আড়ালে_অন্তরালে #মাহমুদা_লিজা পর্বঃ১৯

0
158

#আড়ালে_অন্তরালে

#মাহমুদা_লিজা

পর্বঃ১৯

গাড়িতে অচেতন সাদমান। দুপাশে বসে আছে পরশ এবং তুষার। দ্রুতবেগে চলা গাড়িটা আচমকা ব্রেক কষায় নিজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছিল দুজনে প্রায়। নিজেকে সামলে তুষার বলল – আজকাল কি বোতল খেয়ে গাড়ি চালাও?

ড্রাইভার সামনের দিকে ইশারা করে বলল – সামনের গাড়িটা আমাদের পথ রোধ করেছে স্যার।
পরশ লাইসেন্স করা রিভলবারটা হাতে নিয়ে বলল – গাড়িটা ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে ব্যাক গিয়ারে চালাও। হেডলাইট বন্ধ করো।
পরশের কথামতে গাড়িটা ব্যাক গিয়ারে চালিয়ে দ্রুত তার দিক পরিবর্তন করে উল্টো রাস্তায় উল্কার মত চলা শুরু করলো ড্রাইভার। দক্ষ হাতে গাড়ির গতি বাড়িয়ে বামের পথটা ধরলো সে। পেছনের গাড়িটাও সমানুপাতিক হারে গতি বাড়াচ্ছে। তাদের স্পিড এতটা বেশি ছিল যে তারা খেয়ালই করেনি যে গাড়িটা তারা ধাওয়া করছে সে গাড়িটাই মাঝপথে থেমে আছে। বিকট শব্দে সামনের গাড়িটায় ধাক্কা লেগে পেছনের গাড়িটা তাল হারিয়ে গাছের সাথে ধাক্কা লাগে। তবে পেছনের গাড়িতে থাকা কারোই ক্ষতি হয়নি। তারা দৌড়ে এসে দেখে সামনের গাড়িটা ফাঁকা, কেউ নেই গাড়িতে। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিজেদের হাতে থাকা ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বা লি য়ে তারা সাদমান আর বাকিদের খুঁজে চলেছে। পেছন থেকে অতর্কিত আক্রমণে নাজেহাল হয়ে পড়ে গুন্ডা মতো লোকগুলো। শক্ত কিছু দিয়ে একের পর এক আ-ঘা-ত করা হয়েছে তাদের ঘাড়ে, মাথায়। উষ্ণ লাল তরলটা তখন তাদের ঘাড়, কপাল বেয়ে টুপ টুপ করে পড়ছে। অতর্কিত আক্রমণে তারা দূর্বল হয়ে পড়ে। ততক্ষণে তাদের জন্য অপেক্ষা করা গাড়িতে সাদমানকে নিয়ে তারা রওনা হয় গন্তব্যে।

___

রায়হানের সাথে কথা বলতে বলতে দ্বিতীয় মেসেজটা পায় তানভীর। তাতে লেখা – আজকেই আপনাকে আটক করা হবে। আপনি আত্মসমর্পণ করে নিবেন। আপনাকে নির্দোষ প্রমাণ করে বীরদর্পে সবার সামনে আনব।

হঠাৎ কথা বলার মাঝেই থেমে যায় তানভীর। উঠে দাঁড়িয়ে বলে – আসছি রায়হান ভাই। সময় খুব কম।
রায়হান তাকে থামিয়ে বলে – আশা হারাস না। পাশে আছি। মায়ের খু নি দের শাস্তি দিতে তোর পাশে সর্বক্ষণ আছি।
তানভীর হেসে বলল – এসবে ভয় পাইনা রায়হান ভাই। ভয় শুধু আমার পুতুলের বা চ্চাটার জন্য।
রায়হান কিছু একটা ভেবে বলল – ওকে ঢাকা পাঠিয়ে দিব আগামীকাল, তোর বাসায়।
তানভীর আঁতকে উঠে বলল – ওর কাছে আমি ফাহিম, আমার বাসা ছেড়ে একটা ভাড়া বাসায় থাকি ওকে নিয়ে। আমার বাসাটা ওর জন্য সবচেয়ে বেশি বিপদজনক।
রায়হান হেসে বলল – ভাড়া বাসায়ই পাঠিয়ে দিলে কেউ খোঁজ পাবেনা। ততদিনে তোর মুক্তি হয়ে যাবে। তখন ওকে মন ভরে দেখিস।

তানভীর মাথা নিচু করে বলল – ও একা ভয় পায়। কিভাবে থাকবে পাগলিটা। কেন তাকে আমার জী’ব’নের সাথে জড়ালাম? কেন তাকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিলাম?
এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে ত্রস্ত পায়ে মায়ার কাছে ছুটে এসে দেখল জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে সে।
কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেতেই মায়া বলল – এসেছেন? সেই কখন গেলেন?
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তানভীর দেখল একটা বেজে একান্ন মিনিট। রাত মোটামুটি গভীর হয়েছে। সে পুরো দুটো ঘন্টা বাইরে ছিল। এই দুই ঘন্টায় মায়া যেন তাকে দেখার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
মায়া নিজের স্বামীর সামনাসামনি দাঁড়িয়ে বলল – এতক্ষণ কোথায় ছিলেন? আমার ভয় করে না বুঝি? এই যে মিস্টার ফাহিম, আজ এত চুপ কেন?
ফাহিম খেয়াল করল মেয়েটা আজ একটু স্বাভাবিকভাবেই তার সাথে মিশছে। সবটা জেনেও সে বুঝতে পারছে না কেন তার বরটা একটু পরেই শত্রুর মিথ্যাজালে ক্ষণিকের জন্য ফেঁ-সে গেছে।
গম্ভীর স্বরটায় এবার জায়গা করে নিয়েছে আদুরে স্বর। মোলায়েম কন্ঠে ফাহিম বলল – এতরাতে জানালার পাশে কি? ভূতের ভয় পাওনা?
ওয়ালেট থেকে কিছু টাকা মায়ার হাতে দিয়ে ফাহিম বলল – এটা রাখো। আমার অনুপস্থিতিতে কাজে লাগবে। বাবা কাল ঢাকা যাবে। তুমিও তাদের সাথে চলে যাবে কিন্তু থাকবে কোথায়? থাকবে এখন যেখানে থাকি সেখানে। বাবা তোমাকে সেখানে রেখে আয়েশাকে নিয়ে অন্য কোথাও যাবে। আমি ফেরা অবধি অপেক্ষা করবে মায়া। বাবা কিংবা আয়েশা আর তোমাকে এরমধ্যে দেখতেও যাবেনা, আমি নিষেধ করেছি। নিজেকে সামলে নিও। একটু স্ট্রং থেকো। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে আমি ঢাকার বাহিরে আছি।
মায়া নীরব শ্রোতা হয়ে প্রত্যেকটা শব্দ নিজের নিউরনে গেঁথে নিয়েছে। ফের প্রশ্নও করল না। কথা বলার সময় ফাহিমের হাত নাড়ানো, ঠোঁট নাড়ানো, ভ্রু নাচানো, হাতের আঙ্গুল দিয়ে চুলগুলোকে ব্যাকব্রাশ করা সব খেয়াল করছে অপলক। ইচ্ছে করছে লোকটার প্রশস্ত বুকটায় মাথা রেখে দুবাহুর বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে একটু নিশ্বাস নিতে।
মায়ার অপলক চাহনি ফাহিমকে হাসিয়ে দিল। অমন বিদঘুটে, তিক্ত পরিস্থিতিতেও ফাহিম বলল – এই যে ম্যাম, আমার চোখে কি আপনার সর্বনাশ ঘটে গেল? ওভাবে তাকিয়ে না থেকে একটু জড়িয়ে ধরে দু একটা চুমু খেলেও তো পারেন। তাহলে তো আর আমার কষ্ট করে মুখে ক্রিম ঘষা লাগতো না।
মায়া চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে বলল – সরিষার তেল লাগিয়ে দিব?
ফাহিমও থেমে থাকলো না। পাল্টা জবাবে বলল – উহু নরম ঠোঁটজোড়া ছুঁইয়ে দিবেন।
মেইন দরজায় কারো সজোর করাঘাত শুনে ফাহিমের বুঝতে বাকি রইলো না কে এসেছে। মাহতাব খানের ঘুম ভেঙে যায় সে কর্কশ শব্দে। আয়েশাও জেগে ওঠে। ফাহিম নেমে এসে দরজা খুলতেই বলল – তানভীর মির্জা, আপনার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে।
মায়াও সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসেছিল। আয়েশা আর মাহতাব খান তখন সবে এলেন। দরজার সামনে চেনা পোশাকে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোকে প্রশ্ন করলেন মাহতাব খান।
– এত রাতে কাকে চাই?
ওসি দ্বিগুণ তেজ নিয়ে বলল – তানভীর মির্জাকে।
তার বিরুদ্ধে গুম, খু-ন এবং চাঁদাবাজির মামলা করা হয়েছে। স্হানীয় নেতাকে খু-ন করে তার লা’শ গু*ম করে দেয়ার অপরাধে এবং টাকা নিয়ে মানুষ খু’ন করার অপরাধে তাকে স-ন্ত্রা-সী আখ্যা দিয়ে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে।
মাহতাব খান ছেলেকে বললেন – কবে ফিরবে?
নিজের প্রতি বাবার বিশ্বাস এবং আস্হা দেখে তানভীর বলল – ইনশাআল্লাহ, খুব শীঘ্রই।
মাহতাব খান বললেন – কঠিন জবাব দিয়ে এসো।
তানভীর হেসে সায় জানালো। মায়ার দিকে এক নজর তাকিয়ে দেখলো সিঁড়ির পাশের দেয়ালটা আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। চোখে মুখে তীব্র ভয়ের আভাস।
আয়েশা বলল – টেনশন নিসনা, ভাবীকে দেখে রাখব।
একজন পুলিশ এগিয়ে এসে তানভীরের হাতে হাতকড়া লাগাতেই মায়া বলল – এখনো তার অপরাধ প্রমাণিত হয়নি, তাকে এটা পড়াতে পারেন না আপনারা।
তানভীর চমকে উঠলো মায়ার দৃঢ় কন্ঠ শুনে। সে কন্ঠে কোন অনুরোধ ছিল না, ছিলো তীব্র ঝলকানি।
মায়ার কথার পিঠে কন্সটেবল জবাব দিল – এটা নিয়ম।
মায়া ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল – এটা অনিয়ম। আপনি তাকে হাতকড়া লাগাবেন না।
কন্সটেবল খেয়াল করলো মায়ার চোখে ঠিকরে যেন অগ্নি স্ফুরণ ঘটছে।
কন্সটেবল কথা না বাড়িয়ে তানভীরকে বলল – আসুন।
তানভীর এগিয়ে গেল। পিছু ফিরে দেখল একবার। এই মায়াকে সে চিনেনা। বাবার অসহায় মুখ, বোনের চিন্তিত মুখ তাকে ভিতর থেকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু মায়ার দৃষ্টি আর মায়ার মুখাবয়ব বড্ড ঝাঁঝাল ছিল যেন এক্ষুনি ভস্ম করে দিবে ঐ ইউনিফর্ম পরা পুলিশগুলোকে। মায়া দৌড়ে উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে। তানভীরও দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেল।
তানভীর ভাবছে তাকে আবার এনকাউন্টার করবে না তো এরা? নিরুপমা আসতে কি দেরী হবে?

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here