কুয়াশা_মিলিয়ে_যায়_রোদ্দুরে #পর্ব_১৫ #লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা

0
168

#কুয়াশা_মিলিয়ে_যায়_রোদ্দুরে
#পর্ব_১৫
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা

“তুরাব!”

কুয়াশার মুখে তুরাবের নাম শুনে সাফওয়ান চকিত দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। তুরাব এখনো বিষ্ময়কর চাহুনি নিয়ে তাকিয়ে আছে কুয়াশার দিকে। আর কুয়াশা! সে তো কথা বলার মত অবস্থাতেই নেই। এক প্রকার দৌড়ে বাইরে বের হয়ে যায় সে। সাফওয়ান পিছু নেয় তার।

“কুয়াশা, কুয়াশা আমার কথা শোনো। এমন করো না। থামো কুয়াশা।”

সাফওয়ানের কোনো কথায় যেন তার কর্ণকুহরে পৌঁছাচ্ছে না। সে নিজের মত ছুটে বের হয়ে যেতে চায়। ঠিক তখনই সাফওয়ান আচমকা কুয়াশার হাত ধরে ফেলে। ঘটনার আকষ্মিকতায় দু’জনেই অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সাফওয়ান দ্রুত কুয়াশার হাত ছেড়ে দিয়ে বলে,

“দয়া করে আমাকে ভুল বুঝবে না কুয়াশা। আমি ইচ্ছাকৃতভাবে তোমার হাত ধরিনি। তোমাকে আটকানোর জন্য হাত ধরতে বাধ্য হয়েছি। আমি দুঃখিত!”

কুয়াশা কিছু বলে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। আজ তার কণ্ঠ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর কুয়াশা সাফওয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“আমি আর এসব মেনে নিতে পারছি না সাফওয়ান। আর কত? এই ছেলেটা আমাকে কি একটুও ভালো থাকতে দিবে না? জীবনের নতুন একটা অধ্যায় শুরু করতে যাচ্ছি। সেখানেও তুরাব এসে হাজির। আমার প্রথম কেস কার হয়ে লড়ব? আমারই স্বামীর হয়ে? সেটাও কিনা মেয়ে ঘটিত ব্যাপার!”

“শান্ত হও কুয়াশা। আমি তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি।”

“না, তুমি বুঝতে পারছ না। এই কষ্ট কেবল মেয়েরা বুঝতে পারে। আমরা একসাথে থাকি না। হয়তো খুব তাড়াতাড়ি আলাদা হয়ে যাব। এই অবধি সব ঠিক আছে। কিন্তু এটা কী? তার আর কত নোংরামির সাক্ষী হতে হবে আমাকে? আমার জীবনে দু’জন পুরুষ এসেছিল। একজন প্রেমিক রূপে। আরেকজন স্বামী হয়ে। অথচ আমার ভাগ্য দেখ। একজনও আমাকে মানসিক শান্তি দিতে পারল না। জানো? গতকাল রাতে রায়াদের জঘন্য একটা কাজের সাক্ষী হতে হয়েছে আমাকে। সেই কষ্ট এখনো কমেনি। তার মধ্যেই তুরাবের এসব নিজ চোখে দেখতে হচ্ছে। আমি সত্যি আর পারছি না।”

“তোমাকে স্বান্তনা দেওয়ার মত ভাষা আমার নেই। তবে এটুকু বলতে পারি যে তুমি অনেক শক্ত মনের একজন মেয়ে। সর্বাবস্থায় নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার অন্যরকম এক ক্ষমতা আছে তোমার মধ্যে।”

“আমি শক্ত বলেই কি সবাই ইচ্ছামতো আঘাত করবে আমাকে? আমি কি মানুষ নই? আমার মধ্যে কি প্রাণ নেই? আমি জড়বস্তু? কোনো অনুভূতি নেই আমার মধ্যে তাই না?”

“আমি তা বলিনি কুয়াশা।”

“বলতে না চেয়েও বলে তো দিলে।”

“তোমার মা থা ঠিক নেই এখন। তুমি একটু শান্ত হও।”

“আমি এই কেস লড়ব না সাফওয়ান।”

“কেন?”

“নিজের স্বামীর এমন ঘৃণ্য কাজের হয়ে আমি কীভাবে লড়ব?”

“কুয়াশা তোমার মনে রাখতে হবে, এটা তোমার ব্যক্তিগত জীবন নয়। এটা তোমার পেশাগত জীবন। ব্যক্তিগত সমস্যার জন্য নিজের পেশাগত জীবনকে হুমকির মুখে ফেলতে চাও তুমি? জীবনের প্রথম কেসে এভাবে লড়াই না করেই হেরে যেতে চাও? এটা তো একজন আইনের কর্মীকে মানায় না। তোমার ব্যক্তিত্বের সাথে এটা একদম বেমানান কুয়াশা।”

সাফওয়ানের কথায় কুয়াশা কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দেয়,

“সত্যিই তো! এটা আমার পেশাগত জীবন। আমার এই জীবনের সাথে ব্যক্তিগত কোনেকিছুর সম্পর্ক থাকতে পারে না।”

“হ্যা তোমাকে লড়তে হবে। তুমি পারবে না সত্যের পথে চলে জয়ী হতে?”

“পারব। আমাকে পারতেই হবে।”

“তাহলে ভেতরে চলো।”

অতঃপর দু’জন ভেতরে গিয়ে নিজ নিজ আসনে বসে।

“কী ব্যাপার কুয়াশা? তুমি হঠাৎ এভাবে চলে গেলে কেন?”

“স্যার আসলে আমার শরীর একটু খারাপ লাগছিল। তাই বাইরে গিয়েছিলাম।”

“আচ্ছা তোমরা এখন কেসের ব্যাপারে আলোচনা করতে পারো।”

কুয়াশা তুরাবের দিকে তাকায়। তুরাবের দৃষ্টি নত। সে কুয়াশার চোখে চোখ রেখে কথা বলার অবস্থাতে নেই।

“আপনার নাম কী?”

কুয়াশার এহেন প্রশ্নে তুরাব অবাক দৃষ্টিতে তাকায়। কুয়াশা কোনো উত্তর না পেয়ে আবারো বলে,

“আপনার নাম কী?”

তুরাব হতাশ হয়ে উত্তর দেয়,

“তুরাব তৌহিদ।”

“মিস্টার তুরাব তৌহিদ আপনি সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বলুন। কী হয়েছে আপনার সাথে?”

তুরাব ধীর কণ্ঠে বলতে শুরু করে,

“আমি ঢাকার ছেলে। কিন্তু কিছু কারণে মাস কয়েক আগে বগুড়ায় চলে যাই। বগুড়ায় আমার কাজ শেষ হলে আমি গত মাসে ঢাকায় ফিরে আসি। এখানে ফিরে আসার পরপরই আমার পরিচয় হয় মিহি নামের একজন মেয়ের সাথে। শুরুতে এমনিই কথা হতো। কিছুদিন পর আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়। এরপর একদিন সে আমাকে দেখা করতে বলে। আমি তখন একটা কাজের জন্য যেতে পারিনি। পরবর্তীতে আমি সময় করে একদিন তার সাথে দেখা করি।”

“হুম তারপর?”

“মিহির সাথে আমি একটা ক্লাবে দেখা করি। সেখানে দু’জনেই বেশ অনেকটা ম দ্য পান করি। আমার নে শা হয়ে গিয়েছিল সেই সময়। আমি কখন ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম বুঝতে পারিনি। যখন চোখ খুললাম তখন একটা বদ্ধ ঘরে মিহির সাথে আপত্তিকর অবস্থায় নিজেকে আবিষ্কার করি।”

“তারপর কী হলো?”

কুয়াশাকে একদম স্বাভাবিক থাকতে দেখে তুরাব এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। কুয়াশা এসব দেখে বলে,

“আমার দিকে তাকিয়ে না থেকে পরের ঘটনা বলুন।”

“আমি ওর সাথে কিছু করিনি বিশ্বাস করুন। কিন্তু তার অভিযোগ তার সাথে আমার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। এবং সেখান থেকেই আমরা শারীরিক সম্পর্কে চলে যায়। যা সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমি তো তাকে খুব বেশি দিন ধরে চিনিও না।”

“মেয়েটার দাবি কী?”

“সে আমাকে বিয়ে করতে চায়। আমি এটাতে আপত্তি জানালে সে পুলিশের কাছে গিয়ে আমার নামে অভিযোগ করে। সেখানে আমাকে একজন ধ,”

“বুঝতে পেরেছি। আর কিছু বলতে হবে না।”

তুরাব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কুয়াশার দিকে তাকায়। মেয়েটা আগের থেকেও অনেক বেশি মায়াবী চেহারার অধিকারী হয়ে উঠেছে। যার দিক থেকে চোখ সরানো কঠিন। এই মেয়েটার সাথে সে গত বছর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল। অথচ নিজের দোষে নিজের স্ত্রীকে হারিয়েছে সে। আর কখনো কি এই মায়াবিনী ফিরবে তার জীবনে?

“মিস্টার তুরাব আপনার কেস আমি হাতে নিব। তবে আমার উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ চাই। তার জন্য আমাকে সহযোগিতা করতে হবে আপনাকে।”

কুয়াশার কথায় ঘোর কাটে তুরাবের। সে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলে,

“আমি আপনাকে সব রকম সাহায্য করতে রাজি আছি। আপনি শুধু আমাকে বাঁচান। আমি বিনা অপরাধে শাস্তি পেতে চাই না।”

কুয়াশা আনমনে ভাবে,

“আমার সাথে যে অন্যায় করেছেন তার শাস্তিই তো এখনো পাননি। বিনা অপরাধে শাস্তি পাওয়া তো অনেক দূর!”

“কিছু বললেন?”

“বলছি আজকের মত আপনি বাড়ি চলে যায়। আগামীকাল আপনাকে নিয়ে আমি ওই ক্লাবে যাব। বাকিটা আগামীকালই বলব। এখন আপনি আসতে পারেন।”

তুরাব কুয়াশার দিকে তাকিয়ে চলে যাওয়ার পর কুয়াশা তার স্যারকে বলে,

“স্যার আমি তাহলে এখন উঠি।”

“আচ্ছা যাও।”

সাফওয়ান উঠতে চাইলে স্যার বলে,

“তুমি বসো। তোমার সাথে আমার কথা আছে।”

সাফওয়ান চোখের ইশারায় কুয়াশাকে সাবধানে বাসায় চলে যেতে বলে। কুয়াশা বাইরে বের হওয়ার সাথে সাথে তুরাব কুয়াশার পথ আগলে দাঁড়ায়।

“কী সমস্যা? আমার পথ আগলে দাঁড়ালেন কেন?”

“কেমন আছ কুয়াশা?”

“সেই প্রশ্নের জবাব আমি আপনাকে দিতে বাধ্য নই।”

“আমি তোমার স্বামী হই।”

“স্বামী? কেমন স্বামী? যে পরনারীতে আসক্ত হয়ে এমন বাজে কেসে ফেঁসে যায়? যে বিয়ের মত পবিত্র সম্পর্ক নিয়ে খেলা করে একজন মেয়ের জীবন শেষ করে দেয়? যে দিনের পর দিন ভালোবাসার অভিনয় করে? যে হাজার নারীতে আসক্ত? যে প্রাক্তনের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য নিরপরাধ একজনকে কষ্ট দেয়? সেই স্বামীর কথা বলছেন আপনি?”

তুরাব করুণ দৃষ্টিতে কুয়াশার দিকে তাকায়। কিন্তু সেই চাহুনি কুয়াশা দেখতে পায় না। কারণ ততক্ষণে সে চোখ সরিয়ে নিয়েছে তুরাবের দিক থেকে।

“আমি জানি আমি অনেক পাপ করেছি। কিন্তু এই কাজ আমি করিনি। ওই মেয়েকে আমি ছুঁয়েও দেখিনি। আর না তো তার সাথে আমার কখনো কোনো প্রেমের সম্পর্ক ছিল।”

“কোনটা সত্যি তা প্রমাণ করার জন্যই আমাকে ডাকা হয়েছে। সুতরাং আপনার মুখের কথায় আমি কিছু বিশ্বাস করতে পারব না। আর একটা কথা ভালো করে শুনে নিন। এখানে আমি একজন উকিল। আর আপনি আমার কাছে এসেছেন নিজের কেস লড়ার জন্য। তাই কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্ক এখানে টেনে আনবেন না।”

কথাটা বলে কুয়াশা চলে যায়। কিন্তু তুরাব কোথাও যায় না। ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে।

চলবে??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here