# মউফুল(৪)
—- মার্জিয়া হক।
মউফুলের মনে আস্তে আস্তে জমে ওঠে ভালোলাগা। দূর থেকে দেখা হয়, মন ভরে না জহিরের। দুইটা কথা না বললে জান টা শান্তি হয়! অবশেষে মউফুলের মামী সদয় হলো, একদিন কথা হলো দু’ জনের। জহির কি বলবে না বলবে দিশা পায় না। অনেক কথা বলতে চায় কিন্তু গুলিয়ে যায় সব কিছু। মউফুল বলে এত ঘন ঘন না আসতে তার লজ্জা লাগে,সবাই হাসাহাসি করে। যাবার আগে মউফুলের হাতটা ধরে ফেলে জহির, ” তুমি আমার শাবনূর আর আমি তোমার রিয়াজ ” জহিরের মাথায় খালি সিনেমার পোকা নড়ে। মউফুল অবাক হয়, এরা কারা? এই গ্রামটাই তার পৃথিবী এর বাইরে আর কিছু সে দেখেনি। জহির সিনেমার গল্প বলে,বলে শাবনূর রিয়াজের প্রেম, বিরহ, মিলনের কথা মুগ্ধ হয়ে শোনে মউফুল।
জহিরের মায়ের আর সহ্য হয়না ছেলের এই আদেখলাপনা, এত আহ্লাদ দিলে বউ তো মাথায় উঠবে। শাশুড়ি, ননদ, স্বামীকে পাত্তা দিবে?
ছেলেকে বলে ঘন ঘন বাড়ি আসলে উপার্জন কমে যাবে,বিয়ে করলে খরচ বাড়বে না? বিয়েতে তো ওই বাড়ি থেকে ফুঁটা কড়িও পাওয়া যাবে না। এরপর তিনমাস বাড়ি আসেনি জহির বুকে পাথর চাপা দিয়ে ঢাকায় থেকেছে। দিনরাত পরিশ্রম করে টাকা জমাচ্ছে। রাতে ঘরে ফিরে মউফুলের সাথে নিজেকে জড়িয়ে কত কল্পনা করে, রিয়াজ শাবনূরের জায়গায় নিজেদেরকে কল্পনা করে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে ওঠে, সেই হাসি নিয়ে ঘুমের অতলে তলিয়ে যায় জহির।
অবশেষে শেষ হয় একবছর।বিয়ের দিন ঠিক হয় মউফুল আর জহিরের। জহির ঢাকা হকার্স মার্কেট থেকে লাল টুকটুকে শাড়ি কিনেছে, সোনালী জড়ির কাজ, ম্যাচিং ব্লাউজ। মামা কানের পাশা বানিয়ে রেখেছে অনেক কষ্ট করে, আর দুই মামাও টুকটাক উপহার কিনেছে। মা মউফুলের বিয়েতে আসার অনুমতি পেয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্য্যের বিষয় মউফুলের সৎবাপ মউফুলের জন্য একটা আট আনা সোনার চেইন পাঠিয়েছে। মা জীবনে প্রথম লোকটার প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করছে। আর দুইদিন পর মউফুলের বিয়ে। বাড়িতে একটা আনন্দঘন পরিবেশ। বহুদিন পর মাকে কাছে পেয়েছে সে, মায়ের গায়ের সেই মা মা গন্ধটা যেন পালটে গেছে। নাকি পালটে গেছে মউফুল নিজেই!
বিয়ের আগের দিন গায়ে হলুদ দেয়া হলো, হাতে মেন্দী পাতা বাটা।নানী এক হাঁড়ি ক্ষীর রেঁধেছিল আর মা তেলের পিঠা বানিয়েছিল।পাড়ার মেয়েরা গীত গাইল, নাচল। একহাতা ক্ষীর আর একটা তেলের পিঠা খেয়ে চলে গেল। মউফুলকে হলুদ মাখিয়ে গোসল করানো হলো। একটা হলুদ শাড়ি পড়ানো হলো। সবাই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকল।বিয়ের ফুল ফুটলে নাকি মেয়েদের রুপ খুলে যায়। মউফুলের পাড়াতো বান্ধবীরা জহিরকে নিয়ে নানা ঠাট্টা মশকরা করতে লাগল, যা খুব একটা শালীন নয়।তার খুব লজ্জা লাগছিল।
পঞ্চাশ হাজার টাকা দেনমোহর নির্ধারণ করল মউফুলের পক্ষের মুরব্বিরা, জহিরের মা মানতে নারাজ সে দশ হাজার টাকার বেশী দেনমোহর মানবে না। বাকবিতন্ডা শুরু হয়ে গেল। জহিরের মা আর ওই পক্ষের মুরব্বিরা জেদ ধরল দশ হাজারের একটাকা বেশী দেনমোহর হলে বিয়ে হবে না। মউফুলের মুরব্বীরাও মানবে না। জহিরের মা ছেলে উঠিয়ে নিয়ে যাবে বলে হমকি দিল, মউফুলের মামাও পালটা হুমকি দিল বিয়ে দরকার হলে অন্য জায়গায় দিব।পাড়ার মুরব্বী একজন বললেন, ত্রিশ হাজার দেনমোহর কর, দুই পক্ষ মেনে নাও। এবার মা মুখ খোলার আগেই জহির হ্যাঁ বলে দিল। জহিরের মা রাগে গালাগালি শুরু করল জহিরকে। কাজিসাহেব কে জহির তাগাদা দেয় তাড়াতাড়ি বিয়ে পড়াবার জন্য। খুব টেনশনে আছে সে, এই গন্ডগোলে বিয়েটাই না ভেংগে যায়!
অবশেষে গ্রামের মুরব্বীদের মধ্যস্থতায় তিরিশ হাজার টাকা দেনমোহর নির্ধারণ হলো। বিয়ে হয়ে গেল।
বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে জহিরকে আনা হলো মউফুলের কাছে, লাল শাড়ি, কানপাশা,জহিরের আনা সিটিগোল্ডের গয়নায় মউফুল কে এত সুন্দর লাগছে যে শাবনূর, পপি,পুর্ণিমা সব ফেল। জহির হা করে তাকিয়ে থাকল মউফুলের দিকে। পাড়ার উঠতি বয়সী শালীরা খুব ঠাট্টা, মশকরা করতে লাগল। এসব কিছুই জহিরের মনে পুলক জাগিয়ে তুলতে লাগল। মউফুলের খুব লজ্জা লাগছিল আবার ভালোও লাগছিল। মানুষটা খুব সোজা সরল,খুব ভালো মানুষ।মনের মধ্যে কিছু লুকিয়ে রাখতে পারে না। মানুষটার জন্য মনের মধ্যে অদ্ভুত এক মায়া জন্ম নেয় মউফুলের মনে।
বিদায় বেলায় অনেক কান্নাকাটি করল মউফুল, ওর শাশুড়ি মুখ ভেংচি কেটে বল্ল, ” হুঁহ বিয়্যার জন্য একপা বাড়ায়্যা রাখছিল, এখন ঢং কত্তেছে”। শ্বশুরবাড়ি এলো মউফুল। দুইটা ছনেরঘর, একটাতে ওদের জন্য বাসর সাজানো অন্যটাতে ওর শ্বাশুড়ি ননদ থাকে। জহিরের ইচ্ছায় আর জেদে ঝিকমিকে জরি আর কাগজের মালা দিয়ে সাজানো হয়েছে ঘর। এসব কিছু জহির ঢাকা থেকে কিনে এনেছে। রাত বাড়লে ঘরে ঢুকল জহির। সাজানো ঘরে চৌকির উপর ঘোমটা দিয়ে বসে আছে মউফুল। জহির আস্তে আস্তে গিয়ে মউফুলের পাশে বসে ঘোমটা তোলে, লজ্জায় মউফুলের মুখ নত হয়। জহিরের মনে হয় যেন সিনেমার কোন দৃশ্য তার জীবনে ঘটছে। মউফুলের মুখটা দুই হাতে তুলে ধরে অপলক তাকিয়ে থাকে জহির। মউফুল লজ্জায় বারবার মুখ নামাতে চাইলেও নামাতে দেয়না। এবার মউফুলও তাকায় জহিরের চোখে, সেখানে দেখে তার জন্য স্বচ্ছ দিঘীর জলের মত টলটল করছে ভালোবাসা।
#মউফুল (৫)
—- মার্জিয়া হক।
সারাটা রাত জহিরের আদর সোহাগে মউফুলের অবস্থা কাহিল।জহির এমন করে ওকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে যেন হাত ছাড়লেই মউফুল হারিয়ে যাবে। ভোরের দিকে চোখটা লেগে এলো দুজনেরই। দড়জায় জোরে জোরে ধুমধাম আওয়াজে ধড়মড় করে উঠে বসল দুজনেই। শাশুড়ি সমানে গালাগালি করে দুজনের গুষ্টি উদ্ধার করছে। দরজা খোলার সাথে সাথে জহিরের মায়ের কথাগুলো যেন মউফুলের কানে আছড়ে পড়ল। রোদের চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে আসলেই অনেক বেলা হয়ে গেছে।
মউফুল জড়সড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে শাশুড়ির গালাগালি শুনতে থাকে। যা মুখে আসে তাই বলে যাচ্ছে সে, মউফুল বুঝতে পারে না কি করা উচিত। কথাগুলো তার কান দিয়ে যেন মগজে পৌঁছাচ্ছে না।” আবাগীর বেটি বাপরে খাইছিস, মায়ে ভাতার ধরছে আর এই আবাগী আমার ঘাড়ে আইসা পড়ছে”
এই কথাটা শোনার পরই জহির ঘর থেকে বের হয়ে আসে। মাকে বলে, “আইজ এই বাড়িত অর পরথম দিন অই কি জানে কি করতে অইব না অইব আর আইজকাই ক্যান অরে কাম কত্তে অইব? দুই একদিন পর তো করবই” হিস হিস করে ওঠে জহিরের মা,” হারামজাদা পোলা এল্লাগাই তরে প্যাটে ধরছিলাম? জন্ম দিসিলাম? পাইলা পুইসা বড় করছি? দুই দিনের এই বেডির লাইগা তুই আমারে কথা শোনাস?? কি পড়া খাওয়াইয়া এই মাগী তরে বশ করছে কে জানে??” ঘরের দাওয়াই বসে বিলাপ শুরু করল জহিরের মা। জহির মউফুলকে নিয়ে পুকুরে গেল গোসল করতে। মউফুল হতবিহ্বল হয়ে গেছে। পুকুর ঘাটে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে জহির এরপর আস্তে আস্তে মউফুলকে বলে, ” মনখারাপ করিস না বউ, মা যে ক্যান এত ক্ষ্যাপছে আমি জানি। আমার বিয়াতে অনেক কিছু পাওনের শখ আছিল, সেইডা পুরণ হয় নাই। এছাড়া আমার বাপে মারে খুব পিডাইতো, দাদীর ভয়ে মা কাঁটা হইয়া থাকত, তরে আমি এত ভালোবাসতাছি দেইখা মার রাগ হইতাছে। কি করি ক আমি যে তরে অনেক ভালোবাইসা ফালাইছি। তর কষ্ট আমি সয্য করতে পারুম না। ঢাকা যাইয়া থাকার একটা ব্যবস্থা কইরাই তরে আমি লইয়া যামু। মা’র উপর রাগ করিস না আমার ময়না” মউফুলের সব কষ্ট দূর হয়ে যায়, এমন একটা সোনার মতন খাঁটি মানুষ তার কপালে জুটিয়েছে আল্লাহ! তার বাপের কথা খুব মনে পড়ছে, বাপও মাকে এমনি ভালোবাসতো। বাপের আয়ু কত অল্প ছিল, একথা ভাবতেই শিউরে ওঠে মউফুল। না না জহির কে সে হারাতে পারবে না। মনে মনে তওবা পড়ে সে। নানী বলেছে কোন খারাপ কথা মনে আসলে তওবা পড়তে তাহলে দোষ কেটে যায়।
গোসল সেরে দুইজনে বাড়ি ফেরে, মা তখনও বিলাপ করছে। আশেপাশের বাড়ির চাচীরা এসে জুটেছে। জহির বড় বোনের কাছে গিয়ে বলে কি খাবার আছে তা ওদের খেতে দিতে আর মউফুলকে কি করতে হবে বলে দিতে। দুইটা করে রুটি, আলু ভাজি আর ডিম ভাজি আনে বুবু। জহির জিজ্ঞাসা করে মা খেয়েছে কি না। খায়নি শুনে জোর করে টেনে আনে। বুবু আরেক থালায় খাবার দেয়। বুবুর ছেলেটা মামীর আঁচল ধরে গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। বুবুকেও একসাথে বসতে বলে জহির। সবাই মিলে খাওয়া শেষ করে। মায়ের মুখ ভার হয়েই থাকে। আজ রাত্রে মউফুলের মামারবাড়ির লোক আসবে ফিরনীতে ওদের নিয়ে যেতে। জহির বাজার থেকে গরুর মাংস,কাতল মাছ আর মুরগী আনে। জহিরের মায়ের মেজাজ আবার খারাপ হয় কিন্তু কিছু বলে না। পাড়ার মহিলারা তাকে বুঝিয়েছে জহিরের সামনে এভাবে বউ কে গালাগালি করলে জহির না আবার রাগ করে বউ নিয়ে ঢাকা চলে যায়। তার থেকে জহির যাওয়ার পর বউকে মারুক কাটুক, যা ইচ্ছা করুক। এখন যেন শান্ত থাকে। জহিরের মায়ের নিজের জীবনের কথা মনে পড়ে। কত ছোট বয়সে বিয়ে হয়েছিল তার! মাত্র চৌদ্দ কি পনের আর জহিরের বাপের তিরিশ। তাগড়া জওয়ান মানুষ, কি শক্তিশালী! দশজন মানুষের কাজ একাই করত আবার দশজনের খাবার একাই খেতো। শাশুড়ি খুব খাটাতো ওকে, সারাদিন পর ঢুলুঢুলু চোখে যখন ঘুমাতে যেত তখন জহিরের বাপের খাঁই মিটাতে হতো। কেমন অত্যাচার মনে হতো। এরপর প্রথম মেয়ে হলো সেই নিয়ে শাশুড়ি উঠতে বসতে কথা শোনাত। জহির হওয়ার পর বুড়ির কটকটানী কমে। বাচ্চা, শাশুড়ি,স্বামী নিয়ে জেরবার হতো সে। স্বামীকে খুব ভয় পেত, পান থেকে চুন খসলে পিটাত। অত শক্তিশালী মানুষের মার সহ্য করা খুব কঠিন ছিল। মার খাওয়ার পর প্রায় মরার মত পড়ে থাকত সে। এক দুইদিন উঠতে পারত না তার মধ্যে শাশুড়ি ঠ্যাকর ঠ্যাকর কথা শোনাত। বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল অল্প বয়সে।ছোট মেয়েটা তখনও অনেক ছোট আর জহিরের বয়স বারো তের বছর, সেই সময় মাটি কাটার কাজ করতে গিয়ে বুকে ব্যাথা উঠে মরে যায় জহিরের বাপ। স্বামীসুখ কি বলে জানে না সে। স্বামী মরে যাওয়ার পর শাশুড়ি একেবারে চুপ হয়ে গেছিল, ভয় পেত জহিরের মা কে। যদি তাকে তাড়িয়ে দেয়! কিন্তু জহিরের মা তাকে তাড়ায় নি আবার খুব যত্নও করেনি। দুইটা বাচ্চা, শাশুড়ি সহ চারজন মানুষের মুখের খাবার জোগাড় করা সহজ কথা না। তার উপর বিয়ের পর থেকে বড় মেয়ের শ্বশুর বাড়ি থেকে সব সময় এটা ওটা চাইত আর না দিতে পারলে প্রায়ই বাপের বাড়ি রেখে যেত। ততদিনে একবাচ্চার মা হয়েছে মেয়ে। অনেক কষ্ট করেছে জীবনে তাই ছেলের এই আদিখ্যেতা দেখে ভীষন হিংসা হচ্ছে তার। সতের বছর বয়স থেকে জহির ঢাকায় কাজ করে মায়ের হাতে টাকা দিয়েছে। কোনদিন মায়ের মুখের উপর কথা বলে নি, অসম্মান করেনি। অমন রাগী বাপের ছেলে কেমন করে এত নরম, এত বুঝদার হলো ভেবে পায় না জহিরের মা। কিন্তু ওই আবাগীর বেটি বোধহয় আর শান্তিতে থাকতে দিবে না। কি যে পেল ছেলে ওর মধ্যে!
কাসেম চাচার সাথে জহির কয়েক বছর আছে। চাচা মানুষটার মন খুব ভালো। চাচীর জন্য, ছেলেপেলের জন্য কত ভালোবাসা মনে। জহিরকে খুব প্রভাবিত করে চাচা। ওদের বাড়িতে দেখেছে দিনরাত মার পিট অশান্তি। কেউই ভালো থাকেনি। কাসেম চাচা সব সময় বলে,” বাজান বউয়ের জায়গা আর মায়ের জায়গা আলাদা এইডা কুন সুময় মিলাইতে যাইবা না। মায়ের কথা শুইনা বউয়ের সাথে রাগ করবা না আবার বউয়ের কথা শুইনা মায়ের সাথে রাগ করবা না। দুইজনরে ভালোবাসবা, সম্মান দিবা। একটা মাইয়া সব ছাইড়া তোমার কাছে আসছে এইডা মনে রাখবা।” কথাটা মাথার মধ্যে গেঁথে নিয়েছে জহির। হয়তো আরও দুই চার বছর পর বিয়ে করত সে, কিন্তু মউফুল সব উলোটপালোট করে দিল।
রাতের রান্না বুবুই করল, মউফুল সব জোগাড় করে দিল হাতে হাতে। ছোট বোনের বিয়ে পাড়াতেই হয়েছে তাই বিকাল বিকাল সে তার স্বামী সহ চলে এসেছে। রাতে খাবার পর জহিরের মা বল্ল, যেহেতু জহির দুইদিন পর চলে যাবে, তাই মউফুল এই কয়দিন এখানেই থাক, জহির যাওয়ার সময় ওকে মামার বাড়ি রেখে যাবে,কয়দিন পর সে যেয়ে নিয়ে আসবে। মামারা সবাই চলে গেলে মউফুল বুবুর হাতে হাতে কাজ করে সব গুছিয়ে তোলে, তার সাথে কলপাড়ে গিয়ে থালাবাসন মেজে আনে। জহির অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে আছে ঘরে কিন্তু মউফুলের দেখা নাই অস্থির বোধ করে সে। সকালের ঘটনার পর ঘরে ঢুকতেই খারাপ লাগছে মউফুলের সব কাজ সারা না হলে ঘরে যাবে না সে। সব কাজ শেষে বুবু ঘরে যেতে বললে ঘরে গেল সে। জহির কতক্ষণ ওর হাতটা নিজের হাতে ধরে রাখলো। ভোর ভোর ঘুম থেকে ওঠার টেনশনে রাতে ঘুমাতেই পারলো না মউফুল। পরদিন সুর্য্য ওঠার আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়ল সে, নিজের ঘর, উঠান ঝাড় দিল। শাশুড়ি, ননদ কেউ ওঠেনি ঘুম থেকে। সুর্য্য ওঠার পর পুকুরে গিয়ে জহিরের কাপড় ধুলো,এরপর গোসল সেরে বাড়ি এলো। শাশুড়ি, ননদ জেগে গেছে ততক্ষণে। কাল রাতের খাবার বেঁচে গেছে অনেক, তা দিয়ে আজ তিন বেলা চলে যাবে। মউফুল এর মাঝে শাশুড়ির ঘর, রান্না ঘর ঝাড় দিয়ে ফেলেছে। শাশুড়ি মনে মনে খুশী হয়, অষুধ কাজ দিয়েছে। মউফুলের হাতের কাজও খুব পরিস্কার। শাশুড়ি ননদ দুইজনেই ধানকলে কাজ করে। গ্রামদেশে লোকের বাড়ি কাজ করে পোষায় না। সকালে খেয়ে কাজে গেল তারা। বুবুর বাচ্চাটা মউফুলের কাছে রেখে গেল।জহির ঘুম থেকে জেগে খেয়ে নিয়ে পাড়া ঘুরতে বের হলো। কাল বাদ পরসু ঢাকা চলে যাবে সে। চোখের পলকে চলে গেল দিন। জহির আর মউফুল মামার বাড়ি রাতটা কাটাবে ভোরে ভোরে জহির চলে যাবে ঢাকায়।
শাশুড়ি মন ভার করে থাকলো ওরা বের হবার সময়। জহির মায়ের হাতে কিছু টাকা দিলো, বিদায় নিয়ে বের হলো। বাড়ি থেকে বের হয়ে মউফুলের মনে হলো যেন একটা পাথর বুক থেকে আপাতত নেমে গেল।এ কয়দিন ভয়ে ভয়ে ছিল। কি ভুল করে! কি কথা শুনতে হয়! মামার বাড়ি পৌঁছানোর আগে পর্যন্ত সারারাস্তা বকবক করলো মউফুল। মামা, মামী,নানী, ভাইবোনেরা খুশী হলো খুব। কত যে খাওয়ার আয়োজন!! জহিরের খুব ভালো লাগছিল, নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ মনে হচ্ছিল। সারারাত দুজনেই ঘুমালো না। জহির কত যে আদর করলো মউফুলকে, বলে শেষ করা যাবে না। ভোর ছয়টায় উঠে জহির গোসল সেরে নাস্তা করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। দু’টো প্রাণ বিদায় বেলায় কাটা কবুতরের মত ছটফট করছিল। যতক্ষণ দেখা যায় পথের দিকে চেয়ে রইল মউফুল। কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে যেন। কয়দিনের সম্পর্ক দুইজনের অথচ এত আপন হয়ে গেছে যে তাকে ছাড়া দুনিয়াটা খাঁ খাঁ করছে। জহির কে বিদায় দিয়ে এসে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেল মউফুল। ঘুম ভেংগে প্রথমেই জান ধ্বক করে উঠলো,পরে মনে পড়ল ও এখন মামা বাড়ি। মামী, নানী ডাকেনি ওকে। ও পড়ার সব খবরই পৌঁছে এপাড়ায়, নতুন বউয়ের সাথে কি কি করেছে ওর শাশুড়ি সবই কানে এসেছে ওদের। মউফুল একটা কথাও বলবে না জানে ওরা, খুব শান্ত, ভালো মেয়ে সে। তিনটা দিন যেন হাওয়ায় ভেসে চলে গেল। জহিরের মা বোন নিতে এসেছে ওকে।বুকের মধ্যে দুরুদুরু হাতুড়ি পেটা শুরু হলো আবার। বিয়ের সময় শাড়ি দেয়ে হয়নি তাই শাশুড়ি আর দুই ননদকে শাড়ি, ছোট জামাইকে লুংগী কিনে দিয়েছে মামা। শাড়ি দেখে খুশী মনে হলো জহিরের মা কে। রাতে খেয়ে বাড়ি ফিরলো ওরা। মউফুল একা শুতে ভয় পাবে নাকি জিজ্ঞাসা করল শাশুড়ি। মউফুল তাড়াতাড়ি বল্ল, ভয় পাবে না। সে একাই শুতে চায়, সারারাত জহিরকে নিয়ে ভাবতে চায়। জহির ফোন করে জানিয়েছে সে ভালো ভাবে পৌঁছিয়েছে। সারারাত জেগে মউফুল জহিরকে ভাবে। শরীরের লোমে লোমে তার উপস্থিতি অনুভব করে। জহির বস্তির এক চিলতে ঘরে এক চিলতে চকিতে শুয়ে মউফুলের মুখটা চোখের পর্দায় ভাসিয়ে একসময় আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ে।
মউফুল কাজে কর্মে খুব ভালো। খুব চটপটে। তার কাজের ভুল ধরা কঠিন। সকাল সকাল বাড়িঘর ঝাড়ঝাঁটা দিয়ে ঝকঝকে করে ফেলে এরপর সকালের জন্য আটটা রুটি আর চারকাপ চা বানায়। চা দিয়ে রুটি খায় ওরা। এরমাঝে আর এক চুলায় ভাত বসায়। কোনদিন আলু,মিস্টি কুমড়া,পেঁপে ভর্তা,কিছু না কিছু ভর্তা আর ডাল দিয়ে ভাত নিয়ে যায় ওরা। এরপর কোন একটা তরকারি রাঁধে মউফুল। সব গুছিয়ে বুবুর বাচ্চা রাজ্জাক কে নিয়ে গোসলে যায়। ওকে গোসল করিয়ে ঘাটে বসিয়ে রেখে গোসল করে। বারবার খেয়াল করে।এরপর দুজনে বাড়ি ফিরে খেয়ে ঘুমাতে যায়। রাজ্জাককে গল্প বলে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে ঘুম পাড়ায়। নিজেও একটু ঘুমিয়ে নেয়। বিকালে ফারুক ঘুমিয়ে থাকতেই ঘরদোর আরেক দফা ঝাড়পোঁছ করে। খাবার গরম করে। গরমের দিন খাবার নষ্ট হয়ে যাবে। শাশুড়ি ভুল ধরার জন্য মুখিয়ে থাকে কিন্তু ধরতে পারে না। মনে মনে খুব রাগ হয় তার।
জহির বাড়ি থেকে এসেছে একসপ্তাহ হয়েছে মাত্র। কিন্তু তার মনে হচ্ছে কত দিন হয়ে গেছে মউফুল কে দেখেনি সে! মা কড়া করে বলে দিয়েছে একমাসের আগে যেন বাড়ি না যায়। কাসেম চাচা বলেছে বউকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজের কাছে আনতে তা না হলে মায়ের সাথে বউয়ের সম্পর্ক নষ্ট হবে। আর বিয়াত্তি পুরুষ একা থাকা ঠিক না,স্বভাব খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। জহিরের খুব চিন্তা হয় মা কে কিভাবে রাজী করাবে। কেন যে মায়েরা বুঝতে চায় না একটা সময় বউয়ের ভালোবাসা দরকার হয় পুরুষের। ওদের পাড়ার অনেক ছেলে মায়ের কাছে বউ রেখে এসে ঢাকায় কাজ করে। কত ছেলে বিপথে চলে যায়। মায়েরা ভয় পায় ছেলে বুঝি পর হয়ে যাবে। বউয়ের উপর অতিরিক্ত শাসন খাটাতে যেয়ে বউ শাশুড়ির সম্পর্ক নষ্ট হয়। বিয়ের পর কিছুদিন ছেলে বউকে ছাড় দিয়ে রাখলে অনেক অশান্তি থেকে বাঁচা যায়। জহির ঘর খুঁজতে থাকে, সে একমাস পর গিয়ে বউকে কাছে আনবে। মা রাগ করবে ঠিকই কিন্তু পরে ভুলেও যাবে।
(চলবে)