#কখনো_মেঘ_কখনো_বৃষ্টি #পর্ব_২

0
228

#কখনো_মেঘ_কখনো_বৃষ্টি
#পর্ব_২

গাড়ি চলতে শুরু করেছে। আশিক চোখ বন্ধ করে নিজের অবস্থা চিন্তা করে। পূর্ণাকে কষ্ট দিতে ভালো লাগে না ওর। কিন্তু পূর্ণাও কেন বোঝে না যে ওর এই অতিরিক্ত যত্ন, জবাবদিহিতায় আশিকের হাসফাঁস লাগে। ঠিক যেন সোনার খাঁচায় বন্দী পাখির মতো।

পরিষ্কার পানি, খাদ্য, থাকার জন্য ঝকঝকে সোনার খাঁচা, সব থাকে পাখির। থাকে না শুধু স্বাধীনতা। আশিক কী পরবে, কী খাবে, কোথায় যাবে, কতক্ষণ থাকবে সব পূর্ণা নিজে ঠিক করতে চায়। কোন কিছু তার ইচ্ছের বাইরে হলে কেমন অস্থির হয়ে যায়। বিয়ের পর পূর্ণার এইদিকটা বুঝতে সময় লেগেছিল। পূর্ণার বাসায় থাকা শুরু করলেও ঘরজামাই ধরনের অস্বস্তিতে তখনও ভুগতে শুরু করেনি আশিক। কারণ পূর্ণা অসম্ভব খেয়াল রাখতো তার, শাশুড়ি মা আদর করতেন, শালীর সাথেও সম্পর্কটা সহজ ছিল। ছুটিরদিনগুলো নিয়মিত বাইরে ঘুরতে যেত, আর চেষ্টা করতো মাসে অন্ততঃ একবার চাচার বাসায় যাওয়ার। চাচা চাচী না চাইলেও নিজের বেতনের একটা অংশ সে চাচীর হাতে দিত। একসময় এই দিনটার জন্য সে সবসময় অপেক্ষা করেছে। তাই সামর্থ হওয়ার পর সে ছেলের মতো চাচার পাশে থাকবে ঠিক করেছিল।

এখন আশিক বিবাহিত, বৌ নিয়ে যখন চাচার বাসায় যায় তারা খুশিমনে ওদের গ্রহণ করেন। পূর্ণাকে যথেষ্ট আদর দিতেন। আশিক ভাবতো পূর্ণা নিশ্চয়ই খুশি হয় যে শ্বশুর শাশুড়ি জীবিত না থাকলেও তাদের পক্ষ থেকে আদর ভালোবাসাটা চাচা শ্বশুর চাচা শাশুড়ি দিচ্ছেন। চাচাতো বোন দিশা আর দীপ্তিও ভাই ভাবিকে পেয়ে ভীষণ খুশি হতো। তবে ধীরে ধীরে আশিক বুঝতে পারে পূর্ণা ঐ বাড়িতে আর যেতে চাইছে না। যাওয়ার কথা বললেই তার মাথা ব্যথা না হয় জ্বর জ্বর লাগা শুরু হতো। এমন না যে টাকা দিতে আটকানোর জন্য এসব করছে। আশিক দেওয়ার আগেই মাসের পাঁচ তারিখের মধ্যে চাচার নাম্বারে পূর্ণা নিজে টাকা বিকাশ করে দিত। বাড়ি ভাড়ার টাকা থেকে দুইবোনকে কিছু কিছু টাকা শ্বাশুড়ি হাসনা বেগম নিয়মিত হাত খরচ হিসেবে দেন। সেই টাকা থেকেই পূর্ণা আগে আগে বিকাশ করে দেয় চাচাকে।

কয়েকমাস পর চাচা নিজেই আশিককে ফোন দিয়ে টাকা দিতে নিষেধ করে দেন। কেননা আগে ব্যাপারটা আন্তরিকতার ছিলো, কিন্তু এখন এভাবে বিকাশ করা চাচা চাচীর কাছে অস্বস্তিকর লাগতে শুরু করেছে।
ওনারা নিজেদের টাকার লোভী ভাবতে চান না।
আশিক যখন নিজে এসে টাকা দিত তখন ওকে নিজেদের ছেলে ভেবে নিতেন, এখন পূর্ণা বিকাশ করায় তা কেমন অপমান লাগে। এ নিয়ে পূর্ণা আর আশিকের প্রথম মনোমালিন্য হয়।

“পূর্ণা, চাচী তোমাকো ফোন দিয়েছিলেম?”

“হ্যাঁ।”

“কী বললেন?”

“তেমন কিছু না।”

“সেই কিছু নাই টা বা কী, তাই জানতে চাই।”

“ঐ তো ওনাদের বাসায় যেতে বললেন।”

“তুমি কী বলেছ?”

“বলেছি তুমি অফিস করে ক্লান্ত থাকো। সপ্তাহে একদিন একটু রেস্ট নাও।”

“আর কিছু বলোনি?”

“আর কী বলবো!”

“টাকার কথা কিছু বলেছ?”

“খারাপ কিছু বলিনি আশিক। বলেছি টাকার কথা ভাবতে না, আমি বিকাশ করে দেব।”

“এই কথা কেন বলতে গেলে! ওনারা কী কোনদিনও আমার কাছে টাকা পয়সা চেয়েছেন? তেমন লোভী মানুষ হলে আমার দায়দায়িত্বই নিতেন না। এই আশায় ওনারা আমাকে দেখাশোনা করেননি যে আমি ওনাদের টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করবো।”

“তা হবে কেন! কিন্তু মূলত তুমি তো এইজন্যই যেতে যেন ওনাদের হাতে টাকা দিতে পারো। তো এখন যেহেতু টাকা পৌঁছানোর বিকল্প মাধ্যম আছে, তখন ওনাদের বাসায় এত যাওয়ার কী প্রয়োজন!”

“পূর্ণা, আমি ওনাদের সাথে দেখা করতে যাই। শুধু টাকা দেওয়া উদ্দেশ্য না। তোমার ভালো না লাগলে যেও না। আমি আমার মতো যাব।”

“তা তো যাবাই। কমবয়সী সুন্দরী কাজিনদের সাথে আড্ডা দিতে ভালো লাগে।”

“মানে? দিশা আর দীপ্তির কথা বলছো? ওরা আমার ছোটোবোন। আড্ডা দিলে সমস্যা কই? ওরা তোমার সাথেও আড্ডা দেয়। দেয় না?”

“কাজিন আর বোন এক না। একটা সময় পর কাজিন, শালী, দেবর এদের সবার কাছ থেকে একটা দূরত্ব রাখতে হয়।”

আশিক বোঝে অবিবাহিত দুই চাচাতো বোন থাকায় পূর্ণা আশিককে ঐ বাসায় যেতে দিতে চায় না। কিন্তু প্রচন্ড অভিমান হয় আশিকের। পূর্ণাকে ছাড়াই সে একদিন চলে যায় চাচার বাসায়, সারাদিন সেই বাসাতেই কাটায়। কিন্তু শাশুড়ির জরুরি ফোন পেয়ে সন্ধ্যায় তড়িগড়ি করে ফিরে আসে। বাসায় এসে তার জন্য এক বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। পূর্ণা ঘুমের ঔষধ খেয়েছেিল একটি দুটি না, পুরো বিশটি। বাসার অন্য কেউ শুরুতে বুঝতে পারেনি, ভেবেছে পূর্ণা ঘুমাচ্ছে। যখন বুঝতে পারে, তখন কান্না কাটি আর হৈচৈ পড়ে যায়। এই অবস্থা দেখে পাগল পাগল লাগে আশিকের, সামান্য ব্যাপারে কেউ এমন করতে পারে, তা আশিকের ধারণারও বাহিরে। এরপর পূর্ণাকে হাসপাতালে নেওয়া, স্টোমাক ওয়াশ করা,
এসব করার ফাঁকে চাচার কানেও খবর চলে যায়।

চাচা চাচী কী বুঝলেন জানে না আশিক, তবে তারপর তারা স্পষ্টই আশিককে বাসায় আসতে নিষেধ করে দেন। এ ঘটনা মাত্র দুইমাস আগের। এরপর থেকে এত ভয় পেয়েছে আশিক, পূর্ণার মতো শান্ত মেয়ের এমন অদ্ভুত জিদের কারণ বোঝে না ও। আশিককে নিয়ে একটা অবসেশনে ভুগছে যেন পূর্ণা। পারলে আশিককে সারা দুনিয়া থেকে সে আড়াল করে রাখে। নিজের বোনের সাথেও আশিকের মেলামেশা পছন্দ করে না।
আশিক যখন চায়, পূর্ণা কাছে আসার আবদারে সাড়া দেয়। রাত দুটো বাজেও যদি যদি মনমতো কিছু খেতে চায়, পূর্ণা বানিয়ে দেবে কোন রকম বিরক্তি ছাড়া। কিন্তু আশিক যদি কলিগদের সাথে বাইরে খেতে যায়, তবেই ও পাগলামি শুরু করে। না খেয়ে থাকবে, বারবার ফোন দেবে। পূর্ণার ভালেবাসার অত্যাচারে অতিষ্ঠ এখন আশিক। এই যে একমাত্র শ্যালিকা পল্লবী, ওর সাথেও যখন তখন কথা বলতে পারে না আশিক। পূর্ণার সদা জাগ্রত চোখ ওকে বিব্রত করে রাখে।
কলেজ বন্ধ বলে পল্লবী বাসায় থাকায়, ড্রয়িং রুমে টিভিও দেখা হয় না এখন। পূর্ণা রুমেই নতুন টিভি সেট করে দিয়েছে। এমনকি পল্লবী খাওয়ার আগে বা পরে আশিকের জন্য খাবার টেবিল সাজায় পূর্ণা।

আগে রিসার্স পেপারের কাজে ঢাকার আশেপাশে ফিল্ডে গিয়ে এক দুই দিন থাকতো আশিক। এখন তাও পারে না। যত রাতই হোক ঢাকায় ব্যাক করতে হয়। না হয় সারারাত একটু পর পর ভিডিও কল করে পূর্ণা। না নিজে ঘুমায়, না আশিককে ঘুমাতে দেয়। অন্য কলিগরা বিরক্ত হয়, পরেরদিন অফিসে এসে হাসাহাসি করেন।

দুই একজন আশিকের চারিত্রিক সমস্যা আছে বলে সন্দেহ করেন, ভাবেন তাই হয়তো আশিকের বৌ এমন করে। যদিও বাকিরা সমর্থন করেন না, চারিত্রিক সমস্যা থাকলে তো তারা আগেই টের পেতেন। শ্যালিকা পল্লবীও বোনের বিষয়টা বোঝে, তাই যতক্ষন বাসায় থাকে, দুলাভাইকে এড়িয়ে চলে। এই ব্যাপারগুলো আশিকের কাছে অপমানজনক লাগে। অথচ পূর্ণার কাছে যেন এটাই স্বাভাবিক।
আজ ঝোঁকের বশে আশিক অফিসের জন্য বের তো হয়েছে, কিন্তু এখন কেমন ভয় ভয় লাগছে। কিন্তু কী করবে, ইদানীং রোজ সকালে পূর্ণা গাড়ি মিস করায়।
আশিকের ধারণা এটা পূর্ণা ইচ্ছাকৃত করায়।

পূর্ণা একটা বাঁধা কার বা সিএনজি ঠিক করতে চাইছিল আশিকের জন্য। অন্য কলিগদের সাথে একই গাড়িতে আসা যাওয়া করা ওর পছন্দ না। আর না হয় পূর্ণা চায় আশিক চাকরি ছেড়ে দিক। ওদের এই চারতলা বাড়ির অর্ধেক তো পূর্ণাই পাবে, বাবার রেখে যাওয়া ফিক্সড ডিপোজিট আছে, টুকটাক অন্য সম্পদ আছে, অযথা আশিক চাকরি করার কী দরকার, এটাই যুক্তি পূর্ণার।

এমন অযাচিত আবদারে আশিকের বিপন্ন লাগে। এখন তার মনে হয়, সেদিন বিকেলে সেই টলমলে চোখ, আর মায়াবী চেহারার প্রেমে পড়া তার ভীষণ ভুল হয়েছে। নাহ্, সে এখনো পূর্ণাকে আগের মতোই ভালোবাসে, কিন্তু পূর্ণার এই সন্দেহ প্রবণতা,এই পজেসিভ ভালোবাসা, এসবে এখন তার দমবন্ধ লাগে।
ভালোবাসা তো নির্মল বাতাসের মতো হওয়া উচিত।
ভালোবাসায় মুক্তি আর বিশ্বাস থাকতে হয়, এই সহজ জিনিসটা পূর্ণা কেন বোঝে না।

অফিসে নির্বিঘ্নে পৌঁছে হাফ ছেড়ে বাঁচে আশিক।কিছুক্ষণ পর কাজে এমন ডুবে যায় যে পূর্ণাকে নিয়ে করা দুশ্চিন্তা মন থেকে উবে যায়। তাছাড়া তেমন কিছু হলে শ্বাশুড়ি বা পল্লবী ফোন দিতো নিশ্চয়ই। সেদিনের ঘটনার পর থেকে সবাই পূর্ণাকে চোখে চোখে রাখে।মনটা একটু হালকা হয় আশিকের, হয়তো পূর্ণা ম্যাচিউর হচ্ছে সময়ের সাথে সাথে। আশিকের রুমে লারা এসেছে, জরুরি কিছু কাগজপত্র নিয়ে। লারা আর আশিক একসময় ক্লাসমেট ছিলো, সেই সূত্রে তাদের বন্ধুত্ব।

লারা এতদিন দেশের বাইরে ছিল। স্বামীর সাথে বনিবনা না হওয়ায় দেশে ফিরে এসেছে। এখানেই জয়েন করেছে। কথায় কথায় লারার দুর্ভাগ্য নিয়ে কথা বলেছিল একদিন পূর্ণার সাথে। লারার জন্য খুব সমবেদনাই দেখিয়েছিল পূর্ণা। কাজ শেষ হওয়ার পর আশিকের রুমে এক কাপ চা নিয়ে বসে লারা, তার মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করানোর ব্যাপারে আশিকের সাথে একটু পরামর্শ করতে চায়। আর তখনই ঝড়ের মতো আগমন পূর্ণার! পূর্ণাকে অফিসে দেখে আশিক ভয় পেয়ে যায়। পূর্ণা স্বাভাবিক ভাবেই লাঞ্চ বক্সটা আশিকের টেবিলে রাখে। এরপর লারার সাথে পরিচিত হয়, “আপনি নিশ্চয়ই লারা আপু?”

লারা তো আর এত কিছু জানে না, সে বন্ধু-পত্নী রূপে দেখছে পূর্ণাকে। হাসিমুখে পূর্ণার সাথে কথা বলতে থাকে লারা।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here