#আমাকে_ঘুড়ি_ভেবে_ওড়াস_না
।।১৪।।
প্রেজেন্টেশন কমপ্লিট করে জিনিয়ার সাথে একবার প্র্যাকটিস করে গেস্ট রুমে গিয়ে ঘুমাতে ঘুমাতে উদয়ের বেজে গেল সাড়ে চারটা। এলার্ম দিয়েছিল সাড়ে ছয়টায়।
সেই এলার্ম বাজেনি কিংবা কোনো ভাবে ঘুমের মধ্যেই হাত দিয়ে এলার্ম বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। জিনিয়া যখন তাকে ঝাঁকুনি দিয়ে ডেকে তুলল তখন ধড়মড় করে উঠে জিজ্ঞেস করল ও, “কয়টা বাজে?”
“সাড়ে সাতটা! তোর না সাতটার মধ্যে আমাদের বাসা থেকে বের হওয়ার কথা ছিল?”
“হায় সর্বনাশ!” লাফ দিয়ে উঠল উদয়।
“তোর অফিস কয়টা থেকে?”
“অফিস দশটা থেকে, কিন্তু আজকে একটু আগে যাওয়ার কথা ছিল, অফিসে ভিজিটর আসবে! আর আমি তো একটু বাসায় যেতে চাইছিলাম!”
“কী নিতে হবে বাসা থেকে?”
“শাওয়ার নিতে চাইছিলাম…” বিড় বিড় করে বলল উদয়, “এমনিতেই ঘুম হয়নি, মাথা হ্যাং হয়ে আছে! গোসল করে গেলে মাথাটা একটু ছাড়ত!”
“সে নাহয় এখান থেকেই নে, জিনিসপত্র সব আছে না তোর কাছে?”
“আছে তো, আমি তো ব্যাগ থেকে নামাইনি কিছু! কালকে অফিসের ব্যাগ নিয়েই চলে আসলাম তোর এখানে!”
‘যা তাহলে রেডি হ তাড়াতাড়ি! ওয়াশরুমে ফ্রেশ টাওয়েল, শাওয়ার জেল, শ্যাম্পু সব দেওয়াই আছে। আমিও ক্লাসে যাব, তোকে ড্রপ করে দিয়েই যাব নাহয়!“
“যা তুই আসতেছি আমি!”
দশ মিনিটের মধ্যেই ঝটপট গোসল সেরে রেডি হয়ে গেল দুজন। উদয় যখন বেরিয়ে এলো তখন নিজের নাস্তা শেষ করে উদয়ের জন্য টেবিলে সাজানো ব্রেডের ওপরে বাটার লাগিয়ে রেখেছিল জিনিয়া।
ব্রেড হাতে নিয়ে ব্যাগ ঝুলিয়ে উদয় বলল, “আংকেলের বডি স্প্রেটা একটু এনে দে তো! কালকের শার্ট পরে যাচ্ছি!”
জিনিয়া ঠোঁট উলটে বলল, “ও বাবা! সে পারব না আমি! আব্বু আম্মু ওঠেনি এখনো, এখন ঘরের দরজা নক করলে গলা কাটবে আমার! দাঁড়া এক মিনিট!”
আশিকের দরজায় নক করে বলল জিনিয়া, “আশিক ভাই আপনার বডি স্প্রেটা দেন তো, উদয়ের লাগবে!”
আশিকের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল কেন যেন। রুক্ষ স্বরে বলল, “নাই আমার কাছে, শেষ হয়ে গেছে!”
“উফ! শেষ হয়ে গেছে তো নতুন একটা কিনতে পারেন না? আচ্ছা বের হন এখন, বের হব আমরা”, ঘোষণা দিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল জিনিয়া।
নিজের পারফিউম এনে স্প্রে করে দিলো উদয়ের গায়ে। প্রতিবাদ করতে করতে সরে যাওয়ার সময় পেল না ও।
“চল এখন, সাতটা পঞ্চান্ন বাজে!”
“নো প্রবলেম, দরকারের সময় আমাদের আশিক ভাই পঙ্খীরাজের মতো ড্রাইভ করে! তাই না আশিক ভাই?”
উত্তর দিলো না আশিক, মুখটা তেতো হয়ে আছে। জিনিয়ার পাশে এই ছেলেকে দেখতে রীতিমত অসহ্য লাগছে তার।
আরো বিরক্তিকর ব্যাপার হলো ছেলেটা তাকে ড্রাইভার বলেই মনে করছে। সেটাই স্বাভাবিক, যে কেউই তাই মনে করবে।
গাড়িতে ওঠার আগে শব্দ করে মাটিতে থু থু ফেলল ও।
“ছি আশিক ভাই, এই সব ব্যাড ম্যানার কবে থেকে হলো আপনার?”
উত্তর না দিয়ে গাড়িতে উঠে সশব্দে দরজা বন্ধ করল আশিক।
উদয়ের ফোনে রিং বাজছে। ফ্যাকাসে মুখে একবার জিনিয়ার দিকে তাকিয়ে ফোন রিসিভ করল সে।
“কী অবস্থা, সুস্থ হইছ তুমি?”
“জি জি ইমতিয়াজ ভাই, আসতেছি আমি!”
“কালকে তো রিহার্সালও করতে পারলা না”, গলার স্বরে উদ্বেগ ঝরে পড়ল তার, “দেইখো সব জানি ঠিকঠাকমত হয়!”
‘আইল ট্রাই মাই বেস্ট, ইমতিয়াজ ভাই!”
ফোন রাখার পর উদয়ের হাতে সামান্য চাপ দিয়ে বলল জিনিয়া, “কিচ্ছু হবে না! একদম রিল্যাক্স! তুই কালকে করলি না আমার সামনে? মনে করবি আমার সামনেই করতেছিস আবার!”
“থ্যাংকস দোস্ত! তুই না থাকলে…”
হাত নেড়ে কথাটা উড়িয়ে দিলো জিনিয়া, “অত কথা না বলে এখন একবার চোখ বুলাতে থাক! নিজে নিজে প্র্যাকটিস কর! আমাকে পরে ট্রিট দিয়ে দিলেই হবে কোনো এক সময়!”
উদয়ের হাতে জিনিয়ার হাত রাখা, এই কথোপকথন পুরোটাই অসহ্য লাগছিল আশিকের। ইচ্ছা করছিল গাড়িটাকে কোথাও লাগিয়ে দিয়ে কিংবা জ্যামে ফাঁসিয়ে দিয়ে দেরি করিয়ে দেয়।
কিন্তু তাতে জিনিয়ার আরো বেশি সহানুভূতি দেখতে হয় কিনা, সেই ভয়ে নয়টা চল্লিশেই গাড়ি পৌঁছে গেল উদয়ের অফিসের গেটে।
“বেস্ট অফ লাক!” বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গাড়ির জানালার কাঁচ তুলে দিয়ে ঘড়ি দেখল জিনিয়া। তার নিজের প্রথম ক্লাস শেষ অলরেডি।
যেতে যেতে দ্বিতীয় ক্লাসটাও ধরতে পারবে না সে। অগত্যা বারোটায় ল্যাব ক্লাসে উপস্থিত হওয়া ছাড়া আপাতত আর কোনো অপশন নেই।
এর আগের সময়টা ক্যাফেটেরিয়া আর লাইব্রেরিতে কাটিয়ে দেওয়া যাবে, ভাবল জিনিয়া।
“আস্তে আস্তে চালান আশিক ভাই, অনেক সময় আছে”, বলল জিনিয়া।
“জানি”, রুক্ষ স্বরে বলল আশিক।
“চাকরিটা পাওয়ার পর থেকেই দেখতেছি আপনি খুব ব্যাড মুডে থাকেন?” হালকা স্বরে বলল জিনিয়া, “অবশ্য এটাই নরমাল, আপনার জায়গায় থাকলে হয়ত আমিও চাকরি পাওয়ার পরেও ড্রাইভিং করতে গিয়ে ইরিটেটেড হয়েই থাকতাম!”
অনেকটা স্বগতোক্তির স্বরে বলল সে। এ কথার কোনো উত্তর দিলো না আশিক।
“আম্মুকে জানাইছেন যে আপনি চলে যাবেন?”
“না।“
“না কেন? আপনি তো কিছু হলেও সার্ভিস প্রোভাইড করেন আমাদের ফ্যামিলির জন্য, তাই না? আপনার রিপ্লেসমেন্ট খুঁজে বের করার সময়টুকু দিতে হবে তো! হুট করে চলে গেলে আমরা বিপদে পড়ে যাব না?”
আশিকের মনে হলো জিনিয়ার গলায় খেলা করছে কৌতুক। নাকি তার শোনার ভুল?
গাড়ি জ্যামে আটকেছে, আচমকা জোরে ব্রেক কষল আশিক। শরীরের ভারসাম্য রাখতে না পেরে সামনে এগিয়ে এসে আবার সিটের সাথে বাড়ি খেল জিনিয়া।
“উফ আশিক ভাই, হোয়াটস রঙ? এত হার্ড ব্রেক করতেছেন কেন?”
“চুপ করে থাকো, কোনো কথা বলবা না! ভাল্লাগতেছে না আমার এত কথা!”
একটু অবাক হয়ে গেল জিনিয়া। আশিক তো কখনো এভাবে কথা বলে না!
গলার স্বর নরম করে জিজ্ঞেস করল, “কী হইছে আশিক ভাই? ফুপি সুস্থ আছে? আনিকা আপুর সব খবর ভালো তো?”
নিজেকে সামলে নিল আশিক। “না, ঠিক আছে সব। সরি, আমি আসলে…”
“না না, ঠিক আছে, ইটস অলরাইট! শেয়ার করার মতো হলে শেয়ার করতে পারেন। যদি খুব বেশি সিক্রেট কিছু না হয়!”
“না তেমন কিছু না!”
জিনিয়া ভয়ে ভয়ে বলল, “আপনার অফিসে জয়েনিং এর কোনো প্রবলেম না তো? ওরা কি কোনো জামানত টামানত চাইছে? বা কোনো দালালকে টাকা পয়সা দিতে হবে, এরকম কিছু হইছে? প্লিজ শেয়ার করেন! আপনাকে হেল্প করতে পারলে আমার ভালোই লাগবে!”
“না জিনি, সেরকম কিছু না! আর সেরকম কিছু দরকার হলে আমি মামার কাছ থেকেই নিব! মামা এত কিছু করছেন আমাদের জন্য, আর এই সামান্য জিনিস চাইতে পারব না তার কাছে?”
“তাহলে কী সমস্যা আশিক ভাই? কেন আপসেট হয়ে আছেন আপনি এত? কেন এত ইরিটেটেড লাগতেছে আপনাকে?”
চলে এসেছে জিনিয়ার ক্যাম্পাস, গাড়ী থামাল আশিক। নেমে এসে দরজা খুলে ধরল জিনিয়ার জন্য।
“বললেন না আশিক ভাই? আসেন তো গাড়ি পার্ক করে, ক্যাফেতে বসি আপনার সাথে! আমার পরের ক্লাস অনেক পরে, সময় আছে আমার!”
নামতে নামতে বলল জিনিয়া।
“থাক জিনি! ড্রাইভারের সাথে ক্যাফেতে বসবা, তোমার স্ট্যাটাসের সাথে যায় না সেটা!”
“মানে?” কিছুই বুঝতে পারছে না জিনিয়া, “আপনি তো আমার কাজিন!”
“সেটা যাই হোক! তোমার ফ্রেণ্ডরা তো দেখেই আমি তোমার ড্রাইভার!”
“সো হোয়াট? আমি ওদের বলে দিলেই হবে!”
“না জিনি। আসলে ছোট বেলায় আব্বা মারা গেছে তো। অনেক কিছুতে ছাড় দিতে দিতে অভ্যাস হয়েই গেছে। তোমার ক্যাফেতে বসার অফারটাও ছাড়ই দিলাম মনে কর!”
পেছনে চলে এসেছে আরেকটা গাড়ি, হর্ন দিচ্ছে। দ্রুত ড্রাইভিং সিটে উঠে গেল আশিক।
জিনিয়া হাসিমুখে বলল, “ওকে, আপনি ছাড় দিলেও আমি দিব না কিন্তু! আগে জয়েন করেন আপনি! আপনার অফিসের ক্যাফেতেই ট্রিট নিতে আসব আমি!”
(খেয়ালের বশে হুট করেই শুরু করা গল্পটা লিখতে লিখতে কতটুকু লিখে ফেললাম, আলহামদুলিল্লাহ্)