস্ট ডেটে করার জন্য ফেলে রাখে?”
কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল উদয়। জেসমিন বললেন, “আচ্ছা ও থেকে যাক আজকে, অসুবিধা নাই। প্রেজেন্টেশনের টেনশনে খেতেও পারছে না, একা একা করতে মনে হয় অসুবিধাও হবে। আমি গেস্ট রুম রেডি করে দিচ্ছি, টেবিলে খাবার দেওয়া থাকল। কাজ শেষ করে খেয়ে নিস তোরা দুজন। ফ্লাস্কে চা বানানো থাকল, যদি লাগে।“
শেষ কথাটা জিনিয়ার উদ্দেশ্যে বলা।
“আরে না না আপনার আবার ঝামেলা হবে!”
“কীসের ঝামেলা? কোনো ঝামেলা না। ওরা কাজ করছে করুক। থাকুক না! আমাদের বাসায় রুমের অভাব আছে নাকি!”
নাসরিন হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, “আচ্ছা থাকুক! ওর প্রেজেন্টেশনটাও তো ইম্পর্ট্যান্ট। আবার দুই ফ্রেণ্ডের দেখা হয়েছে এত দিন পর, এক সাথে থাকুক, কাজ করুক!”
জিনিয়ার কী হলো, বলে ফেলল, “আন্টি আম্মু আপনাকে কী বলেছে বা আপনারা কী বুঝেছেন আমি জানি না। আমি কিন্তু এখন বিয়ে করব না। আমার ইচ্ছা মাস্টার্স করে বাইরে পড়তে যাওয়ার, পি এইচ ডি করার।“
জেসমিন বললেন, “তা সেগুলো কি বিয়ের জন্য আটকে থাকবে নাকি? বিয়ে করে পিএইচ ডি করতে যাবি! স্কলারশিপ না পেলেও কোনো অসুবিধা নাই। প্রয়োজনে জামাইসহ দুজনকেই টিউশন ফি দিয়েই পড়াব!”
নাসরিন বললেন, ‘আমার ছেলের টিউশন ফি আপনারা দেবেন কেন? ও কি বেকার নাকি? ও না পারলে আমরা দিব!”
উদয় অস্থির হয়ে বলল, “উফ আম্মু তোমরা যাও তো! কাজের অনেক ডিস্টার্ব হচ্ছে। আর আন্টি, আমার আর জিনিয়ার মধ্যে ওরকম কোনো রিলেশন নাই। আর যদি হয়ও, আমি কখনোই আমার টিউশন ফি আপনাদের কাছ থেকে নিব না! আমার যা করার আমি নিজের যোগ্যতাতেই করব!’
জিনিয়া বলল, “আম্মু যাও তো! ও আছে এক টেনশনে, তুমি এসে এর মধ্যে আরেক কাহিনী খুলে বসলা!”
জেসমিন কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু নাসরিন আর কিছু না বলার ইশারা দিয়ে নিয়ে আসলেন তাকে। বিদায় পর্ব শেষ করে উবারের গাড়িতে উঠে বসার কিছু ক্ষণ পর উদয়ের আব্বু বললেন, “এখানে কিছু হবে না।“
“মানে?”
“দাওয়াত খাইছ, খাইছ! পরে কোনো প্ল্যান করে থাকলে সেটা ভুলে যাও।“
“কেন?”
“ভাবীর অনেক অহংকার, দেখলা না বাসায় রুমের কথা, টিউশন ফির কথা বলল? এখানে সম্পর্ক হলে ছেলেকে মাথা নিচু করে থাকতে হবে, সাথে আমাদেরও!”
“তুমি আমাদের সব কথা শুনছ?”
“হ্যাঁ আমি পিছনেই ছিলাম! এখানে কিছু হবে না। তুমি আর কথা আগাইও না। ভাবী কথা তুললে সময় চেয়ে নিও কিংবা এটা সেটা বলে কাটায়ে দিও! এটা এমনিতেই হবে না!”
উদিতা আর উদয়ের আম্মু আব্বু চলে যাওয়ার কিছু ক্ষণ পর জিনিয়া উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চল সব কিছু নিয়ে!”
অবাক হলো উদয়। “কোথায় যাব?”
“আমার ঘরে না, খোলা জায়গায় বসব! ডাইনিং রুমে। নাহয় মুন্নি এসে দরজায় কান পাতবে, গসিপ বানানোর চেষ্টা করবে। আমি সেরকম কোনো চান্স দিতে চাচ্ছি না।“
অতিথির ডামাডোলে মুন্নি হয়ত ভুলে গিয়েছিল আশিকের পানির বোতলে পানি ভরতে, রাত আড়াইটার দিকে পানির বোতল ভরতে ডাইনিং টেবিলে এলো আশিক। সে সময় অদ্ভুত একটা দৃশ্য চোখে পড়ল তার।
ল্যাপটপের সামনে বসে গভীর মনোযোগে কাজ করছে জিনিয়া আর উদয়। জিনিয়া পড়ে শোনাচ্ছে আর উদয় এন্ট্রি দিচ্ছে।
দৃশ্যটায় আপাতদৃষ্টিতে তেমন কিছুই নেই। কিন্তু আশিকের বুকের ভেতরে তোলপাড় হতে লাগল।
ইচ্ছে হলো এই মুহূর্তে ছুঁড়ে ফেলে দেয় ল্যাপটপ। বের করে দেয় উদয়কে।
যেভাবে উদয়ের পাশে বসে আছে ঠিক সেভাবে তার পাশে বসে থাকুক জিনিয়া। ডাটা শিট না, জীবনানন্দের কোনো কবিতা পড়ে শোনাক তাকে।
কিন্তু আশিক জানে তা হবে না, কোনো দিনই না। তাই সে ওদের বিরক্ত না করে পানির বোতলে পানি না ভরেই চলে গেল চুপচাপ। কাজে মগ্ন থাকায় ওরা কেউই টের পেল না তার আসা আর চুপচাপ চলে যাওয়া।
বাকি রাত এক ফোঁটা ঘুম এলো না তার।
(পরের পর্ব পরশু দিন ইন শা আল্লাহ্)