#আমাকে_ঘুড়ি_ভেবে_ওড়াস_না
।।১৮।।
এখন বাজছে সকাল এগারোটা৷ মেসবাড়ী নীরব৷
ঘোর ঘোর জ্বর ভাব নিয়ে আশিক শুয়ে আছে মেসের চৌকিতে। কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছে।
মনটা অসম্ভব খারাপ হয়ে আছে। মামি এতগুলো কথা শুনিয়েছে চলে আসবার সময়।
যদিও তার জয়েনিং এর দেরি আছে আরো কিছু দিন, কিন্তু চলে আসবার কথা শুনেই মামি এমন প্রতিক্রিয়া দেখাল যে আর থাকা কোনোভাবেই সম্ভব হয়ে উঠছিল না। আর আসবার পরেই জ্বরে পড়ল আশিক।
এই মেসটা ফার্মেগেটের বিজ্ঞান কলেজ থেকে একটু ভেতরে এগিয়ে। ক্যাটকেটে নীল রঙ করা এটা একটা একতলা লম্বা বিল্ডিং৷ টিনশেড তাই গরমের দিনে প্রচণ্ড গরম লাগে, শীতের দিনে শীত। সামনে লম্বা সরু একটা প্যাসেজ৷
দু’পাশে সারি সারি ঘর৷ শেষ মাথায় চারটা টয়লেট৷
তিনটা গোসলখানা৷ সকালে লম্বা লাইন পড়ে।
একপাশে রান্নাঘর৷ প্যাসেজের দু’পাশে সারি সারি ঘর৷
নানান রকমের মানুষ এখানে থাকে৷ বিভিন্ন ধান্দায় রোজগারপাতি করে কিংবা পড়াশোনা করে।
আরো দুজনের সাথে রুম শেয়ার করে আশিক। আশিকের এক রুমমেট, নাম রাশেদ, কিছুটা পাগল কিসিমের। কোনো এক ফার্মাসিউটিক্যালসের মেডিক্যাল প্রমোশনাল অফিসার।
বিভিন্ন গিফট আইটেম তার কাছে থাকে। রাইটিং প্যাড, কলম থেকে শুরু করে টাওয়েল পর্যন্ত সব।
প্রতিদিন রাতে গভীর রাত পর্যন্ত তার বিছানা থেকে ভেসে আসে নীল আলো। বাড়িতে বউ রেখে এসেছে।
আশিকের কেন যেন মনে হয় সে যার সাথে চ্যাটিং করে সেই মেয়েটা তার বউ নয়। কেন এরকম মনে হয় আশিক জানে না।
ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে একটা ব্যাপার আছে। সেই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় হবে হয়ত।
অন্য রুমমেটটি ছাত্র, নাম মিরন। তার আবার একজন প্রেমিকা আছে।
আশিক আসবার আগে তার প্রেমিকা একদিন দেখা করতে এসেছিল এখানে। এই নিয়ে মেসে একটা তুলকালাম চলেছে।
এবং কড়াকড়ি রুল জারি হয়েছে কোনো মেয়ে মেসে আসতে পারবে না। যদি আসেও, বাইরে ওয়েটিং রুমে দেখা করবে।
ভেতর পর্যন্ত মেয়েদের প্রবেশ নিষিদ্ধ।
আশিকের দুই রুমমেট সকালে বের হয়ে গিয়েছে। একজন ক্লাসে অন্যজন অফিসে।
একা একাই শুয়ে শুয়ে জ্বরে কাঁপছে আশিক। এমন সময় একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল।
দরজা খোলাই রেখেছিল আশিক। বুয়া এসে ঘর ঝাড়ু দিয়ে মুছে যাওয়ার কথা।
যদি জ্বর বাড়ে, উঠে দরজা খুলে দেবার মতো যথেষ্ট শক্তি থাকবে না তার।
দরজা খুলে খুব স্বাভাবিকভাবে ভেতরে এসে ঢুকল জিনিয়া। দরজা ভিজিয়ে দিয়ে পা ঝুলিয়ে বসল মিরনের পড়ার টেবিলে।
রীতিমত আঁতকে উঠল আশিক। “জিনি! তুমি এখানে? এখন! ক্লাস নাই?”
জিনিয়া পা দোলাতে দোলাতে বলল, “আছে তো! গিয়েছিলাম। বারোটার ল্যাব ক্লাসটা হবে না। তিনটার টিউটোরিয়ালটা ধরব ভেবেছি। এতক্ষণ বসে থেকে কী করব, তাই ভাবলাম আপনার মেসটা দেখে যাই। কেমন আছেন কী অবস্থা, একটু খোঁজ খবর নিয়ে যাই।“
“বাসায় জানে যে তুমি এখানে এসেছ?”
“মাথা খারাপ?”
“নতুন ড্রাইভার রেখেছ?”
“না, খুঁজে পাচ্ছে না এখনো। তারপর কী খবর আপনার? এই বেলা এগারোটায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন মানে?”
“এমনিই শুয়ে আছি, ভালো লাগছিল না শরীরটা।“
“জ্বর বাধিয়েছেন নাকি?”
“না ওরকম কিছু না।‘
“কই দেখি তো!”
জিনিয়া পা দোলানো বন্ধ করে টেবিল থেকে নেমে এসে হাত রাখল আশিকের কপালে। আশিকের মনে হলো তার শ্বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে।
“এ কী! আপনার তো অনেক জ্বর! মগ বালতি কই আপনার?”
“জিনি প্লিজ, তুমি চলে যাও! তোমাকে এই ঘরে দেখলে এখনই একটা সিন ক্রিয়েট হবে…”
ঠিক এমন সময় দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল বুয়া। ঢুকে জিনিয়াকে দেখেই শুরু করল চিল চিৎকার, “আবার মাইয়া মানুষ ঢুকাইছেন?”
জিনিয়া থমথমে মুখে বলল, “আবার মানে? আপনাকে দেখতে আর কোনো মেয়ে এসেছিল নাকি?”
“না আমাকে দেখতে না, আমার রুমমেটকে দেখতে এসেছিল!”
বুয়া এগিয়ে এসে কোমরে দুই হাত রেখে বলল, “আফনে ক্যাডা?”
জিনিয়া ধমক দিয়ে বলল, “আমি যেই হই! দেখতেছেন না মানুষটা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে? একটা বালতিতে পানি আর একটা মগ এনে দেন!”
বুয়া কিছুক্ষণ চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে থেকে মগ আর বালতিভর্তি পানি এনে দিয়ে গেল। টুলে বসে আশিকের মাথায় পানি ঢালতে লাগল জিনিয়া।
আশিকের মনে হচ্ছে সে সাইবেরিয়ায় বাস করছে। জিনিয়ার হাত বরফ শীতল।
সেই শীতল হাতে সে আরো বেশি শীতল পানি ঢালছে। আশিক ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “শীত লাগে! আর লাগবে না জিনি, শীত লাগে!”
“চুপ থাকেন তো আপনি! দুই দিন হয় নাই আসছেন আর এসেই অসুখে পড়ে গেলেন? ডাক্তার দেখিয়েছেন?”
“না দেখাই নাই, উফ ঠাণ্ডা লাগে জিনি!”
“আজকেই ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাব আপনাকে, জ্বরটা কমুক!”
“তুমি বাসায় যাও, মামি বকবে জিনি!”
“যাব তো, আমি কি বলেছি যে যাব না? আপনার জ্বর কমিয়ে, ডাক্তার দেখিয়ে, ওষুধ কিনে দিয়ে তারপর যাব!”
“তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, তোমার তিনটায় ক্লাস!”
“থাকুক তিনটায় ক্লাস, আমারটা আমি বুঝব! আপনি একটু চুপ করবেন এখন?”
“তোমার সেই নায়ক কেমন আছে, উদয়?”
জিনিয়া পানি ঢালা বন্ধ করে ঝুঁকে এলো আশিকের দিকে। হাসি মুখে বলল, “কী করবেন তার খবর জেনে?”
চোখ বন্ধ করে ফেলল আশিক।
“আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, জানেন?”
আশিক চোখ খুলে তাকিয়ে বলল, “না, জানি না তো, কবে?”
“যবেই হোক, আসবেন না আপনি?”
“হ্যাঁ, আসব তো!”
“বিয়েতে তো কাজ থাকে অনেক, করবেন না সেই সব কাজ?”
“হ্যাঁ, করব!”
“সবার বাসায় বাসায় দাওয়াতের কার্ড দিতে হবে, দেবেন তো?”
“হ্যাঁ, অবশ্যই দেবো!”
জিনিয়া আবারও পানি ঢালা বন্ধ করে বলল, “আচ্ছা আপনি এত পাগল কেন আমাকে বলবেন?”
চোখ বন্ধ করে ফেলল আশিক। চোখ বন্ধ করেই অনুভব করল তার কপাল স্পর্শ করছে এক জোড়া ঠোঁট।
“আশিক ভাই, তাকান তো আমার দিকে!”
তাকাতে পারল না আশিক। তার অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে।
কারণ সে জানে এটা স্বপ্ন দৃশ্য। বাস্তব এত সুন্দর হতেই পারে না!
আর কিছু না, সে জ্বরের ঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছিল, আর এই সব কিছুই ঘটছে স্বপ্নে!
“আশিক ভাই, চোখ খুলে তাকান তো আমার দিকে!” আবার বলল জিনিয়া।
আশিক চোখ খুলে তাকাল। তার মুখের ওপর ঝুঁকে আছে সুন্দর একটি মুখ।
সেই মুখে দুষ্টু দুষ্টু হাসি।
জিনিয়া গাঢ় স্বরে বলল, “এত ভালোবাসা কোথায় লুকিয়ে রাখেন? আমাকে বলবেন?”
কিছু বলল না আশিক।
“ভালোবাসেন কিন্তু বলার সাহস নেই?”
জিনিয়ার হাত কপাল থেকে সরিয়ে দিয়ে উঠে বসল আশিক।
“তুমি চলে যাও, জিনি!”
“কেন চলে যাব আমি? ভুল কিছু বললাম?”
“আমি তোমার যোগ্য নই জিনি! আমার ফ্যামিলি নেই, ইনকাম নেই, আমি তোমাকে ভালো রাখতে পারব না! ফুল তো সবারই ভালো লাগে। কিন্তু সুন্দর ফুল তো যেখানে সেখানে ফেলে রাখা যায় না। সুন্দর ফুল রাখতে সুন্দর ফুলদানি লাগে।“
“আপনি আমার যোগ্য হয়ে আসবেন। আমি অপেক্ষা করব।“
উত্তর দিলো না আশিক।
“কী, পারবেন না?”
আশিক কাতর স্বরে বলল, “আমার যে খুব ভয় হয় জিনি!”
“ভয়ের কিছু নেই। ভয় পাবেন না। আমিও বাসায় ফিরে নিজেকে যোগ্য করার চেষ্টা করব আজ থেকে। ভালোবাসলে ভালোবাসার জন্য নিজেকে যোগ্য করতে হলে লড়তে হয়। পারবেন না আমার জন্য লড়তে?”
চুপ করে তাকিয়ে রইল আশিক। উঠে দাঁড়াল জিনিয়া।
“আমি চলি আশিক ভাই। ভালো থাকবেন। কথা হবে।“
বেরিয়ে গেল জিনিয়া। আশিক শুয়ে পড়ল কাঁথা মুড়ি দিয়ে।
জ্বরটা নামছে বুঝি। আর সেই সাথে শরীরজুড়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে ভালোবাসার নরম ছোঁয়া।
নতুন স্বপ্নের শীতল পরশে জুড়িয়ে যাচ্ছে আশিকের সবটুকু অস্তিত্ব।
(প্রিয় পাঠক ইদ মোবারক)