#মউফুল(৭) —–মার্জিয়া হক।

0
202

#মউফুল(৭)
—–মার্জিয়া হক।

প্রথম রাত মউফুলের গেল কাঁদতে কাঁদতে। এতদিনে তার মনে হচ্ছে সে শশুরবাড়ি এসেছে। নিজের গ্রামের ছবি, পায়ে চলা চিকন পথ,পাখপাখালীর ডাক,বাতাসে ভেসে বেড়ানো বিচিত্র বুনোগন্ধ,মাটির গন্ধ,পুকুরের পানির গন্ধ,চেনা মানুষগুলো, তাদের মুখ, মনের মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে। শুধু মামা,মামী,নানী, মামাতো ভাইবোনেরা নয়, রাজ্জাক,বুবু,এমনকি শাশুড়ির জন্যও বুকের মধ্যে কষ্ট হচ্ছে। কেমন হঠাৎ করে কি সব ঘটে গেল! মারার পর যখন রাজ্জাককে দেখল তখন কেমন বেকুব বনে গেছিল এরপর যখন জহিরকে দেখলো তখন তার চোখে লজ্জা,বেদনা, অস্বস্থি, সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক দৃষ্টি ফুটে উঠেছিল।

ছোট থেকে বাপ মা হারা মউফুলের মনে সবার জন্য কি এক মায়া খেলা করে। সে কি তার বাপের মনটা পেয়েছে?? অল্প দিনের ধোঁয়াশা স্মৃতি হাতরে বেড়ায় সে। বাপের উপর কি দাবী, কি জোর ছিল তার! মাকে মনে মনে ভয় পেত সে। এদিক সেদিক হলেই দুই চার ঘা পড়ত পিঠে। যে বয়সে মাকে খুব দরকার হয়,সেই বয়সে মা অন্যের ঘর সংসার সামলাত। নানী তাকে অনাদর করেনি, ভালোই বেসেছে,তা ছাড়া মামা মামী কেউ হেলা ছেদ্দা করেনি। আল্লাহ তাকে ভালোবেসেছে, না হলে জহিরের মত মানুষ কেমন কেমন করে জুটে গেল ওর কপালে।

মানুষ সব কিছুর সাথে খাপ খাওয়াতে পারে, আর তাই মউফুলেরও সময় লাগলোনা মানিয়ে নিতে। চারঘরের জন্য একটা টয়লেট, একটা বাথরুম, একটা রান্না ঘর। ভাগাভাগি করে ব্যাবহার করতে হয়। এছাড়া পানি আসে দিনে দুইবার তাই নিয়েও হুড়াহুড়ি মারামারি। নিত্য কলহ, চেঁচামেচি, লেগেই আছে। মউফুল সারাদিন বাসায় থাকে তাই সমস্যা নাই কিন্তু বাকী তিনঘরের মহিলারা সারাদিন অন্যের বাসায় কাজ করে সন্ধ্যায় ফেরে। এরপর প্রায়দিনই চুলা নিয়ে ঝগড়া, কে কার আগে রান্না করবে। খারাপ লাগে মউফুলের একবার মনে হয় হাতে হাতে একটু সাহায্য করে আবার পিছিয়ে আসে। জহির বলেছে এদের সাথে সাবধানে চলতে, সাবধানে কথা বলতে। কে কোন কথার কি মানে করে বুঝা কঠিন। মাজেদা খালাকে ভালো লাগে ওর, কত সাহস, কত পরোপকারী। এই যে ছোট ছোট হাতের কাজ গুলো দিয়ে ওকে দুই পয়সা রোজগারের সুযোগ দিয়েছে। একটা মাটির ব্যাংকে টাকা জমায় মউফুল, জহির জিজ্ঞাসা করে কি করবে সে টাকাটা দিয়ে, উত্তর দেয় না মিটিমিটি হাসে। লোকটা রাতের বেলায় গরমে হাঁসফাঁস করে, মউফুলেরও খুব গরম লাগে পাখার বাতাসে শরীর জুড়ায় না। ঘরে বাতাস ঢুকে না। একটা ছোট্ট জানালা ঘরে আর দরজা খুলে রেখে ঘুমালে সর্বনাশ। একটা ফ্যান কিনার ইচ্ছা তার।
ওরা প্রতি ঈদে বাড়ি গেছে। প্রথম যে বার বাড়ি গেল ঢাকা থেকে ,মায়ের,বুবুর শাড়ি, রাজ্জাকের জামা প্যান্ট, নানি,মামির,শাড়ি,মামার লুংগি,মামাতো ভাইবোন গুলোর কাপড় নিয়েছিল। ঢাকা নিউমার্কেটে, গাউছিয়ায়, হকার্স মার্কেটে অনেক কম দামে কাপড় পাওয়া যায়। রাজ্জাকের জন্য মউফুল একটা প্লাষ্টিকের সানগ্লাস ও কিনেছিল সাথে কেডস জুতা।প্রথম দিন মউফুল যখন গিয়ে শাশুড়িকে সালাম করল,শাশুড়ি ওকে বুকে নিয়ে কাঁদতে লাগলো। সে ভাবতেই পারেনি মউফুল এ বাড়িত ফিরবে। কাপড় পেয়ে সবচে খুশী রাজ্জাক। তখনই পরে, জুতা,সানগ্লাস পরে পাড়া বেড়াতে বের হলো। সবাই হাসতে হাসতে শেষ। আসার পথে জহির মুরগী আর পোলাও চাল এনেছিল। বুবু আর মা মহা আনন্দে রাঁধতে বসল। বিকালে ওরা নানীর বাড়ি গেল। উপহার পেয়ে সবাই খুব খুশী। যখন শুনলো মউফুল হাতের কাজ করে টাকা জমিয়ে কিনেছে তখন আরো খুশী। সত্যিই দূরে থাকলে সম্পর্ক ভালো থাকে।

কেটে গেছে পাঁচটা বছর। একটাই দুঃখ কোল আলো করে আসেনি কেউ। মিতা আপা এসেছে বস্তির উন্নয়নে কাজ করতে, সংগে আরো লোক। এতদিনে মউফুল পড়াশোনার সুযোগ পেল আর সেই সুযোগ কাজেও লাগালো। খুব তাড়াতাড়ি সে শিখে ফেলতে লাগলো। প্রথম প্রথম বস্তির মানুষ মিতা আপাদের কথায় পাত্তা কম দিচ্ছিলো আস্তে আস্তে শুনতে লাগলো। ধীরে ধীরে বস্তির নর্দমা গুলো পরিস্কার হলো। কয়েকটা ল্যাট্রিন বানিয়ে দিল আপারা, দুইটা ডিপ টিউবওয়েল বসালো,ছোটখাট অসুখ গুলো সেরে যেতে লাগলো। নিয়মিত কৃমির ওষুধ, ফলিক এসিড সরবরাহ করা হলো। শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবা পেল সবাই ,পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির আওতায় আসলো অনেকে। এইসেবা গুলো সন্ধ্যায় দেয়া হয় যাতে কর্মজীবী মানুষ সেবাগুলো পায়। মউফুলের কাছে আপার বাসার চাবি আছে, সে দুপুরে নিজের কাজ সেরে আপার বাসায় যায়,সব কাজ সেরে রান্না বসায়। বিকালে আপা এলে চা করে দেয়। দুজনে একসাথে চা বিস্কুট খায়। অনেক গল্প হয়। পড়াশোনার যেটুকু বুঝতে পারে না,আপার কাছে বুঝে নেয়। মউফুলের আগ্রহ দেখে আপা খুশী হয়। মউফুল জানতে পারে আপা খুব বড় ফ্যামিলির মেয়ে,এই বাসাটা আপার চাচার। বিয়ে হয়েছিল খুব ভালো ঘরেই কিন্তু উনার চেহারা তত ভালো নয় তাই উনার স্বামীর উনাকে পছন্দ ছিলোনা। বাবামার চাপে বিয়ে করেছিল। আপার ভালো ব্যাবহার, ভালোমানুষি দেখে উনারা বউ করে নিয়ে গিয়েছিলেন। সবাই উনাকে ভালোবাসলেও স্বামীর ভালোবাসা পাননি কখনো। আপা মনে মনে মানুষটাকে খুব ভালোবাসত। তাই যখন উনী বললেন, তার অন্য মেয়েকে পছন্দ তখন উনী চলে এসেছেন। আপার স্বামী আবার বিয়ে করে আলাদা সংসার করেন। শ্বশুর শাশুড়ি রাগ করে ছেলের সাথে সম্পর্ক রাখেন না।আপা বাকি জীবন মানুষের জন্য কাজ করবে বলে ঠিক করেছে। সবাই তাকে নিজের মত ছেড়ে দিয়েছে।মাঝে মাঝে গিয়ে বাবা মা, শ্বশুর শাশুড়ির সাথে দেখা করে আসেন। ডিভোর্স নেয় নি, দ্বিতীয় বিয়ের সম্মতি দিয়েছে। ভালোবাসার মানুষের জন্য মানুষ কত ত্যাগ করতে পারে! মউফুল জহিরকে আপা আলাদা চোখে দেখে। কত ভালোবাসা দুজনের মধ্যে, দেখে চোখ জুড়ায়।

মউফুল একদিন আপাকে বলে বাচ্চা না হবার জন্য চিকিৎসা করতে চায় সে। আপা তাকে পরিচিত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। উনী কিছু টেস্ট দেন আর জহিরেরও কিছু টেস্ট লিখে দেন। আপা সরকারি হাসপাতালে টেস্টের বন্দোবস্ত করে দেন। রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বলেছে তেমন বড় কোন সমস্যা নাই। কিছু ওষুধ দিয়েছে দুজনকেই।

এরমাঝে একদিন সন্ধ্যায় জহির ওর এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে বাসায় আসে। লোকটার নাম বসির। অল্পদিন হয় জহিরের সাথে বন্ধু পাতিয়েছে।জহির ওদের জন্য চা করতে বল্ল। মউফুল দুইকাপ চা আর বিস্কুট দিল। বসির একগ্লাস পানি চাইল। পানি নেয়ার সময় ইচ্ছা করে যে মউফুলের হাতে হাত লাগালো বুঝতে এতটুকু অসুবিধা হলো না মউফুলের। মেয়েরা জন্মগত ভাবেই এই ক্ষমতা নিয়ে জন্মায় বোধহয়। বসির মউফুলের রুপের প্রসংশা করতে লাগলো। লোকটার চোখের দৃষ্টি শকুনের মত।মনে হচ্ছিল চোখ দিয়ে যেন গিলে খাবে।জহির কিছুই বুঝতে পারছে না। বস্তির শেষে যে গুদাম আছে সেখানে নাকি সন্ধ্যার পর বসিরকে কাজ যোগাড় করে দিবে মালিককে বলে। অল্প পরিশ্রমে অনেক পয়সা। লোকটা চলে গেলে মউফুল বলে আর যেন এ বাড়িতে সে না আসে। জহির অবাক হয়,এত ভালো ব্যবহার ,এত মিষ্টি কথা,মউফুল কি বলছে এসব? বিশ্বাস হয় না তার।

দুই দিন পর দুপুরবেলায় বসির আবার হাজির। ” বাবি জয়ির বাই নাই?”
— “না বাই, হে তো এই সুমায় বাইত থাহে না, কামে আছে।”
— “ও, তো আইসাই যহন পড়ছি আপনার হাতের এককাপ চা খাইয়া যাই। আপনার হাতের চা যে সোয়াদ!”
বলে খিক খিক করে হাসতে থাকে বসির। মউফুলের গা পিত্তি জ্বলে যায়। বদমাইসটার মতলব ভালোই বুঝতে পারছে সে।ওকে বারান্দায় বসিয়ে চা বানাতে যায়। এখন দুপুর বেলায় প্রায় ঘর ই খালি। সবাই কাজে।শয়তানটা ইচ্ছা করেই এই সময় এসেছে বুঝতে পারে মউফুল। সাবধান থাকতে হবে, নিজেকে বলে সে।চা নিয়ে এসে দেখে বসির ঘরের মধ্যে ফ্যান চালিয়ে বসেছে। কিছুদিন আগেই ফ্যান কিনেছে ওরা। মউফুল লোকটার হাতে চা দিতে গেলে খপ করে হাত ধরে ফেলে বসির। মউফুল গ্রামের মেয়ে, হাত ঝটকা দিয়ে সরিয়ে নেয়, চিৎকার করে বলে” বাইর হ হারামজাদা, অখখনি বাইর হ। নাইলে তরে কুচি কুচি কইরা কাটুম” বসির বের হয়ে যেতে যেতে দাঁত চিপে বলে,” তরে আমি দেইখা নিমু। এত সাহস তর কই থাকে দেখুম”। হন হন করে বেরিয়ে যায় বসির। রাগে দুঃখে কাঁদতে থাকে মউফুল। সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে জহির দেখে ঘরে আলো নেই।লাইট জ্বালিয়ে মউফুলকে কাঁদতে দেখে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। মউফুল সব খুলে বলে তাকে। রাগে তখনই খুঁজতে যেতে চায় বসিরকে, মউফুল মানা করে, বলে তার সাথে আর যোগাযোগ না রাখতে।

মউফুল এখন বাংলা রিডিং পড়তে পারে, ছোটখাট হিসাব করতে পারে। জহিরকে উৎসাহ নিয়ে পড়ে শোনায়। ছোটতে ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়েছিল জহির। সব পড়া ভুলেই গেছিল।এখন বই দেখে আবার একটু একটু মনে পড়ছে।সেও সন্ধ্যারাতে বাড়ি ফিরে মউফুলের সাথে পড়তে বসে। সুখে দুখে কেটে যায় দিন। হঠাৎ মউফুলের মনে পড়ে বেশ কিছুদিন তার মাসিক হয় নি। উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে সে সেইদিন আপা ফিরলে জানায়। আপা পরদিন টেস্ট করার ব্যবস্থা করবে জানায় তাকে। জহিরকে আগে কিছু বলবে না, নিশ্চিত হয়ে বলবে,মনে মনে ভাবে মউফুল। আপা পরদিন একটা কাঠি এনে, একটা জায়গা দেখিয়ে বলে, এখানে সকালের প্রস্রাব দিলে যদি দুইদাগ হয় তবে বুঝা যাবে তার পেটে বাচ্চা এসেছে কিনা। উত্তেজনায় মউফুল সারারাত ঘুমাতেই পারল না। পরদিন খুব সকালে টেস্ট করে দেখে দুইদাগ। যেন উড়ে এসে ঘরে ঢোকে সে উত্তেজনায় জহিরকে ধরে ঝাঁকাতে থাকে। জহির ধড়মড় করে উঠে বসে। মউফুলের কাছে খবর শুনে যেন বেকুব বনে গেল জহির। কতক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে মউফুলকে কোলে তুলে লাফাতে লাগলো। মউফুল অনেক কষ্টে বুঝালো এরকম করলে বাচ্চার ক্ষতি হতে পারে,তবেই রেহাই পেল। আপা শুনে খুব খুশী হলো।বল্ল,ডাক্তার আপা শুক্রবার এলে যেন দেখিয়ে নেয়। আপা জিজ্ঞেস করল ছেলে না মেয়ে পছন্দ। মউফুল জানালো তাদের দুইজনেরই মেয়ের সখ। আপা বল্ল, যদি মেয়ে হয়, তোর সাথে মিলিয়ে নাম রাখবি জুঁইফুল। আপা ল্যাপটপ থেকে জুঁইফুলের ছবি দেখায়। খুব নাকি সুন্দর গন্ধ। মউফুল মনে মনে স্বপ্ন দেখতে থাকে ছোট্ট জুঁইফুলের।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here