#সুখের_খোঁজে পর্ব ৫

0
200

#সুখের_খোঁজে৫

(বড় গল্প)

পর্ব ৫

আমার রোজদিনের প্রার্থনায় আমি শুধু বলেছি, ‘হে আমার রব আপনিই ভালো জানেন, আমার জন্য কোনটি সবচেয়ে মঙ্গলময়। আপনি আমাকে জীবনের এই ঘূর্নিপাকে ফেলেছেন এবং আমি জানি এ থেকে আপনিই আমাকে উদ্ধার করবেন। আপনার কাছে আমার শুধু একটাই অনুরোধ শহীদকে আপনি ওর ভুল বোঝার তাওফিক দেন আর সে যে ভুল বুঝতে পেরেছে সেটা আমায় জানার সুযোগটুকু অন্তত দেন।’ যদি সব ঠিক থাকে তবে আর চব্বিশ ঘন্টা পরে রহমান ভাই আমাকে বলবেন আমার দোয়া কি কবুল হয়েছে কি না। পরের দিন বিকালের অন্তহীন অপেক্ষায় কাটে আমার জীবনের পরবর্তী কয়েক ঘন্টা।

রহমানের ভাইয়ের কাছে জানতে পারি শহীদের গত এক বছরের কাহিনী। শহীদ কাজের ব্যাপারে সবসময়ই খুব সিরিয়াস ছিল। অফিসে তার বেশ সুনামও ছিল এ ব্যাপারে। আমি চলে আসার পর সে বেশ কিছু বড় ধরনের ভুল করে কাজে, এমনকি কাজ ছেড়ে দেয়ার নোটিসও পায়। সেরকম কোন একদিনে রহমান ভাইকে খুলে বলে তার কাজে অদক্ষতার কারণ আর আমার প্রতি না বুঝে করা অন্যায়ের কথা। বিদেশে যারা জীবিকা নির্বাহের জন্য থাকে তারা ইচ্ছে থাকলেও দেশে আসতে পারেনা সবসময় অফিস থেকে ছুটি মঞ্জুর না হলে। আর তাই শহীদ এতোটা দিন আসতে পারেনি। মামার বাসায় নাকি ফোন করেছিল, মামারা কেউ একজন তাকে উল্টাপাল্টা কি বলেছে আর বলেছে যেন কখনো ফোন না করে; যদিও আমি তার কিছুই জানতামনা। আমার সাথে বিয়েটা তার বাসার মতের বিরুদ্ধে করায় বাড়িতেও সে কিছু জানায়নি।

পরের সপ্তাহে শহীদ দেশে এলে রহমান ভাইয়ের মধ্যস্থতায় আমাদের আবার দেখা হয়। শহীদ ক্ষমা চায় আমার কাছে। আমি অনেক ভেবে ফিরে যাই শহীদের সংসারে। আপনারা যারা এ পর্যন্ত পড়ে ভাবছেন, ‘কি দরকার ছিল ওর ঘরে ফিরে যাবার? আমিতো নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি এবং কিছুটা সফলও।’ সত্যি বলতে কি আমিও তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু জীবনের হিসাবগুলো সবসময় একই পথে চলেনা। আর জীবনটাও মোটে একদিনের না। আমার একলা দিনগুলোর সবচেয়ে কষ্ট ছিল কোথায় জানেন? দিনশেষে আমার নিজের কেউ নেই। একটা প্রিয়জন নেই যে আমার হাত ধরে বুঝে যাবে আমার মন ভালো নেই। শহীদ হয়তো সেরকম রোমান্টিক গোছের না। তবু তো আমার নিজের কেউ। যে অন্তত আমার সামনে না বুঝলেও আমার অবর্তমানে আমাকে ভেবেছে। মামারা আমাকে বাসা দিয়েছে থাকার জন্য কিন্তু একটা সময় পরে আমাকে তো ছেড়েই দিতে হবে এই আবাস। ছোট বোনটার একটা ভালো বিয়ে হয়তো আমার জন্য ভেঙেও যেতে পারে। ডিগ্রী পাস করে সেলাই মেশিন চালিয়ে একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত হয়তো আমার জীবনে চলে যাবে। কিন্তু তারপরেও যদি বেঁচে থাকি তখন কি হবে? কোন প্রিয়জন ছাড়া এই একলা পৃথিবী আমার একার জন্য কতটা বাসোপযোগী থাকবে তখন?

অনেক ভেবে শহীদকে জানাই আমি আর একেবারের জন্য দুবাই যেতে চাইনা। ডিগ্রী ভর্তি হয়েছি সেটাও জানাই। শহরে শহীদের আরেকটা বাড়ি ছিল তারই একটা ফ্লাটে শুরু হয় আমার স্বামীর সংসার নতুন করে। আমি বছরে তিনমাস যেয়ে দুবাই থাকতাম বাকী সময় ঢাকাতে। শহীদ বছরে দুবার আসতো। আর দশজন মহিলা যেভাবে প্রবাসী স্বামীর সংসার করে আমিও সেভাবেই দিন কাটিয়ে গেছি শহীদের ঘরে। আমার পরপর দুই ছেলে হয় পুলক আর পবন। তাদের বড় করা, পড়াশোনা এসব নিয়েই ব্যস্ত সময় কেটে গেছে আমার জীবনের পরের দুই দশকে। পুরোনো সেলাই মেশিনের জায়গা দখল করেছে নতুন মেশিন। লুকিয়ে সেলাইয়ের কাজ চালিয়ে গেছি অল্প বিস্তর সবসময়ই। ডিগ্রী পাসও আমি করেছি। আহামরি কোন ফলাফল না হলেও নিজের একটা যোগ্যতার সার্টিফিকেট।

শহীদের সংসারে আমার খাওয়া পরার সমস্যা ছিলনা তবু কেন লুকিয়ে সেলাই মেশিন চালিয়ে যাওয়া? সেই যে সামান্য কটা টাকার জন্য মাথায় পরে যাওয়া কাঁটা দাগ আমায় সর্বক্ষণ মন করিয়ে দিত নিজের কিছু না থাকলে শুধু স্বামী কেন যে কোন লোকেই কথা শোনানোর সাহস পায়। আর বিপদের দিনে টাকা অনেক বড় ঢাল হয়ে দাঁড়ায় সেটা আমার চেয়ে ভালো আর কে ই বা জানে? সেলাইবাবদ পাওয়া সব টাকা তাই জমা হতো আমার একটা গোপন ব্যাংক একাউন্টে বিপদের দিনে কাজে লাগবে বলে। নিত্য নতুন বিপদের মোকাবিলা করতে করতে সুখের দিনও উপভোগ আমার কখনোই করা হয়ে ওঠেনি আবারো বিপদে পরার এক চোরা আতংকে।

আমার বড় ছেলে পুলকের যেদিন চাকুরী হয় সেদিন রাতেই দুবাইতে নিজের বাসায় বিনা নোটিশে শহীদ মারা যায়। তার মৃত্যুর কিছুদিন পর একদিন উকিল আসে আমার বাড়িতে শহীদের করে যাওয়া উইল নিয়ে কথা বলতে। তার আগের ঘরের দুই ছেলেকে যা দেয়ার তা আগেই দেয়া ছিল। নতুন উইলে তার বাকী সম্পদের সিংহভাগের মালিকানা সে দিয়ে গেছে তার ছেলেদের আর আমাকে দিয়ে গেছে শুধু যে ফ্লাটটায় আমি থাকি সেটা। জীবনের এতোগুলো বছর একজনের সাথে সংসার করেও বুঝিনি আমি তার মনে আসলে তার বিশ্বাসভাজন ছিলাম না কখনোই। নিতান্তই ধর্ম মেনে যতটুকু না দিলেই নয় ততটুকুই শুধু আমার নামে দেয়া হয়েছে। আমার কথাগুলো খুব লোভী মানুষের মতো শোনাচ্ছে নিশ্চয়ই। না, আমাকে সম্পদ কম দিয়ে যাওয়ায় আমার কোন ক্ষোভ হয়নি শুধু আমি কখনো তার বিশ্বাসের যোগ্য হতে পারিনি সেটাই ছিল আমার দুঃখের কারণ। মানুষ তার একই শরীরে কত সহজে তার মুখ আর মনের আলাদা ছবি নিয়ে ঘুরে বেড়ায় রোজদিন তারই এক জীবন্ত উদাহরণ শহীদ আমায় মরে গিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেল।

শুরু হলো আমার জীবনের তৃতীয় পর্ব। ছেলেদের অধীনে শুরু হওয়া জীবন। মেয়েলোকের জীবন নাকী পুরুষ অভিভাবক ছাড়া চলেনা। শহীদের জীবিত অবস্থায় যে ছেলেরা আমার কথায় চলেছে তার মৃত্যুতে কি এক আশ্চর্য্য যাদুবলে তারাই হয়ে গেল আমার সব বিষয়ের পরামর্শদাতা। না আমার তাতে কোন আপত্তি নেই কিন্তু তাদের ব্যবহারে একটা কেমন যেন পাত্তা না দেয়ার চেষ্টা যেন বড় প্রকট ছিল বিশেষ করে ছোট ছেলে পবনের। খুব একটা পড়াশোনাও করাতে পারিনি ছোটটাকে, একটু উড়নচন্ডী স্বভাবেরই ছিল ছেলেটা ছোট থেকেই। ওদের বাবা কাছে না থাকাতে আমি আলেভোলে চালিয়ে নিয়ে গেছি শুধু। কিন্তু উইলের ব্যাপারটা প্রকাশের পর পবন তার স্বরূপে ফিরে আসে আর আমাকে বাধ্য হয়েই তার সম্পত্তির অধিকারটুকু ছেড়ে দিতে হয়। ছেলের কাছে অপমানিত হতে ইচ্ছে করেনি। সংসার চালানোর জন্য পাওয়া বাসাভাড়া এতোদিন আমার কাছে এলেও ছেলেরা উইলের সুবাদে সেই বাসাগুলোর মালিকানা পেয়ে যাওয়ায় আমার আদতে কিছুই বলার থাকেনা।

পুলক তার পছন্দে বিয়ে করতে চাইলে আমি আপত্তি করিনি। অবশ্য আমি আপত্তি করলেই সে শুনবে সেটা ভাবাটাও অবান্তর ছিল, যেখানে ওর নিজের জীবন নিজে চালানোর মতো একটা চাকুরী আর বাবার দিয়ে যাওয়া সম্পত্তিই রয়েছে বিস্তর। বরং ও আমার সাথে থাকলে অন্তত বাজার খরচটা ও চালিয়ে নেয় তাই বা কম কি?
কিন্তু না বিয়ের পরে আমার ছেলের সাথে তাও খানিক বনিবনা থাকলেও সুমনা অর্থাৎ ছেলের বৌয়ের সাথে আমার কোনভাবেই বনেনা। আমি ঘরের যত কাজই করিনা কেন কোনভাবেই সুমনাকে খুশী করতে পারিনা। আমার সব ব্যাপারেই তার কেন যে এতো অনীহা এতো রাগ আমার মাথাতেই আসেনা।

এমনকি পুলক আর সুমনার ছেলে আমার নাতি প্রকাশের জন্মের পর থেকে ওর সব যত্ন আত্তি আমি করলেও অফিস ফেরত সুমনার কাছে কোন ধন্যবাদ তো দূরের কথা বরং আমি ছেলের যত্ন করিনি সঠিকভাবে সেটাই যেন বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা থাকতো সবসময়।

একদিন বাড়ি ফিরে সুমনা দেখে তার ছেলে বারান্দার গ্রীল ধরে ঝুলছে, যদিও পুরো বারান্দাই গ্রীলে মোড়া। আমি মাত্রই নামাজের ওযু করতে গিয়েছিলাম। হয়তো মিনিট পাঁচেক প্রকাশ আমার চোখের আড়াল ছিল। এমন ও না যে ওখান থেকে পরে গেলে প্রকাশ মারাত্মক কোন ব্যথা পাবে। সেদিন রাতে পুলক বাড়ি ফিরলে সুমনা শুরু করে তার আহাজারি।

– তোমার মা, আমার ছেলের কোন যত্ন তো করেই না বরং আজকে আমি অফিস থেকে বাড়ি না এলে আজ আমার ছেলে মরেই যেতো গ্রীল থেকে পরে।

প্রত্যুত্তরে আমি কিছুই না বলে পুলকের দিকে তাকিয়ে থাকি ও কি জবাব দেয় সে আশায়। ছেলেও যখন পরিস্থিতি না বুঝে আমার পরিশ্রমটুকুর মূল্যায়ণ না করে বৌয়ের পক্ষে কথা বলে আমার মনে হয় আমার বোধহয় আবার সময় হয়েছে সেই নাখালপাড়ার মতো একলা জীবনের।

‘তোরা যখন ভাবছিস প্রকাশের ব্যাপারে আমার দায়িত্বে অবহেলা ছিল তাহলে নিশ্চয়ই আমার অবহেলা ছিল। আমি আমার দোষ মাথা পেতে নিলাম। তোরা বরং আলাদা হয়ে যা। আমি আমার বাসায় একলাই থাকতে পারবো আশা করি।’

জীবনের অনেক গুলো বছর পেরিয়ে আবার সেই একলা জীবনের শুরু। হায় জীবন, রঙ্গমঞ্চের সব চরিত্রে অভিনয় শেষ করিয়ে আবার ছেড়ে দিলে পুরোপুরি একলা আসরে। যেই একলা থাকার ভয়ে শহীদের ঘরে ফিরে আসা সেই একলা জীবন আবার ওর ঘরেই শুরু হলো। তফাত শুধু তখন কেউ আপন ছিলনা আর এখন দুটো আপন ছেলে থেকেও তারা পর।

#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস

চলবে…

পর্ব ৪

https://www.facebook.com/groups/canvasbd/permalink/2446622075382971/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here