#কখনো_মেঘ_কখনো_বৃষ্টি #পর্ব_১

0
530

#কখনো_মেঘ_কখনো_বৃষ্টি
#পর্ব_১
রুকসাত জাহান

আশিকের মেজাজ খারাপ হচ্ছে, ইদানীং রোজ রোজ অফিস যাওয়ার আগে এই এক কাহিনী। পূর্ণা বাথরুমে ঢুকে বসে আছে। একে তো উঠবে সাড়ে সাতটার পর এরপর বাথরুমে ঢুকে আরো পনেরো বিশ মিনিট নষ্ট করবে। নিজের বাসা হলে কিচেনে কিছু গরম করে খেয়ে নিতো আশিক। কিন্তু শ্বশুর বাড়িতে এখনো আশিক ঠিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। তাছাড়া কিচেনে কাজের মহিলা কাজ করছে। তাকে বলে নাস্তা করলে দেখা যাবে পূর্ণা উল্টো রাগ করেছে। আশিকের সব কিছু পূর্ণা নিজের হাতে করতে চায়, সকালে নাস্তার রুটি থেকে রাতে ঘুমানের আগে গরম দুধ, সব কিছু ও নিজে তদারকি করে।

এমনিতে পূর্ণা সবসময় ভীষন খেয়াল রাখে ওর।
কিন্তু গত কিছু দিন ধরে রোজ সকালে এমন করছে।
আবার যদি আশিক না খেয়ে বের হয়, তাহলে আরেক অশান্তি করা শুরু করে। ইদানীং রোজ সকালে দেরি করার ফলে প্রায়ই অফিসের গাড়ি মিস হচ্ছে। এরপর রিকসা বা সিএনজিতে অফিস যেতে হচ্ছে।
আশিকের অফিস মহাখালী। ফার্মগেটের কাছে পশ্চিম রাজাবাজারে স্ত্রী পূর্ণার বাবা চারতলা বিল্ডিং করেছেন। বিয়ের পর আশিক এই বাড়িতেই থাকে এখন। রোজ সকাল আটটার ভেতর নাস্তা সেরে মেইন রোডে এসে দাঁড়ায়। কলাবাগান, ধানমন্ডি বত্রিশ, আর পান্থপথ হয়ে বাকি কলিগদের তুলে গাড়ি আসে এই রোডে, আশিক গাড়িতে উঠলে ফার্মগেট হয়ে রওনা দেয় মহাখালীর দিকে।

আশিক, পূর্ণার বিয়ের সাত মাস চলছে। আগে আশিক মহাখালী আবাসিক এলাকায় অন্য অবিবাহিত কলিগের সাথে বাসা শেয়ার করে থাকতো। কিন্তু বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে উঠেছে। আসলে বলা যায় উঠতে বাধ্য হয়েছে। আশিকের শ্বশুর মারা গিয়েছেন দুইবছর আগে। শ্বশুর মারা যাওয়ার এগারো মাস আগে, এক এক্সিডেন্টে প্যারালাইজড হয়ে শাশুড়িও হুইল চেয়ারে আটকা পড়েছেন। হাঁটাচলা করতে পারেন না এখন। পূর্ণার ভাই নেই, পিঠাপিঠি ছোটবোনের নাম পল্লবী। পল্লবী এমবিবিএসে পড়ছে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে, ভীষণ ভালো ছাত্রী। পড়ালেখার সুবিধার জন্য ঢাকার ভেতর বাসা হওয়ার পরও হোস্টেলে উঠেছে। ছুটিছাটায় বাসায় আসে, অন্য সময় হলেই থাকে। পূর্ণা অবশ্য মধ্যম মানের ছাত্রী, তেজগাঁও কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স শেষ করেছে। মাস্টার্সের প্রস্তুতি নিচ্ছে এখন।

বিয়ের সময়ই এ কথা পরিষ্কার করে জানতো আশিক যে বিয়ের পর পূর্ণাদের বাড়িতেই থাকতে হবে।
পূর্ণার বাবা জয়নুল আবেদীন সাহেব তার চাচার বন্ধু ছিলেন। পূর্ণার সাথে আশিকের বিয়েটা চাচাই দেন।
যদিও ঘরজামাই হতে হবে, এই বিষয়টা চিন্তা করে আশিক শুরুতে বিয়েতে না করতে চেয়েছিলো।
কিন্তু আশিকের চাচা অন্তত একবার মেয়ের সাথে দেখা করে সিদ্ধান্ত নিতে বলেন। মা সুস্থ আর বাবা জীবিত থাকলে হয়তো পূর্ণার পরিবার আশিকের সাথে মেয়ের বিয়ের কথা চিন্তাও করতো না। নাহ, আশিক ছেলে ভালো, ঢাকা ভার্সিটিতে পড়াশোনা করেছে,
কেমিস্ট্রির ছাত্র ছিল। এখন ভালো চাকরি করছে। কিন্তু আশিক অনাথ, চাচা চাচী ছাড়া আর আপন কেউ নেই, বলার মতো পারিবারিক কোন সহায় সম্পদও নেই। পূর্ণার মা হাসনাহেনা বেগম মেয়ের জন্য ভালো পরিবারের এমন কোন ছেলেই খুঁজছিলেন যে বিয়ের পর তাদের সাথে থাকবে। শুধু মেয়ের জামাই না, পূর্ণা আর পল্লবীর অভিভাবকও হবে। তাই তিনি স্বামীর বন্ধু হাসান সাহেবকে মেয়ের জন্য একটা ভালো ছেলে দেখে দিতে বলেন। হাসান সাহেব তখন নিজের ভাতিজা আশিকের কথা জানান। আশিকের যেহেতু বাবা মা কেউ বেঁচে নেই, তাই বিয়ের পর আশিক ওনার ছেলের মতোই হবে, এমনটাই আশা করে রাজি হয় হাসনাহেনা বেগম।

কার এক্সিডেন্টে যখন বাবা মা মারা যায়, আশিক তখন সবে দশম শ্রেণির ছাত্র। এরপর বলতে গেলে চাচা চাচীর আশ্রয় আর সাহায্যে এতদূর এসেছে আশিক। চাচার দুই মেয়ে, বয়সে আশিকের কয়েক বছরের ছোট। কমবয়সী ছেলে মেয়ে একসাথে এক বাসায় রাখা ঠিক হবে না ভেবে, চাচা চাচী ওর থাকার ব্যবস্থা করেন মেসে। আশিক বুঝতো ব্যাপারটা। আর তাই সব সময় চাচাতো বোন দিশা এবং দীপ্তি থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখে চলতো। ছুটির সময় ছাড়া যখন তখন চাচার বাড়িতে খুব একটা যেতো না। তবে চাচা চাচীর প্রতি আশিক কৃতজ্ঞ, অন্তত তারা আর্থিক ভাবে তাকে কখনো কষ্টে পড়তে দেননি। এই স্বার্থপর দুনিয়ায় এটুকুই বা কয়জন করে! তাছাড়া চাচা চাচী হিসেবে যতটুকু স্নেহ করা দরকার, তাও তারা দিয়েছেন। তাই সেই চাচা যখন নিজের বন্ধুর মেয়ের সাথে আশিকের বিয়ে দিতে চান, আশিক সরাসরি না করতে পারে না।

সিদ্ধান্ত নেয় পূর্ণার সাথে দেখা করবে। পরে না হয় বুঝিয়ে বলবে যে সে একটা আলাদা সংসার চায়,
আশ্রিত জীবন না। নিজে একটা সংসারের চালক হতে চায় আশিক। বাবা মা মারা যাওয়ার পর যে নিঃসঙ্গতার দেয়াল ওকে ঘিরে রেখেছে, সেই দেয়াল কোন রমনীর ভালোবাসা এসে ভাঙুক, এই চাওয়া তার দীর্ঘদিনের। কিন্তু নিজেকে গড়তে এত বেশি মগ্ন ছিল যে ভার্সিটি লাইফে কখনো প্রেমে জড়ানো হয়নি তার।
প্রেম যে মনের দুয়ারে কড়া নাড়ে নি, তা নয়। তবে সসম্মানে সে তা ফিরিয়ে দিয়েছে। সে সময় শুধু নিজের পায়ে দাঁড়ানো ছাড়া আর কিছু তার মাথায় ছিল না।

চাচার ঠিক করা নির্দিষ্ট দিনে আশিক পূর্ণার সাথে দেখা করে পান্থপথের টংঘর রেস্টুরেন্টে। পান্থপথ সিগন্যালের কাছে ছোট একটা রেস্টুরেন্ট, তবে আশেপাশের স্টুডেন্ট আর ব্যাচেলরদের কাছে বেশ জনপ্রিয়, কারণ রকমারি চায়ের আয়োজন রয়েছে এখানে। জায়গাটা অবশ্য পূর্ণাই ঠিক করেছে। তবে শুরুতে আশিকের মনে হচ্ছিল খুব কোলাহলময়, বিয়ে জাতীয় আলোচনার উপযুক্ত নয়। হয়তো অচেনা ছেলের সাথে নিরিবিলি কোথাও বসতে পূর্ণার অস্বস্তি লাগছিলো, তাই এই জায়গা ঠিক করেছে। তবে কিছুক্ষণ পর এই কোলাহল, এই হৈচৈ, কিছু যেন আর আশিককে স্পর্শ করলো না। পূর্ণার সাথে কাটানো সেই চল্লিশ মিনিটে আশিক তার সিদ্ধান্ত বদল করে। এত মিষ্টি একটা মেয়েকে তো আর ফেরানো যায় না!

টলমলে চোখ, মিষ্টি হাসি, আর সুন্দর মুখে বসে থাকা একটা চাপা বিষন্নতা, সবকিছু যেন ভীষণ ভাবে টানলো আশিককে। নিজের মতো পূর্ণাকেও তার এক নিঃসঙ্গ মানুষ মনে হলো। যে মানুষের ভীরে থেকেও একা। এরপর খুব দ্রুত ছোটখাটো আয়োজনে বিয়ে হয়ে যায় তাদের। বিয়ের পর আশিক পূর্বের কথা অনুযায়ী শ্বশুর বাড়িতে থাকতে শুরু করে।

বিয়ের পরের দিনগুলো যেনো স্বপ্নের মতো কেটেছে।
এত যত্ন আর ভালোবাসা আশিক আগে কোনদিন পায়নি। আশিকের পুরনো ক্ষতগুলোর মলম হয়ে যেন জীবনে এসেছে পূর্ণা। সকালে চুড়ির রিনিঝিনি শব্দে যখন ঘুম ভাঙতো, নিজেকে পরিপূর্ণ সুখী একজন মানুষ মনে হতো আশিকের। শাড়ি পরা নারী আশিকের ভীষণ ভালো লাগে, একদিন কথায় কথায় বলেছিল পূর্ণাকে। এরপর থেকে সব ছুটির দিনে বাসায় শাড়ি পরে পূর্ণা। আশিকের প্রিয় খাবার, আয়রন করা কাপড়, সব কিছু নিজের হাতে রেডি করে পূর্ণা। আপাতদৃষ্টিতে তাদের সোনার সংসার বলা চলে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ধ্যান ভাঙে আশিকের, নাহ আর অপেক্ষা করলে আজও গাড়ি মিস হবে।
“পূর্ণা আমি গেলাম, অফিসে খেয়ে নেবো।”

পূর্ণা বাথরুম থেকে বের হওয়ার আগেই দরজা খুলে বের হয়ে যায় আশিক। পূর্ণাও সাথে সাথে বের হয়ে আসে, কিন্তু ততক্ষণে ছুটা কাজের খালা সদর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। পেছন পেছন গেট পর্যন্ত গিয়েও আশিককে পায় না পূর্ণা। পল্লবী রুমেই ছিলো। ছুটি চলছে বলে ইদানীং বাসাতেই তার বেশি থাকা হয়।পুরো ঘটনায় সে নিরব দর্শক। সে জানে এখন বাসায় ফিরে পূর্ণা তোলপাড় করে ফেলবে। হয়তো কাজের খালার কাজই চলে যাবে। গত সাত মাসে চারজন সহযোগী খালা পরিবর্তন হয়েছে। আগে ওদের একটা বাঁধা মেয়ে ছিল শেফালী। শেফালী, হাসনাহেনা বেগমের দেখাশোনা করার পাশাপাশি ঘরের টুকটাক কাজও করতো। পূর্ণার বিয়ের কিছু দিন আগে হঠাৎ শেফালীকে বাদ দেওয়া হয়েছে। পূর্ণা নাকি এখন মাস্টার্সে ভর্তি হবে না, তাই নাকি সে একাই মায়ের দেখাশোনা করতে পারবে!

পল্লবী বোঝে পূর্ণার কিছু সমস্যা হচ্ছে, তবে সচেতন ভাবেই হোক আর অবচেতন ভাবেই হোক, এর পিছনে কিছুটা হাত হয়তো হাসনাহেনা বেগমেরও আছে।
পূর্ণা উপরে উঠে এসেছে, তবে বিস্ময়কর ভাবে কোন হৈচৈ করলো না। শান্ত ভাবে রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়, এমনকি আশিককে পর্যন্ত কল দেয় না। আশিক অফিসে আসার পথে বারবার ফোন চেক করেছে, কিন্তু পূর্ণার কোন ম্যাসেজ বা কল আসেনি দেখে সে নিজেও অবাক হয়। এর আগে যে দুইদিন সে এমন হঠাৎ বের হয়েছে পূর্ণা রীতিমত ঝগড়া করেছে তার সাথে।

“কেন না খেয়ে বের হলে? কী এমন অফিসের তাড়া?
কেন অপেক্ষা করলে না?”

এমন সব বিব্রতকর প্রশ্নে আশিকের মেজাজ খারাপ করে দেয়। প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর ফোন আর ম্যাসেজের জ্বালায় অস্থির হয়ে গিয়েছিল আশিক।
শেষে বিরক্ত হয়ে ফোন বন্ধ করলে হয় আরেক বিপদ,
অফিসের রিসিপশনে বারংবার কল করতে থাকে পূর্ণা।
অফিসের কলিগরা অবশ্য তার বৌ ভাগ্যে ঈর্ষাতুর।
তারা নাকি কেউ কেউ সকালের নাস্তা টা বাইরেই সারে,
কেউ নিজে গরম করে খায়।কারও কারও স্ত্রী নিয়মিত গরম নাস্তা টেবিলে হাজির করে ঠিক, কিন্তু কোনদিন না খেয়ে আসলে এত অস্থির হয় না। নিজ হাতে স্বামীর কাপড় আয়রন করে না, না খেয়ে বসে থাকে না,
প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন করে না।

আশিক ওদের কিভাবে বোঝাবে এই ভালোবাসা এখন ওর গলার ফাঁস হয়ে গিয়েছে। আসলে পূর্ণা খুব লক্ষী একটা মেয়ে। বেশিরভাগ পুরুষ মনে মনে যেমন স্ত্রী আশা করে ঠিক তেমনই। বিয়ের পর শুরুতে তাই সে প্রচন্ড সুখী একজন মানুষ ছিল। কিন্তু যতদিন যাচ্ছে আশিকের নিজেকে খাঁচায় বন্ধী এক পাখির মতো লাগে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here