কুয়াশা_মিলিয়ে_যায়_রোদ্দুরে #পর্ব_২০

0
212

#কুয়াশা_মিলিয়ে_যায়_রোদ্দুরে
#পর্ব_২০
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা

র ক্ত মাখা হাত নিয়ে ছাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে কুয়াশা। আর মাত্র দুই পা এগোলেই ছাদ থেকে পড়ে মৃ ত্যু নিশ্চিত। কিন্তু তার চোখে কোনো ভয় নেই আজ। সে নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশেরও আজ মন ভালো নেই। তাই তো নিজের কষ্টগুলোকে বৃষ্টিতে রূপ দিয়েছে। ঝুম বৃষ্টিতে একটা মেয়ে র ক্তা ক্ত হাতে ছাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে। কারণ, আজ তার মন ভালো নেই!

“রায়াদ জানো? আমি না আজ ভীষণভাবে ভেঙে গিয়েছি। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। বারবার মনে হচ্ছে এমন জীবন নিয়ে বেঁচে থাকা খুব কঠিন। আমার পাশে অনেকেই আছে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, আমার পাশে কেউ নেই। কোথাও কেউ নেই! আচ্ছা তুমি আমায় কেন ভালোবাসলে না? ভালো না বাসার কারণটা বললে না কেন আমায়? তুমি যদি আমার জীবনে না আসতে তাহলে হটকারিতায় আমি তুরাবকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিতাম না। আমার জীবনটা আজ অন্য রকম হতে পারতো। হলো না কেন? কী এমন ভুল করেছিলাম তোমায় ভালোবেসে? তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে। কিন্তু আমাকে ভালো না বাসার কারণটা বলে গেলে না।”

লাল রঙে ছেয়ে যাওয়া হাত দিয়ে চুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ করে নেয় কুয়াশা। কিছুক্ষণ নিরব থেকে হঠাৎ করেই চিৎকার করে বলে ওঠে,

“প্রতি রাতে কান্নারা যখন চিৎকার করে ওঠে, তখন ভীষণ বলতে ইচ্ছে করে, কেন বুঝলে না আমায়? আমায় একটু ভালোবাসলে খুব কি ক্ষতি হয়ে যেত তোমার? আমি না আর পারছি না। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। এই প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত আমি শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে পারব না। কিন্তু তোমার নতুন সংসারেও অশান্তি সৃষ্টি করতে পারব না আমি। আমি সবার প্রতি কঠিন হতে পারি। সবাইকে শাস্তি দিতে পারি। সবার মনে অনুশোচনা বোধ জাগ্রত করে পারি। শুধুমাত্র তোমাকে কোনো শাস্তি দিতে পারছি না। তোমার মনে আমি অনুশোচনা বোধ জাগ্রত করতে ব্যর্থ হয়েছি বারবার। আজ সেই দিন, যেদিন তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে আমাকে তুমি নিজের করে নিবে। তুমি কথা রাখোনি। তুমি কথা দিয়ে কথা না রাখা মানুষ। এমন মানুষের প্রতি আমার এক সমুদ্র সমান ঘৃণা জন্মাক!”

“কুয়াশা!”

হঠাৎ কারোর ডাকে কুয়াশা চুপ হয়ে যায়। আদ্রিতা ছুটে এসে কুয়াশাকে জড়িয়ে ধরে প্রশ্ন করে,

“কী হয়েছে তোর? নিজের কী অবস্থা করেছিস তুই?”

“আমার না দম বন্ধ লাগছে রে। প্রতিনিয়ত ভালো থাকার মিথ্যা অভিনয় করতে করতে আমি ক্লান্ত। যে কখনো আমার হবে না, সে কেন এসেছিল আমার জীবনে?”

“শান্ত হ কুয়াশা। আমাদের জীবনে এমন অনেক কিছু হয় যা আমরা চাই না। তবে কী জানিস? আমাদের জীবনে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে যায়। এই যেমন তোকে লড়াই করতে শিখিয়েছে। রায়াদ ভাইয়া তোর জীবনে না আসলে তোর মত অতি আবেগি মেয়ে কি এমন কঠোর হতে পারত? আগে তুই সামান্য কারণেও কেঁদে অস্থির হয়ে যেতিস। আর এখন জীবনের এমন পর্যায়ে আছিস যেখানে তোকে বারবার আঘাত করলেও তুই শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারিস। এই শিক্ষাটা কিন্তু রায়াদ ভাইয়ার চলে যাওয়ার মাধ্যমেই পেয়েছিস তুই। সুতরাং সবকিছুর ভালো দিকটা গ্রহণ করার চেষ্টা কর।”

কথা বলার এক পর্যায়ে আদ্রিতার চোখ যায় কুয়াশার হাতের দিকে।

“হাত কে টে গেল কীভাবে?”

“পানি খাওয়ার সময় গ্লাস এত জোরে চেপে ধরেছিলাম যে ভেঙে গিয়েছে।”

“সমস্ত রাগ গ্লাসের উপর ঝাড়লি?”

“আর কী করতাম বল? নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম।”

“ঘরে চল। হাতে ওষুধ লাগাতে হবে। আর এই অসময়ে বৃষ্টিতে ভেজার কোনো মানে হয়? রাতে জ্বর আসবে দেখিস।”

“কিছু হবে না।”

“হ্যা তুই তো রোবট তাই না? এজন্য কিছু হবে না।”

“ধীরে ধীরে একটা যন্ত্রেই তো পরিণত হয়েছি।”

“অনেক কথা হয়েছে। এখন ঘরে চল বলছি।”

কুয়াশাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আদ্রিতা নিজেই তাকে টানতে টানতে ঘরে নিয়ে যায়। অতঃপর তার হাতে ওষুধ লাগিয়ে দিয়ে গোসল করতে পাঠায়। বিকাল পাঁচটা থেকে প্রায় পঞ্চাশ মিনিট সে বৃষ্টিতে ভিজেছে। তার এলোমেলো কোমড় অবধি চুলগুলো থেকে টুপটুপ করে পানি পড়তে পড়তে ঘরটাও ভিজে একাকার হয়ে গিয়েছে!

“কুয়াশার কী অবস্থা এখন? টানা দুই ঘন্টা ধরে কল দিয়ে যাচ্ছি। রিসিভ করছে না কেন?”

“সাফওয়ান ভাইয়া ওর অবস্থা একদম ভালো না। কখন কি করছে নিজেই বুঝতে পারছে না।”

“ওকে সামলাও। আমি একটু পর আসছি।”

“আপনি এখানে আসবেন?”

“হ্যা।”

“ঠিক আছে। তাড়াতাড়িই আসুন তাহলে। এসে ওকে একটু বোঝান। ওও সচারাচর এমন করে না। আজ কেন যে এমন পাগলামি করছে সেটা বুঝতে পারছি না।”

“মানসিক অশান্তিতে থাকতে থাকতে ওও ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে। এবার ওর একটু শান্তি দরকার।”

“ঠিকই বলেছেন। এত অল্প বয়সেই অনেক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে লড়াই করেছে মেয়েটা। এখনো লড়াই করেই যাচ্ছে। পঁচিশ বছর বয়সে পা রাখার আগেই ওর জীবনটা কেমন যেন বেরঙিন হয়ে গেল!”

“তুমি ওর পাশেই থাকো আদ্রিতা। আমি আসছি।”

“আচ্ছা।”

ফোন রেখে রান্নাঘরে চলে যায় আদ্রিতা। সন্ধ্যার নাস্তায় পাস্তা তৈরি করবে সে এখন।

“ইশ হাতের কি অবস্থা করেছি। এমন পাগলের মত কাজ করলাম কিভাবে আমি!”

“পাগল হয়ে গিয়েছ যে তাই এমন করে নিজের ক্ষতি করলে।”

“সাফওয়ান তুমি এখানে!”

সাফওয়ানকে দেখে বিছানা থেকে এক লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় কুয়াশা। এখনো চুল থেকে পানি পড়ছে। সেদিকে তার বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। সে তো এখন সাফওয়ানকে দেখে চকিত দৃষ্টে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।

“এমন করে দেখার কী আছে? আজ নতুন দেখছ নাকি আমাকে?”

“না। কিন্তু তুমি কিছু না বলে চলে এলে যে?”

“আদ্রিতাকে বলে এসেছি। ওকে কল দেওয়ার পর শুনলাম তুমি এই অবেলায় গোসল করছ।”

“কিন্তু এখন তুমি এখানে কেন?”

“আসতে পারি না?”

“তা নয়। আচ্ছা তুমি এখানে বসো।”

“আমি একা আসিনি। আমার সাথে আরো একজন এসেছে।”

“কে?”

“কলি!”

দরজার সামনে আচমকা মল্লিকাকে দেখে কুয়াশা থমকে যায়। যখন বুঝতে পারে সত্যি তার বেস্ট ফ্রেন্ড তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তখন ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে।

“তুই আমাকে কিছু না বলে চলে আসলি কেন? আমাকে একবার জানাবি তো। তোকে বাস স্ট্যান্ডে নিতে যেতাম আমি।”

“আমাকে বাস স্ট্যান্ড থেকে সাফওয়ান ভাইয়া নিয়ে এসেছে।”

কুয়াশা অবাক হয়ে বলে,

“তুমি?”

সাফওয়ান কুয়াশার এমন অবস্থা দেখে হেসে উত্তর দেয়,

“হ্যা, আমি নিয়ে এসেছি। শুধু যে নিয়ে এসেছি তা কিন্তু নয়। ওকে ঢাকায় আসতে আমিই বলেছি।”

“কেন?”

“তোমার মন ঠিক করার জন্য।”

কুয়াশা আবেগাপ্লুত হয়ে বলে ওঠে,

“অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।”

“একি! তুমি কাঁদছ কেন?”

কুয়াশার চোখে পানি দেখে মলি তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,

“আর কান্না নয়। অনেক কেঁদেছিস। এখন থেকে তোকে ভালো থাকতে হবে। ভালো থাকার অভিনয় নয়। বরং সত্যিকারের ভালো থাকতে হবে তোকে।”

“পারব?”

“অবশ্যই পারবি। কেন পারবি না? তোর সাথে তোর আপনজন সবাই আছে। তাহলে ঘুরে দাঁড়াতে সমস্যা কোথায়? তোর এমন অবস্থা দেখে আন্টির অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মেয়ের কষ্ট তিনি মেনে নিতে পারছেন না।”

এর মধ্যে আদ্রিতা সবার জন্য খাবার নিয়ে আসে। খাবার সব টেবিলে রেখে মলিকে জড়িয়ে ধরে বলে,

“তুই এসে খুব ভালো করেছিস। আমি একা তো এই শাঁকচুন্নিকে সামলাতেই পারছিলাম না।”

“ওই তুই আমাকে শাঁকচুন্নি বললি?”

“শাঁকচুন্নিকে তো শাঁকচুন্নিই বলব।”

“তবে রে!”

কথাটা বলে কুয়াশা দৌড়ে আদ্রিতাকে ধরতে গেলে সেও দৌড় লাগায়। দু’জনের এমন দুষ্টুমি দেখে সাফওয়ান বলে,

“দৌড়াদৌড়ি পরে করো। আগে আমার কথা শোনো।”

“কী?”

“আমরা চারজন মিলে ঘুরতে যাব সেন্ট মার্টিনে।”

“কবে? কখন? আর কেন?”

“আমি টিকিট কেটে রেখেছি। আগামী পরশু আমরা রওনা দিব। আর উদ্দেশ্য হলো তোমার মন ভালো করা। মূলত এই কারণেই মল্লিকাকে ঢাকায় নিয়ে আসা।”

চলবে??

বিঃদ্রঃ প্রথম অংশটুকু লিখতে গিয়ে নিজের অজান্তেই চোখে পানি চলে এসেছে আমার। একটা মেয়ের এমন পরিস্থিতির বর্ণনা করতে গিয়ে নিজেকে কল্পনা করে নিজেই চমকে গিয়েছি। এমন পরিস্থিতি কখনো কারোর জীবনে না আসুক!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here