সংসারের_সাতকাহন পর্ব ১০

0
199

#সংসারের_সাতকাহন
পর্ব ১০

“তুমি দেখতে একদম শামিমার মতো।” বলে সাদিক।
চমকে উঠে সোনিয়া, “শামিমা কে?”।
“মালার ননদ।” জানায় সাদিক।

সোনিয়া থ হয়ে যায় সাদিকের কথায়। ওর প্রথমেই মনে হয় – মালার ননদের সাথে সাদিকের কি সম্পর্ক যে বাসর ঘরে বউকেও তার মতো লাগছে দেখতে। মনটা খারাপ হয়ে যায় সোন#সংসারের_সাতকাহনপেয়েছে খুব, তার উপর বাসর রাতেই বরের মুখে পরনারীর কথা, মুখটা থমথমে হয়ে যায় সোনিয়ার। সাদিক কিছুক্ষন সোনিয়ার রিএকশন দেখে বলে, “শামিমার দুই ছেলেমেয়ে আমাকে অনেক পছন্দ করে।”

সোনিয়ার মনটা আরেকটু খারাপ হয়। ও বলে, “আমি ঘুমাবো, ঘুম পেয়েছে।” তখন সাদিক বলে, “আমরা না ঠিক করলাম সারারাত গল্প করব। তুমি এখনই ঘুমাতে চাও?”
“শামিমার গল্প? সারারাত ধরে আমাদের গল্প করতে চেয়েছিলাম। অন্য কারো না।” বলে পাশ ফিরে শোয় সোনিয়া।
সাদিক মিটিমিটি হেসে বলে, “যাক আগুন তাহলে ধরাতে পেরেছি।”
এক ঝটকায় সাদিকের দিকে হয়ে জিজ্ঞেস করে সোনিয়া, “কিসের আগুন?”
“ভালোবাসার আগুন। আমি শুনেছিলাম তোমাকে নাকি রাগলে বেশি সুন্দর লাগে। বিয়ের পরেই তো আমার উপর এমনিতে রাগ করবানা, কয়দিন পরে চলে যাব, এই সময়ের মধ্যেও রাগ করার সম্ভাবনা কম। তাই নিজেই রাগিয়ে দিলাম। তাতে যা বুঝলাম একা আন্টি ভুল বলেননি। আসলেই তুমি রেগে গেলে সুন্দর বেশি লাগে।” হাসতে হাসতে বলে সাদিক, “শামিমা মালার ননদ ঠিকই কিন্তু ওর সাথে আমার কোন সম্পর্ক নাই যেটা তুমি ভাবছ। তবে হ্যাঁ, তোমার সাথে সত্যিই ওর চেহারার মিল আছে। অন্যদের জিজ্ঞেস করলেও জানতে পারবে। আর সবচেয়ে বড় কথা শামিমা আমার চেয়ে বয়সে বড়। সম্পর্কে আমি বড় তাই নাম ধরে ডাকি। মাথা ঠান্ডা হয়েছে?”

“রাগ দিয়ে সংসার শুরু করলে, এর পরবর্তী রিএকশন সহ্য করতে পারবে?” বলে সোনিয়া। উত্তরে সাদিক বলে, “দেখিইনা কি হয়। তুমি রাগবে, আমি চেয়ে চেয়ে তোমাকে দেখব। এখন যেমন দেখছি।”

লজ্জা পেয়ে যায় সোনিয়া। ঘুমে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসে বারবার, কিন্তু কথা দিয়েছে সারারাত জেগে গল্প করবে তাই ঘুমাতেও পারছেনা। জেগে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে আর শুনছে সাদিকের বিদেশের জীবনের গল্প।

প্রবাসী ছেলের সাথে বিয়ে হচ্ছে শুনে অনেকেই ওকে ভয় দেখিয়েছিল যে প্রবাসী ছেলেরা যেহেতু দেশে স্ত্রীকে অল্পদিন কাছে পায় সেহেতু তারা খুব অধৈর্য হয়। স্ত্রীর মনের অলিগলি খোঁজার চেয়ে শরীরের অলিগলি খুঁজতেই বেশি আগ্রহী হয়। কিন্তু সাদিকের মধ্যে তেমন কিছুরই লক্ষন দেখা যায়না। সাদিকের প্রতি শ্রদ্ধা জেগে যায় সোনিয়ার মনে।

গল্প করতে করতে ফজরের আজান কানে আসে দুজনের। তখন সোনিয়া নামাজের কথা বললে সাদিকও উঠে ওর সাথে অজু করে নামাজে দাঁড়ায় দুজন। নামাজ সেরে উঠে সোনিয়া জানায় সকালে ওকে স্কুলে যেতে হবে তাই একটু হলেও ঘুমানো দরকার।

ফজরের পরে ঘুমিয়ে ওদের ঘুম ভাংগে সকাল ১০টায়। ঘুম থেকে উঠে সোনিয়া গোছল করে এসে সাদিককে ডাক দেয়। সাদিক গোছল করে এলে দুজনে রেডি হয়ে নিচে যায়। সোনিয়া বেছে বেছে এমন একটা শাড়ি পরে যেটাতে কুঁচি সহজেই হয়ে যায় কারও হেল্প ছাড়াই। তারপরেও সাদিক গোছল করে বের হলে ওকে অনুরোধ করে কুঁচি ধরার জন্য। সাদিক বুঝতে পারেনা ঠিক কুঁচি ধরতে বলে সোনিয়া আসলে ওকে পরীক্ষা করছে। না জেনেই সাদিক উত্তীর্ণ হয় সেই পরীক্ষায়।

বিয়ের পরে সোনিয়ার এক কাজিন ওকে ফোন করে বলে পরদিন সকালে সাদিককে কুঁচি ধরতে বলতে। যদি সে বিনা বাক্য ব্যয়ে খুশী হয়েই কুঁচি ধরে তাহলে ছেলে ভালো নইলে যদি মানা করে দেয় তাহলে ছেলে ঘাউড়া, সোনিয়ার সামনের দিন খারাপ হতে বাধ্য। সাদিক খুশীমনেই কুঁচি ধরায় মনে মনে খুব খুশী হয় সোনিয়া, সাদিকের প্রতি ওর শ্রদ্ধা আরও বেড়ে যায়।

ওরা দুজন রেডি হয়ে নিচে যায় সকালের খাওয়ার জন্য। গিয়ে দেখে সোনিয়ার মা বাবা দুজনেই স্কুলে চলে গেছেন। বাসায় আছে শুধু সোনিয়ার দুই কাজিন। ওরাই সাদিকের নাস্তার ব্যবস্থা করে। নাস্তা করে বের হয়ে যায় সাদিক আর সোনিয়া। প্রথমে যায় একটা মিষ্টির দোকানে, মিষ্টি কিনে নিয়ে যায় সোনিয়ার স্কুলে। সবাই খুব খুশি হয়ে সাদিকের সাথে কথা বলে, অফিস থেকে সাদিকের আপ্যায়ন করা হয়। স্কুলে দেখা করে পরবর্তী ৩ দিনের ছুটি নেয় সোনিয়া।

স্কুল থেকে বের হয়ে নভেম্বরের মিষ্টি রোদে রিকশা নিয়ে ঘুরে দুজন। দুপুরে বাসায় ফিরে আসে। দেখে তখনও সোনিয়ার মা স্কুল থেকে ফিরেননি আর ওর কাজিন দুপুরের রান্না করছে। সাদিককে নিচে বসিয়ে রেখে সোনিয়া উপরে যায় একার কাছে। গিয়ে বলে, “দেখছেন আন্টি, আজ আম্মু স্কুলে বলে তাড়াতাড়ি চলে আসতে পারত না? বেলা আড়াইটা বাজে, রান্না এখনও চুলায়। জামাইকে দুপুরের ভাত দিবে কখন?”

সোনিয়ার মায়ের স্কুলে ফোন দেয় একা, জিজ্ঞেস করে কখন আসবে? জানতে পারে চারটায় স্কুল ছুটি হলে আসবে। গজগজ করতে করতে নিচে নেমে আসে সোনিয়া। কিন্তু সাদিকের সামনে এসে নিজেকে সামলে নিয়ে হাসিমুখে কথা বলে। বাসায় সোনিয়ার নানী ছিলেন, উনি সাদিকের সাথে বিভিন্ন দুষ্টামি করেন ছড়ায় ছন্দে। সোনিয়ার কাজিন রান্না কমপ্লিট করে ওদের খেতে ডাকে সাড়ে তিনটায়।

এতো বেলায় খাবারের কথায় সোনিয়া ওর মায়ের আচরণে খুবই লজ্জিত হয় সাদিকের সামনে কিন্তু মুখে কিছুই বলেনা। ওদের খাওয়া শেষ হবার পরেই বাসায় ফিরে সোনিয়ার মা। এসেই সাদিককে উদ্দেশ্য করে বলে, “বাবা আমি খুবই সরি। ঈদের পরে আজই স্কুল খুলেছে। আমি হেডআপাকে বলেছি গতকাল তোমাদের বিয়ের কথা তাও উনি আমাকে দুপুরের আগে ছাড়লেন না। আমি খুবই সরি বাবা, প্রথম দিনেই আমার বাসায় তোমার দুপুরের খাবার এতো দেরিতে হচ্ছে।”

“কোন ব্যাপার না আম্মা। আমরা সকালে দেরি করেই খেয়েছি, ক্ষুধাও লাগেনি। আপনি ভাববেন না প্লিজ। আমিও জব করি, জানি অন্যের ইচ্ছায় চলতে হয়। আমি কিছুই মনে করিনি। আপনি সারাদিন স্কুল করে এসেছেন, ফ্রেশ হয়ে নিন প্লিজ।” – উত্তরে বলে সাদিক।

সোনিয়ার মায়ের চোখে পানি এসে যায় সাদিকের কথা শুনে। মনে মনে ভাবেন – পরের ছেলে আমার কষ্ট বুঝল অথচ নিজের মেয়ে ফোনে রাগ করল আমার সাথে। যাক, ছোট মানুষ বুঝেনি। সাদিকের সাথে আমার জেদি, রাগী মেয়েটা ভালো থাকবে ইনশাআল্লাহ্‌। ছেলেটা বুঝদার আছে। মন থেকে ওদের জন্য অনেক দুয়া করেন।

দুপুরে খেয়ে একটু রেস্ট নিতে যায় সোনিয়া ও সাদিক। হঠাৎসাদিকের ফোন বেজে উঠে। তাকিয়ে দেখে ওর মা কল দিয়েছেন। উনি বলেন, “কাল তো সোনিয়াকে আনতে পারিনি, আজ সন্ধ্যার পরে মালা যাবে সোনিয়াকে আনতে। আমি সোনিয়ার মাকে কল দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছি। তোরা রেডি থাকিস।” সাদিক জানায় সোনিয়াকে আজ অক শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে। সোনিয়া হ্যাঁ না কিছুই বলেনা। সারারাত জেগে দুজনেই ক্লান্ত তাই ঘুমিয়ে যায়। এবার সোনিয়ার ঘুম ভাংগে দরজায় নক শুনে। ঘুমন্ত সাদিককে রেখে বের হয়ে আসে সোনিয়া, দেখে দরজায় ওর মা দাঁড়িয়ে।

সোনিয়া ওর মায়ের সাথে অন্য রুমে গিয়ে বসে, ওর মা সোনিয়ার হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলে, “হুট করে বিয়ে হয়ে গেল সাদিকের জন্য কিছুই কেনাকাটা করতে পারলাম না। তুই ওকে মার্কেটে নিয়ে গিয়ে শার্ট প্যান্ট কিনে দে। তোর শাশুড়ি ফোন করেছিলেন। সন্ধ্যার পরে মালাকে পাঠাবেন তোকে নিয়ে যেতে। মায়ের বাড়ির পাট তোর শেষ হল রে মা। তোর বাড়ি এখন ঐটাই, তাই বলে ভাবিস না আমরা পর হয়ে যাচ্ছি। আমাদের দরজা তোর জন্য সবসময়ই খোলা থাকবে।” সোনিয়া কিছুক্ষন চুপচাপ মায়ের হাত ধরে বসে থাকে।

রুমে গিয়ে দেখে সাদিকের ঘুম ভেংগে গেছে, ও হাতমুখ ধুয়ে বসে আছে। কালো শার্ট, কালো প্যান্টে টল ডার্ক হ্যান্ডসাম সাদিককে এতো সুন্দর লাগছে যে চোখ ফেরাতে মন চাচ্ছেনা সোনিয়ার। সোনিয়ার পায়ের শব্দে সাদিক ওর দিকে তাকিয়ে দেখে সোনিয়া ওকেই দেখছে। ওর তাকানো দেখে মিষ্টি করে হেসে বলে, “ঘুম ভাংলো? চল একটু মার্কেটে যাবো। তোমার কিছু কেনাকাটা করতে হবে।”

সাদিক খেয়াল করে দেখে সোনিয়া মুখে হাসি থাকলেও চোখ হাসছে না ওর। কি যেন গভীর বিষাদ দেখা যাচ্ছে ওর চোখে। হাত দিয়ে টেনে পাশে বসায় সোনিয়াকে, জিজ্ঞেস করে, “কি ব্যাপার মন খারাপ কেন আমার বৌয়ের?” সোনিয়া হেসে বলে, “কই না তো।” “আমি স্পষ্ট দেখছি তোমার মন খারাপ, মুখে হাসছ ঠিকই কিন্তু হাসিটা খুলছে না। কি হয়েছে আমাকে বল। জানোত এখন তোমার সবচেয়ে আপন আমি।”

“মেয়েদের বিয়ে হলেই বাপের বাড়ি ছেড়ে যেতে হয় কেন? কি হয় বিয়ের পরেও বাবামায়ের সাথে থাকলে?” হাউমাউ করে কেঁদে দেয় সোনিয়া। সাদিক ওকে বুকে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, “আজ তোমার যেতে ইচ্ছে করছে না? ঠিক আছে তাহলে আজ যাবোনা। যেদিন যেতে চাও সেদিনই যাব। কোন জোর নাই। তবে আমি দেশে থাকতে থাকতে তোমাকে ও বাড়িতে আমার পরিবারের সাথে এডজাস্ট হতে দেখলে আমার ভালো লাগবে। কিন্তু তার জন্য তাড়াহুড়ার কিছু নাই।”

চোখ মুছে সোনিয়া বলে, “না আজই যাব ইনশাআল্লাহ্‌। চল একটু বাইরে যাই।” বলেই সোনিয়া রেডি হচ্ছে সেই সময় কল দেয় সাইফ। সাইফ বলে সাদিককে, “এই কই তোমরা? তোমাদের জন্য সারপ্রাইজ আছে। বাইরে এসো।”
কি সারপ্রাইজ?….
#সংসারের_সাতকাহন
পর্ব ১০
©সৈয়দা রাজিয়া বিল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here