#আকাশেও_অল্প_নীল
#পর্বঃ০৪
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি
৯,
রেস্টুরেন্টের একই টেবিলে মুখোমুখি বসে আছে রাইমা এবং দিগন্ত। অবশ্য সাথে মাহাদ, শার্লিন আর স্নেহাও আছে। মাহাদের যার সাথে সম্পর্ক সে স্নেহা। আর স্নেহার ভাই হওয়ার সূত্রে এখানে উপস্থিত দিগন্ত। দিগন্তকে দেখে ভেতরে ভেতরে রাগ হলেও মাহাদের জন্য নিজেকে শান্ত রেখেছে রাইমা। স্নেহার সাথে আগে বার কয়েক দেখা হলেও সে কখনও দিগন্তকে স্নেহার সাথে দেখেনি। দিগন্ত নিজ মনে ফোন নিয়ে ব্যস্ত। শার্লিন পেটপুরে খেয়ে উসখুশ করছে উঠে চলে যাওয়ার জন্য। রেস্টুরেন্টেের একপাশে সুন্দর করে ডেকোরেট করা আছে। একুরিয়ামে গোল্ড ফিশগুলো দেখতে খুব সুন্দর লাগছে তার কাছে। রাইমা চামচ দিয়ে খাবার নাড়ছে, দেখছে, হুটহাট মুখেও দিচ্ছে। মূলত দিগন্তের সামনে তার খেতে অসস্তি বোধ হচ্ছে। এই ঝগরুটে লোকটার তার মুখোমুখিই বসতে হলো! আর জায়গা ছিলো না! তাছাড়া স্নেহার মতো একজন শান্ত, মিষ্টি মেয়ের ভাই এই এলোভেরার মতো তিতা আর পিছলে লোকটা! রাইমার এসব চিন্তাভাবনার মাঝেই শার্লিন রাইমার কানে ফিসফিস করে বলে,
“বইনে! আমি এখান থেকে উঠি? আমার বসে থাকতে থাকতে বিশ্বাস কর কোমড়ের অবস্থা কাহিল। তোর এভাবে মূর্তির মতো বসে থাকতে ভালো লাগলে বসে থাক। আমারে যাইতে দে।”
“থাম, আমিও যাবো তোর সাথে। ভাইয়া, ভাবীকে একা কথা বলার জন্য সুযোগ করে দিতে হবে তো!”
রাইমাও শার্লিনের মতো ফিসফিস করেই উত্তর দিলো। স্নেহা বিষয়টা খেয়াল করলো। সে ওদের উদ্দেশ্যে বললো,
” দুই বান্ধবী মিলে কি ফিসফিস করছো?”
স্নেহা আসার পরপরই শার্লিনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে মাহাদ। সেজন্য বান্ধবী কথাটা বলে স্নেহা। রাইমা কিছু বলতে মুখ খুলবে তার আগেই শার্লিন চট করে বলে,
“আপনি আর মাহাদ ভাই কাপল মানুষ। আমি আর রাই মিঙ্গেল মানুষের মাঝে হাড্ডির মতো বাঁধা হয়ে বসে আছি। বিষয়টা কেমন একটা না! আমরা বরং একটু হাঁটাহাঁটি করি। খেয়েদেয়ে পেটও ভারি হয়েছে আমাদের। তাছাড়া মিঙ্গেল মানুষদের দেখলে আমার জ্ব”লে।”
শার্লিনের কথায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় স্নেহা। মাহাদ কপাল চাপড়ে বসে। এই মেয়েকে কোন দুঃখে নিয়ে এসেছিলো রাইমা! দিগন্ত ফোন থেকে মাথা উঠিয়ে শার্লিনকে একপলক দেখে নিলো। রাইমা তো পারছেনা শার্লিনকে এখানে মুখে সেলাই করে চুপ করায়। স্নেহা শার্লিনের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে,
“জ্ব”লে বলতে? কি বললে বুঝলাম না আমি।”
“ও কিছু না ভাবী। পাগলের প্রলাপ, কানে তুলতে নেই। চল এখান থেকে। কোথায় যাবি বললি, চল ওখানে।”
রাইমা উঠে কথাটা বলেই শার্লিনের হাত ধরে টেনে তোলে। এরপর হনহনিয়ে চলে যায় ওখান থেকে। ওদের উঠে যাওয়ার কারণ আন্দাজ করতে পারে দিগন্ত। সেও কাজের অযুহাত দেখিয়ে বোনকে বলে,
“তোরা কথা বল। আমার জরুরী একটা কল করার ছিলো। কথা বলে আসছি আমি।”
দিগন্ত উত্তরের অপেক্ষা করে না। চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে যায়। মাহাদ ওরা উঠে চলে যেতেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। টেবিলের উপর হাত রেখে স্নেহার চোখে চোখ রেখে তাকায়। স্নেহা মাহাদের চাহনীতে একটু ইতস্তত বোধ করে চোখ নামিয়ে নেয়। মাহাদ মৃদু স্বরে বলে,
“আমার চোখে চোখ মিলাতেও তোমার ইতস্তত বোধ হচ্ছে আজকাল!”
“বিষয়টা তা নয় মাহাদ। তোমায় নতুন করে আর কি বলার থাকতে পারে! এবার কি আমাদের সম্পর্কের ইতি টানা উচিত নয়?”
“জাস্ট শাট আপ স্নেহা। তোমায় কিছু বলি না তার মানে এটা নয় সম্পর্কের ইতি টানতে বলবে!”
“তুমি অযথা আমার জন্য সময় নষ্ট করছো। আংকেল আন্টি তোমার সুন্দর সুখী একটা সংসার দেখতে চান। তোমার একটা দায়িত্ব আছে তোমার পরিবারের প্রতি। এবার তোমার বিয়েটা করা উচিত মাহাদ।”
“সেই ৮বছর আগে থেকে তোমায় ভালোবাসি। পড়াশোনা শেষ করলাম, চাকরিও নিলাম মোটামুটি মেনে নেওয়ার মতো। আমাদের সেইম এজ রিলেশনশিপ। না মানার কথা পরিবারের। আমার অপেক্ষায় থেকে দিনশেষে বয়স বেশি, এই কথার উপর দাড়িয়ে তোমায় ছাড়ার কথা আমার। তুমি আমাকেই ছেড়ে দিচ্ছো স্নেহা?”
১০,
স্নেহা মাথা নিচু করে বসে আছে। মাহাদের কথায় নিরুত্তর সে। মাহাদ করুণ চাহনীতে তাকায় স্নেহার দিকে। স্নেহার হাত দুটো আকড়ে ধরে বলে,
“এই হাত দুটো আকড়ে সুন্দর একটা সংসারের স্বপ্ন আমি দেখেছি স্নেহা। আমি সেই পুরুষ হতে পারবোনা, যে একবার স্বপ্ন ভেঙে ২য় বার গড়তে পারে। আমার তোমাকেই লাগবে। অন্য কাউকে নয়। প্লিস বোঝার চেষ্টা করো।”
স্নেহার চোখ দিয়ে টপটপিয়ে জল গড়িয়ে পরে মাহাদের কথায়। ছেলেটা তাকে এতোটা ভালোবাসে। অথচ সে স্বার্থপরের মতো নিজের কথা ভেবে বিয়েতে অমত জানিয়ে বিয়েটা ভাঙতে চাচ্ছে। স্নেহা এবার মুখ খোলে, বলে,
“তুমি সব সমস্যা জানো মাহাদ। আমি পারছিনা আর এই টানাপোড়েনে থাকতে। রেহাই দরকার এবার। প্লিস তুমি আমায় আটকিও না।”
“কেনো আটকাবে না আপা! তোর যে চিন্তায় বিয়েতে অমত৷ সেই চিন্তার ভার আমি নিলাম। আর আজ আমি এখানে তোদের সম্পর্কের টানাপোড়েন মিটাতে এসেছি। তুই ভাঙতে চাইবি! আর আমি ভাঙতে দিবো? এটা দিগন্ত আহসান বেঁচে থাকতে সম্ভব হবে না।”
স্নেহার কথা শেষ হতেই দিগন্ত স্নেহার পিছনে দাড়িয়ে কথাটা বলে। মাহাদের ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটে উঠে। দিগন্ত চেয়ারে বসতে বসতে ফের বলে,
“স্যরি, এখানে আসতেই আপুর কথা কানে আসলো। তাই কথাটা বললাম। মাহাদ ভাই, আপনি আগামী রবিবার আংকেল আন্টিকে নিয়ে দেখতে আসবেন। আমরা বাসাতেই কথাবার্তা ফাইনাল করবো।”
“দিগন্ত কি বলছিস এসব?”
স্নেহা অবাক নয়নে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে। দিগন্ত বোনের দিকে তাকায়। শান্ত চাহনীতে বলে,
“ভালো ভাবে বলছি চুপচাপ মেনে নে। নয়তো তুই যার কথা ভেবে পিছিয়ে যাবার চিন্তা করছিস, সাথে আমার কথাও ভেবে বিয়েটা করবিনা বলে জিদ ধরে বসে আছিস। ভাবিস আমি ছোটো আছি, আমায় আগলে রাখবে কে? আপা তুই ভুলে যাচ্ছিস আমি এখন যথেষ্ট বড়ো। তোর ভালোমন্দ দেখার মতোও উপযুক্ত আমি হয়েছি। হতে কারি তোর ছোটো। কিন্তু তোর বিষয়ে ভালোমন্দ দেখার মতো বড়ো আমি হয়েছি। আশা করি কথা ক্লিয়ার? আর কোনো কথা হবে না।”
দিগন্তের কথা বলার ভঙ্গিমায় স্নেহা বুঝে যায় দিগন্তকে আর কিছু বোঝানো যাবেনা। একদিকে আনন্দ, অন্যদিকে ভয়। দুটো মিলিয়েই স্নেহা ভেতরে ভেতরে চিন্তায় মুষরে পরে। দিগন্ত নিজের কথা শেষ করে মাহাদের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ভাইয়া! কথা এটাই রইলো? আগামী রবিবার আপনারা আসবেন ওকে?”
“ওকে লিটল ব্রো। ইনশা আল্লাহ আসবো। আমার পরিবার বা আমার দিক থেকে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তোমার সাথে তো আগে কখনও আমার সেভাবে কথাও হয়নি। আজ কি করে দেখা করার কথা ভাবলে?”
“বোন তো অনেক করলো আমার জন্য, তারও সুখ শান্তির কথা ভাবতে হয়। আজ যখন দেখলাম আপা বের হচ্ছে। জিগাসা করলাম, জানলাম এখানে আপনার সাথে দেখা করবে। তো আসতে হলো। আজ উঠি। রবিবারের জন্য অপেক্ষায় রইলাম।”
মাহাদ সম্মতি জানায় দিগন্তের কথায়। স্নেহা উঠে দাড়ায় চলে যাওয়ার জন্য। যাওয়ার আগে বলে,
“রাই আর শার্লিনকে সাথে নিয়ে যেও যাওয়ার দিন। কোথায় গেলো ওরা! বিদায়ও বলতে পারলাম না।”
“পরে ওনাদের সাথে কথা বলিস। আপাতত চল। আমার দরকারি কাজ পরে গেছে।”
১১,
দিগন্ত তাড়া দেখিয়ে স্নেহাকে নিয়ে চলে যায় । মাহাদ ওয়েটার বিল নিয়ে আসলে মাহাদ ব্যস্ত হয়ে পরে বিল মিটাতে। বিল দিয়ে উঠে দাড়াতেই লক্ষ্য করে রাইমা শার্লিনের হাত ধরে টেনে তার দিকে এগিয়ে আসছে। আর শার্লিন বাচ্চাদের মতো লাফাচ্ছে হাত ছুটিয়ে নেওয়ার জন্য। রাইমা টেবিলের কাছে আসতেই শার্লিনের হাত ছেড়ে দেয়। শার্লিন মুখ গোমড়া করে দাড়িয়ে আছে। মাহাদ জিগাসা করে,
“হলো কি পাগলিটার? এভাবে টেনে আনছিলে যে!”
“আর বলবেন না ভাইয়া। রেস্টুরেন্টের ওদিকে একুরিয়াম দিয়ে সাজানো আছে। এই শালু আলু বলে একটা গোল্ড ফিশ তুলে নিবে। বাসায় গিয়ে ভেজে খেয়ে টেস্ট করবে যে গোল্ড ফিশ খেতে টেস্ট কেমন! বাচ্চাদের মতে জিদ ধরেছে মানুষের মাঝে। এতো বড়ো মেয়ে, টেনেও আনা যায়না৷”
মাহাদ অসহায় চোখে তাকায় শার্লিনের দিকে। এ কেমন মেয়েরে বাবা। রাইমা তো কি পাগলামি করে তার থেকে বড়ো পাগল। মাহাদ হন্তদন্ত হয়ে বলে,
“তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলো। এখানে আর এক মিনিট তো মান সম্মান দফারফা করে দিবে তোমার বান্ধবী। পেয়েছিলে কোথায় একে?”
“ভাইয়া আপনিও এভাবে আমায় অপমান করলেন?”
শার্লিন থমথমে গলায় প্রশ্ন করে। রাইমা ওর হাত টেনে ধরে বলে,
“চল এখান থেকে। বাকি কথা বাসায় গিয়ে।”
তিনজনেই রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়। মাহাদের বাইকে এসেছিলো ওরা। বাইকে বসতে বসতে রাইমা জিগাসা করে,
“ভাবী তো চলে গেছে বুঝলাম। একবার আমায় জানিয়েও গেলো না!”
মাহাদ বাইক স্টার্ট দিয়ে উত্তর দেয়,
“তোমাদের খোজ করেছিলো। কিন্তু তোমাদের খবর ছিলো না। হারিয়ে গেলে তোমরা।”
“কি করবো, একজনের মন ভালো করতে সাথে আনলাম। আধপাগল করে ছেড়েছে আমায়। এর সাথে থাকলে আমি পুরো পাগল হবো।”
রাইমা কপাল চাপড়ে উত্তর দেয়। শার্লিন মুখটা ভার করে বলে,
“তোরে রেস্টুরেন্টে থাকতেই বলেছি আমি লে*সবিয়ান না। তোরে আমার সাথে রাখলে আমার অবলা জামাইয়ের কি হবে?”
“রাস্তায় যেতে যেতে আর একটা কথাও বলবিনা। মুখের একদম লাগাম নেই তোর।”
রাইমা ধম’কে কথাটা বলে। মাহাদ মনোযোগ দেয় বাইক চালানোয়। এদের কথার দিকে খেয়াল করলে নিশ্চিত এক্সি”ডেন্ট করে বসবে সে। বিয়ের আগে অন্তত সে নিজের জীবন হারাতে চায় না বা হাত পা-ও ভাঙতে চায়না। কি ভ’য়ংকর মেয়েরে বাপু। যার কপালে জুটবে তার জীবন তেজপাতা। মাহাদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। ভাগ্য করে স্নেহার মতো শান্ত বউ পাবে। স্নেহা যদি রাইমা বা শার্লিনের মতো হতো, তাহলে তার কি অবস্থা হতো? মাহাদ কল্পনাও করতে পারেনা। ঝাঁকি দিয়ে উঠে। সব চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে রাস্তায় নজর দেয়। পিছনে তো চলছে রাইমা আর শার্লিনের বকবক। চলুক, তাতে তার কান দিয়ে লাভ নেই। স্নেহাকে পাচ্ছে এই আলহামদুলিল্লাহ।
চলবে?
ভুলত্রুটি মার্জনীয়। আসসালামু আলাইকুম।