#আমাকে_ঘুড়ি_ভেবে_ওড়াস_না
।।৫।।
দোলনায় বসে বসে দোল খাচ্ছে জিনিয়া। দোলনাটা লোহার, সাদা রঙ করা, দুজন মানুষ বসতে পারে এতটা বড় আকৃতির।
দোলনার ওপরে একটা গদি পেতে রাখা। গদি মুড়িয়ে রাখা কাপড়টাও খুব সুন্দর।
লাল রঙের দুটো কুশনও রাখা দু পাশে। দোলনায় দোল খেতে খেতে আপন মনে গুনগুন করে গান গাইছে জিনিয়া।
গোলাপি পাড়ের হালকা রঙের একটা সুতি শাড়ি পরেছে আটপৌরেভাবে, চুলগুলো খোলা। দুহাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি বাজছে রিনি ঝিনি সুরে।
কপালে একটা বড় কালো টিপ পরে আছে। এত সুন্দর দেখাচ্ছে জিনিয়াকে যে ওর দিকে তাকাতে রীতিমত লজ্জা লাগছে আশিকের।
সময়টা বিকেল। আকাশের পশ্চিম কোণায় ছড়িয়ে আছে শেষ বিকেলের আবির রঙা মেঘ।
মৃদু মৃদু বাতাসের ঝাপটায় হালকা হালকা কাঁপছে জিনিয়ার কপালের পাশে এসে পড়া চুলের গোছা। বাতাসে ভেসে আসছে কোনো নাম না জানা ফুলের মিষ্টি সৌরভ।
“এই, তুমি এসে বসো না এখানে!” দোলনায় নিজের পাশের ফাঁকা জায়গাটা দেখিয়ে বলল জিনিয়া।
“না, আমি বসব না!”
আচ্ছা, জিনিয়া তাকে তুমি তুমি করে বলছে কেন? কি লজ্জার একটা ব্যাপার!
“আরে ওই দেখো প্লেন প্লেন!”
আচমকা দোলনা থেকে উঠে পড়ল জিনিয়া। শাড়িটা উঠে গেল সামান্য।
আশিক দেখল জিনিয়ার পায়ে একটা রূপার নূপুর পরা। ছাদের কিনারে গিয়ে দাঁড়াল জিনিয়া।
“জিনি, ছাদের এত কিনারে দাঁড়িয়েছ কেন? প্লেন দেখোনি জীবনে?”
ধমক দিয়ে বলল আশিক। নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছে জিনিয়ার ওপরে এত অধিকার সে পেল কোথায় ভেবে!
এদিকে ফিরে তাকিয়ে হাসল জিনিয়া। কোমরে আঁচল পেঁচিয়ে রাখা।
কেমন যেন গিন্নি গিন্নি লাগছে।
“এমন করে ধমকাও কেন? বউয়ের সাথে এমন করে কথা বলে কেউ? কী হয় ছাদের কিনারে দাঁড়ালে?”
বউ? কী বলছে এসব এই মেয়েটা?
মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি ওর?
“রেলিং নেই দেখতে পাচ্ছ না?”
“রেলিং নেই তো কী হয়েছে? আমি পড়ব না! এত চিন্তা করো না তো! আমার ব্যালেন্স আছে না?”
এটা কোন ছাদ? কোন বাসার?
চিনতে পারছে না আশিক। তার পরিচিত কোনো বাসার ছাদই রেলিং ছাড়া নেই।
“না, এসব পাগলামি করা যাবে না! মাঝখানে আসো! আসো বলছি!”
“আরে আসছি বাবা আসছি! চা বানাবো? চা খাবে?”
“না, চা খাবো না! তুমি আগে মাঝখানে আসো তো! তোমাকে ওই কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুক কাঁপছে আমার!”
“কেন, চা খাবে না কেন? তুমি চা খেলে আমিও তো তোমার কাপ থেকে খেতে পারি দুই চুমুক!”
“কেন, আমার কাপ থেকে খেতে হবে কেন তোমার? তুমি নিজের জন্য বানিয়ে খাও!”
“কেন তুমি জানো না আমি চা খাওয়া ছেড়ে দিচ্ছি?”
“কেন?”
“চায়ে অনেক সুগার থাকে! মোটা হয়ে যাচ্ছি দেখছ না?”
“তো চিনি ছাড়া চা খেলেই হয়!”
“মজা লাগে না চিনি ছাড়া খেতে!”
“আচ্ছা এখন মাঝখানে আসো তো!”
“আচ্ছা বাবা আসছি!”
আচমকাই বিনা নোটিশে ঘনিয়ে এলো সন্ধ্যার অন্ধকার। সূর্য যে কোন ফাঁকে ডুবে গেছে টেরই পাওয়া যায়নি তো!
আকাশটা হয়ে উঠেছে কুচকুচে কালো। পা বাড়িয়ে এদিকে আসতে গিয়ে কীভাবে যে পা ফসকে ছাদ থেকে পড়ে গেল জিনিয়া!
“আশিক…আশিক…আ-শি-ক…”
জিনিয়ার আর্ত চিৎকারে হাঁপাতে হাঁপাতে ঘুম ভেঙে গেল আশিকের। উঠে দেখল ঘামে গলা ভিজে গিয়েছে। গলা শুকিয়ে কাঠ।
ধুর এটা একটা কেমন স্বপ্ন দেখল সে? স্বপ্নটা দেখে এখনো বুক কাঁপছে তার।
ইস কত জীবন্ত ছিল স্বপ্নটা! জিনিয়ার কপালে এসে পড়া চুলের গোছা, হাতের চুড়ি, কপালের টিপ সব যেন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।
বাতাসে ভেসে আসা ফুলের সুবাসও যেন পাওয়া যাচ্ছিল পরিষ্কার। স্বপ্ন কি এতটা প্রাণবন্ত হয়?
আচ্ছা, এই স্বপ্নের কোনো অন্তর্নিহিত অর্থ আছে কি? না না তা কেন হবে?
স্বপ্নের আবার অর্থ থাকে না কি? এটা নিছকই মনের ভয় আর দুশ্চিন্তা থেকে দেখা।
আশিক প্রাণপণে বিশ্বাস করতে চাইল জিনিয়া যেখানেই আছে ভালো আছে।
গায়ের টি শার্ট খুলে আলনায় ঝুলিয়ে রাখা গামছাটা টেনে নিয়ে গলার নিচের ঘাম মুছল আশিক। মাথার কাছের টেবিলে রাখা পানির বোতল থেকে ঢক ঢক করে পানি খেয়ে বালিশের নিচ থেকে ফোনটা বের করে সময় দেখল।
রাত তিনটা বেজে সাতচল্লিশ মিনিট। পানিটা খাওয়ার পরেই খিদেটা চাগাড় দিয়ে উঠল।
এ তো মহাবিপদ হলো দেখা যাচ্ছে। এই অসময়ে ঘুম ভাঙবার কোনো অর্থ হয়?
এমনিতেই রাতে ভালো করে খেতে পারেনি। এখন খাবার কোথায় পাবে?
শেলফে রাখা বিস্কিটের কৌটা থেকে বিস্কিট বের করে দুটো বিস্কিট চিবিয়ে নিলো আশিক। ইমার্জেন্সির জন্য রাখা থাকে তার ঘরে।
তারপর বসে বসে চিন্তা করতে লাগল। কোথায় যেতে পারে মেয়েটা?
মুন্নি যতই ভাবুক তার কোনো চ্যাত ভ্যাত নাই, কথাটা আসলে সত্য না। সে নিজেও যথেষ্ট চিন্তিত জিনিয়ার ব্যাপারে।
কিন্তু আশিক একটু নিরাসক্তই থাকে সবার ব্যাপারে। আশিককে এমনিতেও খুব একটা পছন্দ করে না তেমন কেউ।
আশিকের বাবা মারা গেছে বলেই কিনা কে জানে, বরাবরই আত্মবিশ্বাস কম ছিল তার। ভার্সিটির একটা স্টাডি ট্যুরের কথা মনে পড়ে গেল আশিকের।
স্বল্প দূরত্বের একটা পথে রিকশা করে যাওয়ার কথা। সব বন্ধুরা রিকশায় উঠে গেল জোড়ায় জোড়ায়।
একা পড়ে রইল শুধু আশিক। আশিকের সাথে এক রিকশায় শেষ পর্যন্ত উঠেছিল তাদের স্যার।
শুধু ভার্সিটিতেই না, সব জায়গায় বন্ধু বান্ধব কম ছিল আশিকের। আর এমনিতেও তেমন একটা বাকপটু নয় সে।
খুব ভালো আড্ডা জমাতে পারে না। নিজের ভেতরে ডুবে থাকতেই ভালোবাসে।
ফোনটা তুলে নিয়ে ফেসবুকে ঢুকে জিনিয়ার প্রোফাইল স্ক্রল করতে লাগল আশিক। প্রোফাইল পিকচারটা দেখে বুকের ভেতরে হু হু করে উঠল আশিকের।
কোথায় যে গেল মেয়েটা! আচ্ছা, মেয়েটা রাতে খেয়েছে তো?
ইদানীং বোধহয় খুব ঘন ঘন প্রোফাইল পিকচার আর কাভার ফটো চেঞ্জ করছিল মেয়েটা।
ছবিগুলো সব সেলফি নয়। কেউ একজন ছবিগুলো তুলে দিচ্ছিল ওকে।
কে হতে পারে? ওর কোনো বয়ফ্রেণ্ড হয়েছিল কি?
আশিককে বলেনি যদিও। বয়ফ্রেণ্ড সম্পর্কে জানাবার মতো ঘনিষ্ঠতা ছিল না দুজনের মধ্যে।
তাছাড়া আশ্রিত একটা ছেলের সাথে আশ্রয়দাতার মেয়ের খুব বেশি মাখামাখি থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক।
সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হলো ডালিয়া জিনিয়া দুই বোনই খুব কম মানুষের সাথে মিশেছে। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ চেনার ক্ষমতা খুব কম তাদের।
সম্প্রতি জিনিয়ার আচার আচরণে কি তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন এসেছিল? বসে বসে ভাবতে লাগল আশিক।
মেয়েটা বোধ হয় একটু রূপ সচেতন হয়ে উঠেছিল কদিন ধরেই। চুলে রঙ করে এসেছিল কিছু দিন আগেই, সেটা নিয়ে ঝামেলা করেছিল মামা।
আর কিছু মনে পড়ছে না আশিকের। আশিক মনে মনে ঠিক করল আগামীকাল জিনিয়ার ভার্সিটিতে যাবে সে।
ডিপার্টমেন্টে গিয়ে খোঁজ খবর করবে। যদিও মামা খোঁজ করছেন অলরেডি।
কিন্তু তার মনে হয় জিনিয়ার বন্ধুরা হয়ত এমন কিছু জানতে পারে যেটা মামার পক্ষে জানা সম্ভব নয়।
ফোন হাতে নিয়ে ফেসবুকে স্ক্রল করতে করতে বসে বসে ভোর হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল আশিক। মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল ওর প্রোফাইল পিকচার, কাভার ফটোতে কমেন্টগুলো দেখে কিছু বোঝা যায় কিনা।
বাইরে থেকে ভেসে আসছে ফজরের আজান। মুয়াজ্জিন মধুর সুরে সবাইকে আহবান জানাচ্ছেন কল্যাণের পথে।
বিছানা থেকে উঠে গেল আশিক। বহু বছর পর ফজরের সময় রত হলো প্রার্থনায়।
আল্লাহ, মেয়েটাকে তুমি যেখানেই রেখো নিরাপদে রেখো, ভালো রেখো। মেয়েটার যেন বড় কোনো বিপদ না হয়।
(বিশেষ ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে পরের পর্ব পোস্ট করতে আমার দুটা দিন দেরি হতে পারে। আশা করি আপনারা ধৈর্য ধরে পাশে থাকবেন, যেভাবে এতদিন ছিলেন।)