#আমাকে_ঘুড়ি_ভেবে_ওড়াস_না
।।১৫।।
খুব বেশি আহামরি ভালো হলো না উদয়ের প্রেজেন্টেশন, এর চেয়ে ভালো প্রেজেন্টেশন সে নিজেই দিয়েছে, এর আগেই, এই অফিসেই। কিন্তু আপাতত বিপদ উতরে গেল ভালোভাবেই।
প্রথমে আত্মবিশ্বাস পাচ্ছিল না সে, বার বার মনে হচ্ছিল এক রাতের প্রস্তুতির ফলাফল এটা। কিন্তু দু একটা স্লাইড পরেই যখন দেখল সবাই মনোযোগ দিয়েই দেখছে তখন হারানো উদ্যম ফিরে পেল আবার।
সবাই প্রশংসাও করল, যদিও সে নিজে সন্তুষ্ট হতে পারল না খুব একটা। হয়ত আরো ভালো হতে পারত, এমনটাই মনে হচ্ছিল তার।
লাঞ্চ আওয়ারে গেস্টদের নিয়ে নিজেদের লাউঞ্জে লাঞ্চে গেলেন বসরা, রয়ে গেল শুধু মিড লেভেল এমপ্লয়ীরাই। আর ফাঁকা হওয়ার সাথে সাথেই ওর পাশের ফাঁকা সিটে প্রায় ঝাঁপ দিয়ে এসে বসে পড়ল আফসানা, “কী ব্যাপার?”
চোখ নাচাল উদয়। প্রচণ্ড রাগ উঠে যাওয়ার কথা ছিল এখন তার।
কিন্তু কেন জানি রাগটা সেই ভাবে উঠছে না। বরং হাসি পাচ্ছে।
পালটা প্রশ্ন করল, “কীসের কী ব্যাপার?”
উদয় মনে মনে ভালো করেই জানে আফসানা কী জানতে চাইছে! লাস্ট দুই মাসের এন্ট্রি নিজের হাতেই মুছে দিয়েছিল সে।
তাহলে এখন উদয় প্রেজেন্টেশন করল কী করে?
কিন্তু এখানে অফিসের একদম বিগিনার লেভেলের এমপ্লয়ী ছাড়া প্রায় সবাই উপস্থিত, ওরা এখনো বড় হল রুমটাতেই আছে। বস টাকা দিয়ে পিয়নকে পাঠিয়েছেন লাঞ্চ আনতে, আজকে সেলিব্রেশন হবে।
লাঞ্চের জন্য অপেক্ষা করছে সবাই। এখন এত মানুষের সামনে আফসানা তো আর জিজ্ঞেস করতে পারে না, “আমি নিজের হাতেই যা যা ডিলিট করলাম সব তুমি আবার ফেরত পেয়ে গেলে কী করে?”
উদয় তাকিয়ে আছে ওর দিকে। হাসছে মিটি মিটি।
“তোমার গায়ে কীসের স্মেল এটা?”
উদয়ের কাছে এসে বুক ভরে শ্বাস নিলো আফসানা, “তুমি মেয়েদের পারফিউম ইউজ করা শুরু করলা কবে থেকে?’
“এখন এত কথা বলতেছ যে আমার সাথে? কালকে তো চিনতেই পারছিলে না!”
“তুমি আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও!”
উদয়ের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। কেন যেন ওর ইচ্ছে হলো আফসানাকে আরেকটু খেপাতে, খেপিয়ে আগুন করে তুলতে।
“এই সহজ জিনিস বুঝতে আবার প্রশ্ন করা লাগে? কালকে বউয়ের সাথে ছিলাম!”
“বউ? হোয়াট দ্যা হেল!”
“কেন তুমি শুনলা না সেদিন, হসপিটালে? আসলে এত তাড়াতাড়ি এখনই কাউকে বলতে চাই নাই! বললেই তো ট্রিট দিতে হবে!”
“মেয়েটা কে?” থমথমে মুখে জিজ্ঞেস করল আফসানা।
“আমার ছোট বেলার ফ্রেণ্ড! মানে গার্ল ফ্রেণ্ড আর কী! আর…”
আফসানার কাছাকাছি ঝুঁকে এসে ষড়যন্ত্রীদের মত গলা নামিয়ে বলল উদয়, “যে সব টেবিল গ্রাফ আর স্লাইড প্রেজেন্টেশন তুমি ডিলিট করে দিয়েছিলে, সেগুলি আমার বউই নতুন করে বানায়ে দিছে আবার! গত কাল রাতে আমি বাসায় ছিলাম না, প্রেজেন্টেশন বানানোর জন্য আমরা এক সাথেই ছিলাম! আমার নিজের পারফিউম ছিল না, তাই সকাল বেলায় গোসল করে ওর পারফিউম দিয়েই চলে আসলাম!”
রাগে টকটকে লাল হয়ে উঠতে শুরু করল আফসানার মুখ, দ্রুততর হচ্ছে শ্বাস প্রশ্বাসের গতি। “তো কখন হলো এই সব?”
“আগে থেকেই ছিল! বললাম না আমার ছোট বেলার ফ্রেণ্ড, মানে গার্ল ফ্রেণ্ড! মাঝখানে ব্রেক আপ হয়ে গেছিল আর কী! এখন আবার প্যাচ আপ হইছে!”
“তাহলে সেদিন অস্বীকার করলা কেন?”
কাঁধ ঝাঁকাল উদয়। “আমার ইচ্ছা!”
“ওকে ফাইন!” আচমকাই দাঁড়িয়ে পড়ল আফসানা, “লেডিজ এণ্ড জেন্টলমেন! আপনারা কি জানেন কালকে গতকাল উদয়ের সেন্সলেস হয়ে পড়ার রহস্য কী? হি হ্যাজ গট ম্যারেড! লেটস হ্যাভ আ বিগ হ্যাণ্ড ফর হিম!”
উদয় তাড়াতাড়ি টেনে নামানোর চেষ্টা করতে লাগল ওকে, “হেই হোয়াট আর ইউ ডুইং? হ্যাভ ইউ গট ইনসেইন?”
কিন্তু উদয়ের কাছাকাছি থাকা কয়েকজন ইতোমধ্যেই শুনে ফেলেছে কথাটা। ডিপার্টমেন্টের কয়েকজন উঠে উদয়ের কাছাকাছি এসে ওকে ঘিরে ধরে বলল, “ওহ তাই নাকি? কংগ্র্যাটস! তো আমরা ট্রিট পাচ্ছি কবে? দাওয়াত টাওয়াত কিছুই তো পেলাম না!”
“দূর দূর, যত সব আজে বাজে কথা!”
“আহা, এত লজ্জা পাচ্ছ কেন?” হাসছে আফসানা।
“কিছু হলে তো প্রোগ্রাম হবেই, আর দাওয়াতও দিব সবাইকে। কিন্তু সত্যিই বলছি এমন কিছুই হয় নাই!”
“যা হইছে সেটাই বলে দাও সবাইকে!”
উদয় রেগে মেগে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ঠিক সেই সময় ওর ফোন বেজে ওঠায় চুপ করে গেল। প্রায় একই সময় লাঞ্চের প্যাকেট নিয়ে ক্যাফেটেরিয়ার স্টাফরা এসে ঢোকায় সবাই চলে গেল যার যার সিটে।
উদয় পকেট থেকে ফোন বের করে স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখল জিনিয়ার কল। অন্য দিকে আফসানাও তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
কিছুটা বিরক্তি, কিছুটা মেজাজ খারাপ হলেও জিনিয়ার যেহেতু কোনো দোষ নেই, উলটো গত কাল প্রায় সারা রাত অনেক এফোর্ট দিয়ে সাহায্য করেছে তাকে তাই সামান্য ধন্যবাদ হলেও তার প্রাপ্য, এমন ভাবনা থেকেই ফোন রিসিভ করে কানে ঠেকাল উদয়।
“হ্যাঁ বল কী বলবি!”
থমকে গেল জিনিয়া। সকালের আন্তরিকতার লেশমাত্রও নেই উদয়ের গলায়।
মনে হচ্ছে যেন বিরক্তি ঝরে ঝরে পড়ছে।
“কী হইছে তোর? এনিথিং রঙ? প্রেজেন্টেশন ভালো হয় নাই?”
“আরে না না ওই রকম কিছু না। ভালো হইছে। বুঝিস না কত রকম পেইন থাকে অফিসে!”
শেষ কথাটা আফসানার দিকে তাকিয়ে বলা। আফসানা ঝটকা দিয়ে উল্টো ঘুরে গট গট করে চলে গেল নিজের সিটে।
“ওহ আচ্ছা তাই! আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম! তাহলে ট্রিট পাচ্ছি কখন?”
“হ্যাঁ ট্রিট তো তুই ডিজার্ভ করিসই! এত কষ্ট করলি আমার জন্য! আজকেই চলে আয়, পেণ্ডিং রাখব না!”
“সত্যিই? কয়টায় আসব বল?”
“অফিস তো শেষ পাঁচটায়, সব ক্লোজ করে বের হতে হতে সাড়ে পাঁচটা বেজেই যায়। কাছাকাছি এসে মিস কল দিলেই হবে।“
“ওকে ইয়ার আমি লাঞ্চ করে লাইব্রেরিতে বসি তাহলে। চলে আসব সাড়ে পাঁচটায়!”
“দেখা হবে!”
লাঞ্চ শেষ করে নিজের রুমে ফিরে নিজের কিউবিকলে বসে রুমের বাকি সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে জোরে জোরে বলল উদয়, “ভাবতেছি ডেস্কটপে স্ট্রং পাসওয়ার্ড দিয়ে রাখব, ইদানিং কী সব উলটাপালটা হচ্ছে! আমার কম্পিউটার কে জানি হাতাহাতি করে রেখে গেছে কালকে, কেমন কেমন জানি লাগে! অনেক কিছুই পাই না!”
উদয় এত জোরে জোরে বলল কথাগুলো, কাছাকাছি থাকা প্রায় সবাইই শুনতে পেল। পুরোটাই কানে গেল আফসানার, রাগে ফুঁসতে লাগল সে।
কিন্তু চুপ করে রইল সে। কিছু বলতে গেলেই ধরা খেতে হবে।
কথাগুলো শুনলেন ইমতিয়াজ ভাইও। কানে এলো পিয়ন আক্কাস আলীরও, কিন্তু কিছু বলতে চেয়েও উদয়ের চোখের ইশারায় চুপ করে গেল সে।
উদয় কাউকে বিপদে ফেলতে চায় না বলেই কোনো অভিযোগ তুলতে চাচ্ছে না, কিন্তু একদম হালকা হলেও সতর্কীকরণ দেওয়াটা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল যেন ভবিষ্যতে এরকম কোনো কাজ করবার আগে দ্বিতীয় বার চিন্তা করে।
অফিস ছুটির পর গেটের বাগান বিলাসের কাছে এসে দাঁড়াল উদয়, মিসড কল এলে পকেট থেকে ফোন বের করে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বের হয়ে গেল সে। ঠিক কী কারণে জানা নেই আফসানাও ফলো করল ওকে, দেখল একটু দূরেই পার্ক করে রাখা গাড়িতে উঠে গেল উদয়, যে গাড়িতে আগে থেকেই বসে ছিল জিনিয়া।
গরম তাওয়ায় তেল পড়লে যেমন ছ্যাঁত করে ওঠে তেমনি করেই রাগে জ্বলে উঠল মাথাটা। নাহ, ওকে একটা শিক্ষা না দিতে পারলে হচ্ছে না!
কিন্তু কীভাবে কী করবে আফসানা?
(খেয়ালের বশে গড়িয়ে দেওয়া গল্পের বল কোন গোল পোস্টে গিয়ে ঠেকে, কে জানে?)