#আমাকে_ঘুড়ি_ভেবে_ওড়াস_না
।।১০।।
আশিক আসার পরে প্রথমেই নিজের স্বভাব অনুযায়ী এক চোট বকাবকি করে নিলেন মামী। যদিও বেসরকারি হাসপাতালে অনেক কিছুই তুলনামূলক সহজ, তারপরেও যে রোগীর ভর্তির প্রস্তুতি ছিল না, তাকে ডাক্তার আচমকাই হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে লিখে দিলে কিছুটা বেকায়দায় পড়তে হয় বৈকি।
আশিকের সাথে ভর্তি আর টেস্টগুলো করার প্রাথমিক প্রস্তুতি সেরে মামি বাসায় গেলেন মামার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আসতে। বাসায় গিয়ে দেখেন এলাহি কারবার।
বড় মেয়ে ডালিয়া এসে উপস্থিত। এসেই সব জিনিসপত্র নিয়ে ছড়িয়ে বসেছে।
ছুটা বুয়া জমিলা একটু দূর থেকে তাকিয়ে আছে বিরক্ত মুখে।
মাকে দেখেও তেমন কোনো ভাবান্তর হলো না ডালিয়ার। সে ঠাণ্ডা গলায় বুয়াকে বলল, “কী হলো বুয়া, দাঁড়িয়ে আছ কেন? বললাম না ব্লেণ্ডারটা পরিষ্কার করে আনতে? বাবুর জ্যুস খাওয়ার সময় হয়ে গেছে তো!”
জেসমিন বুয়ার অভিব্যক্তি দেখে বললেন, “বুয়া পারবে না। বুয়ার এখন অন্য কাজ আছে। এই বাসার কাজ শেষ করে আরো অন্য বাসায় কাজ করতে যাবে। আমি মুন্নিকে বলে দিচ্ছি।“
“মুন্নিকে আমি খিচুড়ী দেখতে বলছি।“
জেসমিন রান্না ঘরে ঢুকে দেখেন মুন্নি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফোঁস ফোঁস করছে।
“কী হইছে?”
“কিছু হয় নাই। আমি আর কাম করতাম না এই বাড়িত। আফনে ভাইজানরে ফুন কইরা দেইন আমারে আইয়া লইয়া যাইতো।“
জেসমিন নিরাবেগ গলায় বললেন, “আচ্ছা দিচ্ছি। কিন্তু হইছিল কী?”
“বড় আফা রঙ চা চাইছে। রঙ চা বানায়ে দিছি। হ্যায় কয় এর চাইতে নাকি ঘোড়ার মুত খাওন ভালা। হ্যায় কি ঘোড়ার মুত খাইয়া দেখছে নাকি?”
“জানি না খেয়ে দেখছে নাকি! এখন ভ্যাজর ভ্যাজর করিস না।“
“খালুজান কই? হ্যারে কই থইয়া আইলেন?”
“হাসপাতালে। আমি আসছি কয়েকটা দরকারি জিনিস নিতে। তুই খিচুড়ি রান্না শেষ করে ব্লেণ্ডার পরিষ্কার করে দে। তারপর এইদিকে আয়। আমার শরীর চলছে না।“
“ও আল্লা! কী হইছে খালুজানের?”
“জানি না কী হইছে! প্রেশার বাড়তি এতটুকু জানি। বাকিটা ডাক্তাররা টেস্ট করে বের করবে।“
মুন্নি কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “এই এত বড় বিপদের কতাডা আফনে আমারে এহন কইলেন? কামের ছেড়ি দেইখ্যা কি আমি মানুষ না যে আফনেরে এমন বিপদের মধ্যে থইয়া আমি যাইতাম গা?”
জেসমিন জানেন মুন্নি এমনিতেই যাবে না। দারোয়ানের সাথে তার কঠিন লেভেলের ইটিশ পিটিশ চলছে।
তাছাড়া গ্রামে ফিরে গেলেও যে তার ভাই ভাবীর সংসারে সে খুব বসে থাকতে পারবে এমনটা না। ঠিকই লাকড়ি কুড়িয়ে রান্না করতে হবে, ভাইয়ের বাসায় না করতে হলেও তাকে বিয়ে দিয়ে দেবে, নিজের সংসারে গিয়ে হলেও করতে হবে।
তার চেয়ে বরং এখানেই অনেক আরামে আছে সে। এই আরাম ছেড়ে আপাতত নড়বে না মুন্নি।
জেসমিন ক্লান্ত স্বরে বললেন, “আচ্ছা না গেলে না যাইস! এখন ভ্যাজর ভ্যাজর বন্ধ কর। এমনিতেই হাসপাতালে এক গাদা কথা বলে আসছি। এখন আর শরীর চলছে না!”
জেসমিন রান্না ঘর থেকে বের হতেই ডালিয়া বলে উঠল, “কই আম্মু ব্লেণ্ডার পরিষ্কার করছে?”
উত্তর দিলেন না জেসমিন। এই মেয়ের ধ্যান জ্ঞান এখন শুধু তার বাচ্চা।
তার বাচ্চা কী খাবে, কী পরবে, কোথায় ঘুমাবে। কই তারাও তো মা হয়েছেন, বাচ্চা নিয়ে এমন অবসেসড হয়ে যাননি।
পুরো সংসারের দায়িত্ব সামলে তবেই বাচ্চার দিকে মনোযোগ দিতে পেরেছেন। কাজের মেয়েটা পর্যন্ত জানতে চাইল খালুজান কোথায়?
অথচ ডালিয়ার মনে কি একবারও প্রশ্ন আসলো না যে তার বাবা কোথায়? ভাবতে গিয়ে জেসমিনের আচমকাই মনে হলো এই দায়ভার কি শুধু একা ডালিয়ার?
কিছুটা তাদেরও নয়ত? ভালো ছাত্রী হিসেবে তৈরি করতে গিয়ে, সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে গিয়ে, সব দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে দিয়ে তারাও কি ডালিয়াকে এরকম স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিক আর একমুখী করে ফেলেননি তো?
এতক্ষণে ডালিয়ার খেয়াল হলো বোধহয়, জিজ্ঞেস করল, “আম্মু আব্বু কোথায়? আব্বুকে কোথায় রেখে আসলে?”
জেসমিন উত্তর না দিয়ে গোসলে ঢুকে গেলেন। আজ সারা দিন থাকতে হবে হাসপাতালে, গোসল করে খেয়ে একবারে যাবেন।
গোসল সেরে বেরিয়ে জেসমিন দেখেন বাবুকে খিচুড়ি খাওয়ানো শেষ হয়েছে। মুন্নির ব্লেণ্ডার পরিষ্কার করা পছন্দ হয়নি বলে ডালিয়া নিজেই পরিষ্কার করতে লেগেছে।
জেসমিনকে দেখে বলল, “জিনিয়ার কোনো খোঁজ পাওয়া গেল?”
কথার উত্তর না দিয়ে রান্না বসাতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন জেসমিন। ডালিয়াও ব্লেণ্ডার পরিষ্কার করা শেষ করে মুন্নিকে বলল, “এই মাল্টা কেটে দে। এখন জ্যুস বানাব।“
ব্লেণ্ডার চলতে চলতেই বমি করে দিলো বাবু। ব্লেণ্ডার রেখে ছেলের কাছে দৌড়ে গেল ডালিয়া।
বমির সাথে বের হয়েছে মুরগির মাংসের একটা বড় টুকরো। দেখেই চিল চিৎকার শুরু করে দিলো ডালিয়া, “মুন্নি তোকে বলছিলাম না মাংসটা ছিঁড়ে দিবি?”
“ছিঁড়ে দিছিলাম তো, আফা!”
“তাহলে এইটা কী?” বমি থেকে মাংসের টুকরোটা তুলে মুন্নির সামনে ধরল ডালিয়া।
মুন্নি কিছু বলার আগেই জেসমিন কঠিন গলায় বললেন, “ডালিয়া তুই যা তো এই বাসা থেকে!”
“কী বলছ আম্মু? তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছ?”
“তাড়িয়ে দিচ্ছি মনে করলে তাই। যা এখন বিদায় হ।“
“জিনিয়ার কোনো খোঁজ খবর পাওয়ার আগেই চলে যাব?”
“হ্যাঁ যাবি।“
ডালিয়াকে বিদায় করে রান্না খাওয়া সেরে হাসপাতালে গিয়ে জেসমিন দেখেন আশিক বাইরে ওয়েটিং লাউঞ্জে বসে আছে শুকনো মুখে। তাকে দেখেই উঠে দাঁড়াল তড়াক করে।
দেখেও না দেখার ভান করলেন জেসমিন। ঠিক এমন সময় রিং বাজল তার ফোনে।
নাসরিন ভাবী জানালেন জিনিয়া নাকি তাদের বাসায় ছিল রাতে। মেয়ের সাহস দেখে রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে জেসমিনের।
ভাগ্যিস পুলিশ কালকে কেস নেয়নি। চব্বিশ ঘন্টা পার হওয়ার আগে নাকি কেস নেওয়ার নিয়ম নেই।
বেহায়া মেয়ে যখন এসে দাঁড়াল রাগ সামলাতে পারলেন না জেসমিন। ওর হাত ধরে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে উপস্থিত করলেন জামিল সাহেবের সামনে।
লোকটা মেয়ে মেয়ে করে মরে যাচ্ছিল একেবারে। এখন দেখুক কী কাণ্ড ঘটিয়ে এসেছে তার সাধের মেয়ে!
জামিল সাহেব তো “আমিও মেনে নিছি” বলেই খালাস, কিন্তু নিজের রাগ সামলাতে পারছিলেন না জেসমিন। রাগটা কোথায় ঝাড়বেন তাও বুঝতে পারছিলেন না।
নার্স বাইরে বের করে দেওয়ার পরে উদয়কেই জিজ্ঞেস করলেন ঝাঁঝালো গলায়, “এই যে, তুমি এখনো পড়াশোনা করছ? নাকি কাজকর্ম কিছু কর?”
থতমত খেয়ে বলল উদয়, “জি আন্টি করি! কিন্তু আন্টি আপনি আমার কথাটা শোনেন তো আগে…”
“কী আর শুনব? শোনার আর বাকি কী রাখছ তোমরা!”
আচমকাই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল উদয়ের। মূর্তিমান আতঙ্কের মতো এদিকেই এগিয়ে আসছে আফসানা।
তার গার্লফ্রেণ্ড। সকাল থেকেই তার গার্লফ্রেণ্ড আফসানা ফোন করছিল বার বার।
কথা ছিল আজকে অফিস শেষ করে কোথাও খেতে যাবে ওর সাথে। জিনিয়ার সাথে আসার পথে ফোন রিসিভ করে আফসানাকে সে জানিয়েছিল হাসপাতালে আসছে। আসার পর এই সব ডামাডোলে আর আফসানার ফোন রিসিভ করার সুযোগ হয়নি।
চোখের সামনে আফসানাকে দেখে প্রায় আঁতকে উঠল উদয়।
“তুমি, এখানে?”
“হ্যাঁ, তুমি ফোন রিসিভ করতেছিলা না দেখে আন্টিকে ফোন করে আন্টির কাছ থেকে ডিটেইলস নিয়ে চলে আসলাম। কেন, এসে কোনো অসুবিধা করলাম? তোমার পেশেন্ট কেমন আছে?”
জেসমিন তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন, “কে এই মেয়ে?”
উদয় কিছু বলার আগেই লাজুক হাসি হেসে বলল আফসানা, “আন্টি আপনি আমাকে চিনবেন না, আমি আর ও এক সাথেই কাজ করি, একই অফিসে!”
উদয়ের দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন জেসমিন, “এসবের মানেটা কী? তুমি অফিসেও একজনের সাথে লটর পটর করতেছ, আবার ভাগায়ে নিয়ে বিয়ে করছ আমার মেয়েকে, এসবের মানে?”
হাসি মুছে গেল আফসানার মুখ থেকে। “তুমি বিয়ে করে ফেলছ? মানে? কবে? কখন হলো এই সব? ও, এজন্যই তো আমাকে এভয়েড করতেছ সকাল থেকে!”
উদয় হাত তুলে বলল, “লিসেন, আই ক্যান এক্সপ্লেইন এভরিথিং!”
“আই ডোন্ট নিড এনি এক্সপ্ল্যানেশন ফ্রম ইউ! এনজয় ইওরসেলফ! গুড বাই!”
গট গট করে চলে গেল আফসানা। সেদিকে কিছু ক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিনিয়ার দিকে তাকিয়ে ডান হাতের তালুতে বাম হাত দিয়ে নিষ্ফল রাগে ঘুষি মেরে বলল উদয়, “ড্যাম!”
(পরের পর্ব পরশুদিন পোস্ট করা হবে ইন শা আল্লাহ)