আড়ালে_অন্তরালে #মাহমুদা_লিজা পর্বঃ১৫

0
178

#আড়ালে_অন্তরালে

#মাহমুদা_লিজা

পর্বঃ১৫

ঈষাণ কোণে সাদা তুলোর মত টু ক রো মেঘগুলো জমা হয়েছে। ফাহিম একটু বেরিয়েছে, অনেকদিন বাদে গ্রামে ফিরেছে। এদিক সেদিক বেখেয়ালি হয়ে হাটঁতে তার ভালোই লাগে। মাহতাব খানও প্রতিদিনের মত নিজের কাজে বেরিয়েছেন। ব্যবসার সব তদারকি দক্ষ হাতে করেন তিনি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণে তিনি পটু।

মির্জা মহলে এখন শুধুমাত্র আয়েশা আর মায়াই আছে। বাদবাকি তিনজন লোকের মধ্যে একজন পুরো বাড়িটা পরিষ্কার রাখে, একজন ঘরোয়া কাজে সাহায্য করে আর অন্যজন রান্নার কাজে সাহায্য করে। তারাও এখন নিজের জন্য বরাদ্দ করা ঘরে আছে।
বাড়ির এই বাড়তি লোকগুলোকে সবাই কাজের লোক বললেও মাহতাব খানের মতে তারা সাহায্যকারী। আয়েশা আর ফাহিম তাদেরকে খালা বলেই সম্বোধন করে।

মেঘেরা জমে যখন চারদিক ক্রমশ আঁধার ঘনিয়ে এনেছে আয়েশার মনটা তখন আনন্দে নেচে উঠেছে। বৃষ্টি তার খুব ভালো লাগে। বৃষ্টি হবে আর সে ভিজবে না এ যেন অসম্ভব।

মায়া অনেকটা পথ জার্নিং করায় ক্লান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে নয়লে হয়ত তার সাথে আড্ডা দিতে পারত আয়েশা। কিন্তু এখন বৃষ্টি নামায় সে মনে মনে বলছে – ধন্যবাদ ভাবী, আরেকটু ঘুমাও। নইলে তো ভিজতেই পারতাম না।

টুপটাপ ছন্দ নিয়ে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আছড়ে পড়ছে মাটিতে। বৃষ্টি নামলেই মাটির গন্ধটা উন্মত্ত করে আয়েশাকে। ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির খেলা দেখছে সে। এক পা এক পা করে নামতে নামতে উঠানে নেমে এলো একদম। বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা তাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। তার স্নিগ্ধ আদলটা বেয়ে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো নিচে নেমে আসছে। হালকা গোলাপি রঙা জামায় মেয়েটাকে একদম রূপকথার রাজকন্যা লাগছিল। গুনগুন করে গেয়ে উঠল –
টুপটাপ বৃষ্টিতে কি যে ভালো লাগছে,
হৃদয়ের কথাগুলো শিষ দিয়ে ডাকছে।

পরবর্তী লাইন গাওয়ার আগেই কর্কশ আওয়াজে সে চমকে উঠে। মাথা ঘুরিয়ে সেদিকে তাকিয়ে তার মায়াবী মুখখানায় বিরক্তির ছাপ জায়গা নিয়েছে।
মুখ ঘুরিয়ে নিল আয়েশা। তীক্ষ্ণ কন্ঠটা আবারো বলল – বুড়ো মেয়ের বৃষ্টিতে ভেজার শখ হয়েছে। তোর এসব হেয়ালিপনার জন্যইতো বারবার বিয়ে ভে:ঙে যাচ্ছে। কে ই বা যেচে পড়ে এমন মেয়ে ঘরে তুলবে? তোর লজ্জা করেনা বৃষ্টিতে ভিজে সবাইকে শরীর দেখিয়ে দিতে? কি ভেবেছিস! তাতে কেউ যদি প টে যায়! তাইতো?
জ্যেঠাতো ভাইয়ের কথাগুলো শুনে চোখ দিয়ে ঝরঝর করে অশ্রু নেমে এল আয়েশার। লোকটা প্রতিনিয়ত তাকে এই কথাগুলো শুনিয়ে যায়। বিয়ে না হওয়া তার দোষ নয়। আর সে দেখতেও যথেষ্ট মায়াবী তাহলে কেন সবাই বিয়ে ভে:ঙে দেয়?
নিজেকে সামলে আয়েশা বলল – আপনার মত
মা তাল, উ ন্মা দ লোকের কাছ থেকে এরথেকে ভালো ব্যবহার আর কি আশা করা যায়? সারাদিন ওসবে ডু:বে থাকাতো আপনার নে/শা। আপনি কে আমাকে এসব বলার?
আয়েশার দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে রায়হান বলল – আমি এ বাড়ির ছেলে। তোর এসব বেহায়াপনায় বাঁধা দিতে অধিকার লাগবে বলছিস? তাহলে আমি সে অধিকার খা টা তে পারি কারণ তুই আমার চাচাতো বোন।
রায়হানের ঐ দৃষ্টি উপেক্ষা করে আয়েশা বলল – ইস, মায়ের থেকে মাসির দরদ বেশি। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল। মা:ত:লা:মি না করে নিজের কাজে যান।
কথাটা শেষ হতেই গালে সপাটে চড় পড়ল আয়েশার। গালে হাত দিয়ে ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। এরমধ্যে রায়হান একদলা মাটি নিয়ে মেখে দিল আয়েশার মুখে। রাগে অপমানে শব্দ করে কেঁদে উঠলো মেয়েটা। রায়হান তাতেও থামেনি। বাঘের মত গর্জে উঠলো। আগের থেকে আরো বিশ্রী কথাটা শুনালো সে।
– ফ্রিতে নিজের শরীরটা দেখাতে কি এখনো দাঁড়িয়ে আছিস? এত সস্তা করছিস কেন নিজেকে?
আর থেমে থাকলো না আয়েশা। দাপট বাড়িয়ে সে বলল – ফ্রিতে দেখতে এ বেলায় এসেছেন কেন? আপনি নন মাহরাম হয়েও কেন আমাকে দেখেও ভেতরে এসেছেন। ফ্রিতে ম জা নিতে?
আয়েশার কথা শুনে নিজেকে আর দমাতে পারলো না রায়হান। এক ধাক্কায় মেয়েটাকে মাটিতে ফেলে আরো কাঁদা মাখিয়ে বলল – তুই নন মাহরামদের নজর কাড়ার জন্য নিজেকে মেলে দিবি আর তারা দেখলেই দোষ? আর একটাও কথা না বাড়িয়ে এখনই ঘরে যাবি। নইলে মুখের মানচিত্র বদলে দিব।
কথাটা বলে তাকে টানতে টানতে ঘরে ঢুকিয়ে হনহন করে চলে গেল রায়হান। আজ মেয়েটা তাকে চরম অপমান করেছে। রাগে, অপমানে পুরো শরীরটা কাঁপছে তার। ঐ একটা মেয়ের জন্য সবকিছু উথাল-পাতাল লাগে তার। কেন ঐ মেয়েটা বোঝে না তার মনের কথা। কথায় কথায় মা-তা-ল বলে অপমান করে।

____

ইমতিয়াজ আর রিহানকে দেখে ঠোঁটজোড়া প্রশস্ত করলো মুরাদ। তার গ্রামে ফেরার খবর কেউ একজন জামশেদের কানে পৌঁছে দিয়েছে। সে তথ্য পেয়ে ইমতিয়াজ আর রিহানকে সরিয়ে নিজের কাছে এনেছে সে।
ইমতিয়াজ বলল – জানো তো আমাদের সাথে কেউ একজন বিশ্বাসঘাতকতা করছে। তুমিই বা কেন জামশেদকে সব বলতে গেলে? তাকে নীরবে আক্রমণ করে ধরাশায়ী করা যেত।

মুরাদ হেসে বলল – যুদ্ধের নীতি জানো ডাক্তার? পিঠপিছে ছু-রি মা//রে কাপুরুষ। অ-স্ত্র-হীন শ-ত্রুকে ধরা/শায়ী করা বীরের কাজ নয়। আমি তাকে দগ্ধে দগ্ধে মা-র-ব।

রিহান এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার মুখ খুলল- তাহলে আমরা খুঁজব কিভাবে? কে আমাদের সাথে বেঈমানি করছে।

কিছু একটা ভেবে মুরাদ বলল – তোমরা কি খেয়াল করেছো নিরুপমা হঠাৎ উধাও! তার ব্যাপারটা আমায় ভাবাচ্ছে। একমাত্র সে বলতে পারবে আড়ালে অন্তরালে কে রয়েছে। তার খোঁজ করো, তাকে আমার চাই।
প্রসঙ্গ বদলে মুরাদ বলল – রিহান তুমি নিজের বাড়ি চলে যাও।
রিহানও হাসিমুখে মেনে নিল, বিদায় জানিয়ে সে নিজের বাড়ির দিকে রওনা দিল।
ইমতিয়াজ বারবার মুরাদের দিকে তাকাচ্ছে, তার মনে কি চলছে তা জানতে মনটা উশখুশ করছে বড্ড।

নীরবতা ভে ঙে মুরাদ বলল – তোমার আদুরে ছানাটা কেমন আছে ডাক্তার?
মায়ামাখা আদুরে ছানা শুনে ইমতিয়াজ হেসে বলল – পা জি হয়েছে খুব। তার মা আর আমার রোমান্সে বাঁ:ধা দেয় শুধু।
মুরাদ হেসে বলল – তুমি কি কম পাজি? জানো ডাক্তার, আমারও না খুব ইচ্ছে হয় বাবা হতে, আমি দেখতে চাই আমার সন্তানকে তার মা কিভাবে আদর করে, ভালবাসে! আমার অনিশ্চিত জীবনে তাকে জড়িয়েছি কিন্তু আমি না থাকলে সে কি করে আমার সন্তান বড় করবে?
মুরাদের হঠাৎ উদাস হয়ে যাওয়া কথায় ইমতিয়াজ বলল – কি সব ভাবো তানভীর?
মুরাদ বলল – বৃষ্টিতে ভিজতে ভালো লাগছে ডাক্তার। জানো ডাক্তার এই একটা ভয়ে এখনও নিজের স্ত্রীকে ছোঁয়ার সাহস পাইনি।
ভিরমি খেল ইমতিয়াজ। হাসি চেপে জিজ্ঞেস করল – তুমি সত্যি পুরুষ মানুষ তো? না মানে সেটিংস এ সমস্যা আছে?
ইমতিয়াজের আচমকা কথায় চোখ বড় করে তাকাল মুরাদ। তারপরেই হো হো করে হেসে উঠে বলল – আমি একদম ঠিক আছি ডাক্তার। তাছাড়া ওর মনে এখনো ট্রমা আছে। জানোই তো ডোমেস্টিক ভা;য়ো-লে-ন্সের স্বীকার ও। ওকে এত তাড়াতাড়ি আর কোন কষ্ট দিতে চাইনা। আমার কাছে সে আদুরে হয়ে থাকুক। ডাক্তার, আমি ভালবাসি ওকে। ও আমার অর্ধাঙ্গিনী, নারী ভেবে তার উপর পুরুষত্ব ফলাতে চাইনা। সে আমায় বুঝুক ডাক্তার। খুব করে বুঝুক। খুব ভালবাসুক। তাতেই চলবে। ও তো পুতুলের বা চ্চা।
ইমতিয়াজ হাসল নীরবে। একবার তাকাল মুরাদের দিকে। মনে মনে ভাবছে – কে বলবে এই লোকটার মনে হিং- স্রতাও আছে?

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here