কুয়াশা_মিলিয়ে_যায়_রোদ্দুরে #পর্ব_৫

0
301

#কুয়াশা_মিলিয়ে_যায়_রোদ্দুরে
#পর্ব_৫
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা

“কুয়াশা তোর বরকে আজ অন্য একটা মেয়ের সাথে দেখলাম। দেখে মনে হচ্ছিল ওরা যেন স্বামী-স্ত্রী। নিজের বরকে একটু আগলে রাখতে পারিস না?”

ট্রেনে বসে থাকতে থাকতে কুয়াশার চোখ কিছুটা লেগে এসেছিল। এমন সময় তার ফোনে কল আসে মাইশার। মাইশা কুয়াশার কলেজ জীবনের বান্ধবী। প্রথমত কুয়াশার কাঁচা ঘুম ভেঙে গিয়েছে। তার উপর মাইশার মুখে এমন কথা শুনে কুয়াশার মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।

“মাইশা তোর কী আর কোনো কাজ নেই বোন?”

“মানে?”

“মানে আমার বর কার সাথে ঘুরছে না ঘুরছে এসব দেখেছিস ভালো কথা। সেটা আবার আমাকে বলার কী আছে?”

“ওমাহ্ তোর বর এসব করে বেড়াচ্ছে, আর আমি তোর বান্ধবী হয়ে তোকে জানাব না?”

“না রে বান্ধবী জানাতে হবে না।”

“কেন?”

“কারণ ওর যা ইচ্ছা করুক। আমার তাতে কিছুই যায় কিংবা আসে না। আমরা এখন আলাদা থাকি।”

“তুরাব ভাইয়ার এই চরিত্রের জন্যই কী তোরা আলাদা হয়ে গিয়েছিস?”

“কেন আলাদা হয়েছি সেটা নাহয় অজানা থাকুক।”

“ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে নাকি তোদের?”

“না, আমাদের ডিভোর্স হয়নি।”

“এমন সম্পর্কে থেকে কী করবি? বের হয়ে আয়।”

“ডিভোর্স কী এত সহজ? আচ্ছা তুই আমাকে একটা কথা বল, এই সমাজে ডিভোর্সি মেয়েদের ভালো চোখে দেখা হয় কী? জানি তুই এখন বলবি যে একজন আইনের ছাত্রী হয়ে এমন কথা আমাকে মানায় না। কি করব বল? সমাজের সবার কথা মানি বা না মানি, কিছু কিছু কথা একদম বুকে এসে লাগে। আজ আমি তুরাবকে ডিভোর্স দিব। আগামীকাল থেকেই আমার নামের পাশে ডিভোর্সি তকমা লাগবে। দোষ আমার না হলেও দোষী আমাকেই বানাবে সবাই। এমনিতেই অনেকের অনেক কিছু সহ্য করেছি। আর পারব না আমি। আমাকে দেখিয়ে সবাই বলবে আমি একজন ডিভোর্সি। এক বছরও স্বামীর সংসার করতে পারিনি। স্বামীকে আটকে রাখতে পারিনি। অক্ষমতা আমার এবং শুধুমাত্র আমারই। ছেলেদের দোষ দেখে কয়জন?”

কুয়াশার কথাগুলো শুনে মাইশা চুপ হয়ে যায়। কুয়াশা আবারো বলে,

“জানিস? আমিও না স্বামীর সংসার করতে চেয়েছিলাম। মজার বিষয় হলো বিয়ের পর আট মাস খুব সুখেই সংসার করেছি। কিন্তু যেখানে ভালোবাসা নেই সেখানে থাকা সম্ভব নয়। আট মাস পর বুঝলাম আমি যেটাকে ভালোবাসা ভেবেছি সেটা আসলে মিথ্যা অভিনয়। হ্যা, আমরা আলাদা হয়েছি। সে আমাকে ডিভোর্সও দিতে চেয়েছে। কিন্তু আমি ডিভোর্স চাই না এখন। ডিভোর্স আমি তখনই দিব যখন বুঝতে পারব আমার গায়ে আর মিথ্যা অপবাদ লাগবে না। অতিরিক্ত কঠোর অথবা সমাজের চোখে নিজের অবস্থান দৃঢ় করে তবেই আমি তুরাবকে ডিভোর্স দিব। তার আগে নয়। অতিরিক্ত কঠোর এজন্য হতে হবে যেন সমাজের মানুষের বিষাক্ত তীরের মতো কথাগুলো হজম করার সহ্য ক্ষমতা তৈরি হয় আমার মধ্যে। কথার আঘাতের চেয়ে তীব্র এই ত্রিভুবনে আর কিছুই হতে পারে না। তা হজম করার শক্তি এখনো হয়নি আমার।”

“তোর অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। কিছু মনে করিস না কুয়াশা। আমি হয়তো তোর ক্ষত বাড়িয়ে দিলাম।”

“এটা তো কেবল শুরু। আজ তুই কল দিলি। কাল আরো দশজন কল দিয়ে হরেকরকম কথা বলবে। আমি আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। সমস্যা নেই আমার।”

“আচ্ছা ট্রেনের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি মনে হয়। তুই কোথায়?”

“আমি ঢাকায় যাচ্ছি।”

“কেন?”

“পরিপূর্ণ উকিল হওয়ার জন্য।”

“বাহ্ এটা তো দারুণ খবর। শুভকামনা রইল তোর জন্য। সাবধানে থাকিস দোস্ত। আর মাঝেমধ্যে একটু কথা বলিস। তোকে তো অনলাইনে খুব বেশি পাওয়া যায় না।”

“সমস্যা নেই। আমি তোর সাথে যোগাযোগ করব।”

“আচ্ছা আমি এখন রাখি। পরে কথা হবে ইনশাআল্লাহ।”

“ভালো থাকিস মাইশা। আল্লাহ হাফেজ।”

“আল্লাহ হাফেজ।”

কথা শেষ করে ফোনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে কুয়াশা আনমনে ভাবে,

“আমাদের সমাজ তৈরি হয়েছে আমাদের মানুষদের নিয়েই। অথচ সেই সমাজ ছেলেদের দোষ হলে বলে দুষ্টুমি। আর মেয়েদের সামান্য দোষও কত বড়ো করে দেখা হয়। আজ আমাকে সবাই বলছে ডিভোর্স দিতে। অথচ এই মানুষগুলোই পরবর্তীতে আমাকে ডিভোর্সি বলে হাসাহাসি করবে। দুই দিন পর যদি আমি দ্বিতীয় বিয়ে করি তাহলে আমাকে বলবে, আমি আরেক জায়গায় সম্পর্ক করে এই বিয়ে ভেঙেছি। কি দরকার এত কথা শোনার। একজন মানুষের জীবনে বিয়ে সব হতে পারে না। একবার বিয়ে করে শখ মিটে গিয়েছে। আর কারোর সাথে জড়ানোর ইচ্ছা নেই। হাজার হলেও আমি বিবাহিত। বিয়ের তকমা যখন আমার গায়ে লেগেছে তখন আমার জীবন কিছুটা হলেও জটিল এখন এটা মেনে নিতে হবে আমাকে। অনেকের কাছে বিয়ে খেলার অংশ হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে বিয়ে মানে অনেক কিছু। পবিত্র সম্পর্ককে যারা কলুষিত করেছে তাদের শাস্তি পেতে হবে। অন্যায়ের কোনো ক্ষমা হয় না। অন্তত আমার কাছে তো একদমই না।”

দীর্ঘ কয়েক ঘন্টার ট্রেন ভ্রমণ শেষে কুয়াশা ঢাকায় পৌঁছায়। এই শহর তার খুব চেনা। প্রায় সাড়ে চার বছর সে এই শহরে থেকেছে। বন্ধুবান্ধবের সাথে হুটহাট ঘুরতে যাওয়া, ফুলের দোকানের সামনে গিয়ে কয়েকজন বান্ধবী মিলে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে ছবি তোলা, শাড়ি পড়ে রাতের শহরে পায়ের ছাপ ফেলা, সন্ধ্যায় চায়ের দোকানের সামনে চা পান করতে করতে গল্প করা কিংবা গভীর রাতে কষ্ট ভোলার জন্য খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে কখনো কান্না কখনো হাসি আবার কখনো বিষন্ন চাহুনি নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে একা একা কথা বলা, এই সবকিছুর সাথে কুয়াশার পরিচয় হয়েছে এই শহরে আসার পরেই।

সময়গুলো মনে করে লম্বা শ্বাস টেনে কফির কাপে চুমুক দেয় কুয়াশা। রাত এখন প্রায় দশটা। কুয়াশা একা বসে আছে ছাদে। মন খারাপের সময়গুলোতে ছাদে এসে কফির কাপে চুমুক দেওয়া আর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা বহু পুরোনো স্বভাব তার।

হঠাৎ ফোন বেজে উঠলে ঘোর কাটে কুয়াশার। ফোন হাতে নিতেই চমকে যায় সে। এই নাম্বার তার চেনা। ভীষণ চেনা! এতগুলো দিন পর এই নাম্বার থেকে কল আসাতে সে ভীষণ অবাক হয়েছে। কারণ এই নাম্বার থেকে আর কখনে কল আসবে এটা ভাবাও বারণ ছিল কুয়াশার। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন রিসিভ করে সে। কিন্তু কোনো কথা বলে না। দীর্ঘক্ষণ চুপ থাকার পর অপর পাশ থেকে কেউ একজন বলে,

“কেমন আছ কুহু?”

কুয়াশার পুরো নাম কুয়াশা তাসমিম কুহু। কুহু নামে তাকে অল্প কয়েকজন ডাকে। তার মধ্যে অন্যতম হলো রায়াদ। কুয়াশা রায়াদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে বসে।

“কেন কল দিয়েছেন আপনি আমাকে?”

“কেন? আমার কী কল দেওয়া বারণ?”

“অবশ্যই। কারণ আমি এখন বিবাহিত।”

“জানি আমি। এমনটা কেন করলে তুমি আমার সাথে?”

“আমি আপনার সাথে কিছুই করিনি। বরং আপনি আমার ভালো থাকা কেড়ে নিয়েছিলেন।”

“নিয়েছিলাম? তার মানে এখন তুমি ভালোই আছ। তা বোনের প্রাক্তনকে নিয়ে খুব সুখেই আছ মনে হয়।”

“আপনি কী আমাকে খোঁচা দেওয়ার জন্য কল দিয়েছেন?”

“না, আমি তোমাকে এটা জানানোর জন্য কল দিয়েছি যে আমি ভালো নেই কুহু। তোমাকে ছাড়া আমি একদম ভালো নেই।”

“নিজেই তো সম্পর্ক শেষ করেছেন। এখন ভালো নেই কেন?”

“একটা ভুল আমাদের সব শেষ করে দিল।”

“কী ভুল?”

“তোমাকে ছেড়ে দেওয়া। তোমার মতো মেয়েকে ছেড়ে দেওয়া মানে নিজের সুখ বিসর্জন দেওয়া। একটা বছর হতে চলল তোমার সাথে আমার যোগাযোগ নেই। তুমি যদি আমার উপর অভিমান করে এই বিয়েটা না করতে তাহলে আজ আমরা সুখী দম্পতি হতে পারতাম।”

“এসব বলে আর লাভ নেই। যা হওয়ার সেটা তো হয়ে গিয়েছে। পুরোনো কথা মনে করার কী দরকার?”

“একবার দেখা করবে?”

“কেন?”

“দয়া করে না করো না। তুমি তো আমার সব কথা শুনেছ। শেষবারের মতো অনুরোধ করছি। একবার দেখা করতে চাই তোমার সাথে।”

“আমি বগুড়ায় নেই। ঢাকায় চলে এসেছি।”

“আমিও ঢাকাতেই আছি। তুমি শুধু বলো দেখা করবে কিনা।”

“হঠাৎ আপনার আগমন কেন এটাই আমি বুঝতে পারছি না।”

“এই এগারো মাসে অনেক কিছু ঘটে গিয়েছে আমার সাথে। সবকিছু তোমাকে বলে একটু হালকা হতে চাই আমি।”

“ঠিক আছে। আগামীকাল সকাল দশটার দিকে দেখা করব আমরা রমনার চত্বরে।”

“ধন্যবাদ।”

“এখন কল রাখি।”

“আর একটু সময় থাকা যায় না কলে?”

“না!”

আর কিছু বলার সুযোগ পায় না রায়াদ। তার আগেই কল কেটে দেয় কুয়াশা।

চলবে??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here