বইছে আবার চৈতী হাওয়া
৬১
মীরার নিষেধ করা সত্ত্বেও শুভর ফোন আসা বন্ধ হলো না। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে রিক্সায় উঠতে যাবে তখনি টের পেল ব্যগের মধ্যে ফোন ভাইব্রেট করছে। মীরা ভাবল হয়ত বাড়ী থেকে কেউ, কারন আশিকের এখনো পরীক্ষা শেষ হয়নি। আরো দশ মিনিট বাকী। মীরা রিক্সায় উঠে ফোন কানে ঠেকিয়ে বলল
হ্যলো
মীরা তুমি জান আশিকের কি হয়েছে?
মীরার মনে হল হৃৎপিণ্ডটা গলার কাছে চলে এসেছে। রিক্সার হুডটা শক্ত করে ধরে ও কোনমতে বলল
-কি হয়েছে ওর? ও ঠিক আছে তো?
শুভ বিরক্ত কন্ঠে বলল
-কি আবার হবে? কিছু হয়েনি। বলছিলাম ও কি করেছে জান?
-কি?
-আশিক আজকে নকল করেছে
মীরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
-তুমি কি এই পরীক্ষার ইনভেজিলেটর ?
-না, মানে…
-তুমি দেখেছ ওকে নকল করতে?
-না, কয়েকজন বলছিল
-তুমি টিচারকে বললেই পারতে।
-তুমি আমার কথা বিশ্বাস করোনি। তাইনা?
মীরা তীব্র কন্ঠে বলল
-না
-ওকে এত বিশ্বাস কর?
-হ্য করি। আমার নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করি।
-আশিক এই দুই মাসে কি এমন করেছে যেটা আমি দুই বছরেও করতে পারিনি, যে তুমি এতটা অন্ধ হয়ে গেলে।
-তুমি দুই জন্মেও সেটা করতে পারবে না
-কেন?
কারন তুমি আশিক না। আমি ফোন রাখছি। আর আমাকে বিরক্ত করবে না।
-আমার যেটা বলার, তা না বলা পর্যন্ত আমি ফোন রাখব না
মীরা হাল ছেড়ে দিয়ে বলল
-কি বলবে বল
-আমি তোমাকে আবার ফেরত চাই
মীরা হতভম্ভ হয়ে গেল। চট করে বলার মতো কিছু খুজে পেল না। মিরাকে চুপ করে থাকতে দেখে শুভ আবারো বলল
-তুমি শুনতেঁ পাচ্ছো?
-হ্যাঁ
-কিছু বল। আমি জানি তুমি এখনো আমাকেই ভালবাসো। আমার উপর রাগ করে আশিককে নিয়ে এসব কথা বল
মীরা রাগ করতে গিয়েও হেসে ফেলল।
-আমার বিয়ে হয়ে গেছে শুভ। এখন এসব কথা বলার মানে কি?
-এটা কোন ব্যপার না। বিয়ে হলে ডিভোর্স ও করা যায়।
-তারপর তোমার বাবা মা দোকানদারের ডিভোর্সি মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজী হবে?
-আমি তোমাকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে যাব। আমার স্কলারশিপ হয়ে গেছে। তুমি শুধু একটু কোঅপারেট কর।
-শুভ তুমি আমাকে কোনদিন ও ভালোবাসোনি। আজ ও বাসো না। এখন আশিক কে দেখে তোমার ইগো হার্ট হচ্ছে। নিজেকে পরাজিত মনে হচ্ছে তাই এই রকম শুরু করেছ। একটা কথা খুব ভাল করে শুনে রাখ, আমি মরে গেলেও ওকে ডিভোর্স দেব না কারন আমি ওকে আমার নিজের চাইতেও বেশি ভালোবাসি।
মীরা ফোন কেটে দিয়ে হাপাতে লাগল। আবম্ভব পানির পিপাসা পেয়েছে। মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে পানি না খেলে ও মরে যাবে।
আশিক পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে দেখল শুভ দূরে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে কারো সঙ্গে ফোনে কথা বলছে। খুব হাত নেড়ে নেড়ে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে। আশিক পাত্তা দিল না, সিডি বেয়ে নেমে গেল। মারুফ আর সুমন কথা বলছে। সুমন খুব করে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে কিন্ত মারুফের মেজাজ ঠান্ডা হচ্ছে না। আশিক এগিয়ে এসে বলল
-কিরে কি হইল?
সুমন হাল ছেড়ে দেয়া ভঙ্গিতে বলল
-আরে দেখ না কি জানি ভুল করসে এখন চিল্লায়া লাভ আছে?
আশিকের ফোন বাজছে। ও ফোন তুলে বলল
-হ্যাঁ সুমনা বল
-ভাইয়া আমি কার্জন হলে ফর্ম জমা দিতে এসেছিলাম। আপনার পরীক্ষা কি শেষ?
-হ্যাঁ তুমি কোথায়?
-ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের কাছেই
-এই যে ডান দিকে তাকাও
আশিক হাত উচু করল। সুমনা হাসতেঁ হাসতেঁ এগিয়ে এসে বলল
-পরীক্ষা কেমন হল ভাইয়া?
-ভাল। তোমার কি খবর?
– ক ইউনিটের কর্ম জমা দিতে এসেছিলাম। সেই দশটায় এসেছি। এতক্ষনে শেষ হল।
-যাক ভালই হল। চল একসঙ্গে ফেরা যাক।
আশিক হাত তুলে মারুফ আর সুমন থেকে বিদায় নিয়ে এগিয়ে গেল। ওরা একটু দুরেই দাড়িয়ে সিগারেট ধরিয়েছে। সুমন একবার আড়চোখে তাকাল, কাছে এল না। মেয়েটাকে দেখলে কেমন অস্বস্তি লাগে। সেদিন আশিকদের বাসায় পরিচয় হয়েছিল। নাম শুনে সুমন হকচকিয়ে গিয়েছিল। এই নামে সত্যি কোন মেয়ে আছে ও ভাবেনি কখনো। এম্নিতেই সুমন মেয়েদের সঙ্গে একেবারেই সহজ হতে পারে না। এর অবশ্য একটা কারন আছে। একটা নয় দুটো কারন। সেদুটো হল ওর বড় দুই বোন। ওর থেকে পাচ বছরের বড়।জমজ। ওদের দুজনের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য যেন ওর জীবনটাকে আতিশঠ করে তোলা। যতদিন সুমন বাড়িতে ছিল এরা দুজন ওর জীবন নরক বানিয়ে রেখেছিল। ছোটবেলায় কখনো ওর ঘুমন্ত মুখে গোফ একে রাখত আবার কখনো ওর জামার পেছনে নকল লেজ ঝুলিয়ে দিত। আর সারক্ষন শুধু একটা কথা বলেই ক্ষেপাতো সুমন তোর সুমনা কই? ছোটবেলায় সুমন খুব কাঁদত এই কথা শুনে। একটু বড় হবার পর রাগ হত, তার ও পরে বিরক্ত হত, কিন্তু ওই দুইজনের উৎসাহের ঘাটতি কখনো হয়েনি। সেদিন মারুফ যখন পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল সুমন খুব অবাক হয়ে বলেছিল
-আপনার নাম সুমনা?
-জি
-কি করেন আপনি?
মেয়েটা ভুরু কুচকে বলেছিল
-এবার ইন্টার দিলাম।
-ও আচ্ছা। সুমনের অস্বস্তি কিছুতাই কাটছেনা। কি বলবে বুঝতেও পারছেনা। উঠে ও যেতে পারছে না। অস্বস্তি কাটাতে ও বলল
-এখানে কি বেড়াতে এসেছেন?
-জি না। কনফারেন্স এটেন্ড করতে।
সুমন কিছুই বুঝতে পারল না। কিসের কনফারেন্স সেটা জিজ্ঞেস করার সাহস ও হল না। মেয়েটাকে দেখলে ভদ্র শান্ত মনে হয় কিন্তু চোখের দিকে তাকালে বোঝা যায় দুস্টামিতে ভরা। সুমন আর কিছু বলল না। মীরা সবাইকে চা দিচ্ছিল। সুমন চা নিতে গিয়ে প্যন্টে চা ফেলে দিল। পরক্ষনেই তাকিয়ে দেখল মেয়েটা ফিক ফিক করে হাসছে। এখানে হাসির কি আছে ও বুঝতেঁ পারল না। মীরা পাশ ফিরে ধমক দিল। সুমন স্পস্ট দেখল মেয়েটা মুখে হাত চাপা দিয়ে শব্দ করে হাসছে। কি অদ্ভুত! মেয়েগুলো সব বোধহয় একি টাইপ। এদের থেকে এই জীবনে মুক্তি নেই।
আশিক সুমনাকে নিয়ে গেটের কাছে এসে বলল
-কিছু খাবে সুমনা?
-আইসক্রিম খাব
আশিক ওর হাতে আইসক্রিম দিয়ে বলল
-মীরার জন্য কিছু নিয়ে যাই। ওর কি পছন্দ বলতো
-আপার আমড়া খুব প্রিয়। ফুলের মত আমড়া
সামনেই একটা আমড়ার ভ্যন। সুমনা সেদিকে তাকিয়েই কথাটা বলেছে। আশিক গাড়ির সবগুলো আমড়া কিনে ফেলল। সুমনা আশ্চর্য হয়ে বলল
-এতগুলো কেন?
-তুমি না বললে ওর প্রিয়।
সুমনা আর কিছু বলল না। ওর মেডিকেলের পরীক্ষা খুব ভাল হয়েছে। খুব সম্ভবত হয়ে যাবে। মেডিকেলে পড়াটা ওর স্বপ্ন ছিল। চান্স পেলে ও হয়ত ওর এতটা আনন্দ হবে যতটা আশিককে দেখে হয়েছে। মীরার জন্য ঠিক এমন কাউকেই ও চেয়েছিল।
চলবে………………….