বইছে আবার চৈতি হাওয়া ২৬.

0
236

বইছে আবার চৈতি হাওয়া
২৬.

-আশিক ভাই
আশিকের ধ্যান ভাঙলো। কবিতার জগৎ থেকে বেরিয়ে আনমনে তাকালো। বলল
-হ্যাঁ, বলো মিরা
-আমি আজকে যাই আশিক ভাই
– তুই কি আমার কাছে কোন কাজে এসেছিলে?
– না তেমন জরুরী কিছু না। অন্য সময় বললে ও হবে
আশিকের একটু খারাপ লাগলো, হয়তো মীরা কোন কাজে এসেছিল কিন্তু এখন অস্বস্তি বোধ করছে। আশিক অনেকটাই সামলে উঠেছে। খুব অদ্ভুত কারণে কেন যেন মীরা আসাতে ওর খুব ভালো লাগছে। মন খারাপ ভাবটা কেটে গেছে। আশিক কৌতুহলি হয়ে বলল
– তোমার পেজের খবর কি মিরা? নতুন কোন অর্ডার পেয়েছো?
– আসলে সেটা বলতেই এসেছিলাম। একটা বেশ বড় অর্ডার পেয়েছি। কিভাবে কি করব বুঝতে পারছি না
– কিরকম অর্ডার?
মিরা অর্ডারের ব্যাপারটা বলল; তারপর বলল
-কেমন একটু ভয় ভয় লাগছে, এত বড় অর্ডার। কাজগুলো করতে অনেক সময় লাগবে। এত কষ্ট করার পর, কোন কারনে যদি ক্যান্সেল হয়ে যায়?
-একটু রিস্কতো আছেই। আমি বলব যে, তুমি ডিজাইনটা একটু ভালো করে কর; তারপর তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করো। ডিজাইন ফাইনাল হলে তুমি এস্টিমেটেড কস্ট দাও আর ওদেরকে বল ফিফটি পার্সেন্ট এডভান্স করতে।
– এডভান্স করতে বলব? মীরা অবাক হয়ে জানতে চাইল
-দেখো এতগুলো জিনিস তৈরি করতে তোমার যথেষ্ট খরচ হবে। খরচের চেয়েও বড় কথা তোমার অনেকখানি সময় নষ্ট হবে। এরপর যদি কোন কারনে অর্ডারটা ক্যান্সেল হয়ে যায় সে ক্ষেত্রে এতগুলো আইডেন্টিক্যাল সেট নিয়ে তুমি কি করবে?
– উনারা যদি রাজি না হয়?
– বুঝিয়ে বললে নিশ্চয়ই রাজি হবে। তুমি তো আর এডভান্স হিসেবে চাইবে না। তুমি বলবে তোমার মেটেরিয়াল কিনতে টাকা লাগবে। তুমি স্টুডেন্ট। এতে করে ওদেরও একটা লাইবেলিটি আসবে।

মীরা বেশ আশ্বস্ত বোধ করল। বলল
-আমি কয়েকটা ডিজাইন ঠিক করে রেখেছি কোনটা ফাইনাল করবো বুঝতে পারছি না। তারপর খুব আবদারের গলায় বলল
-আপনাকে একটু দেখাই?
ওর বলার ধরন দেখে আশিক হেসে ফেলল। বেচারা বোধহয় কারো সঙ্গে এগুলো শেয়ার করতে পারেনা; তা নাহলে এসব মেয়েদের গয়নার ডিজাইন ওকে দেখাচ্ছে? আশিক হাসতে হাসতে বলল
-দেখাও
– এক মিনিট ফোনটা নিয়ে আসছি।
চা বানাতে যাবার সময় ওর ফোনটা চার্জে দিয়েছিল। দৌড়ে নিয়ে এসে তিন-চারটা ছবি দেখালো। আশিক বিশেষ মনোযোগ দিতে পারল না। কেমন যেন আচ্ছন্ন লাগছে। মীরা খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। আবার সেই মিষ্টি গন্ধটা পাচ্ছে ও। প্রসাধনের গন্ধ, সাবানের কিংবা তেলের গন্ধ ; অথবা হয়তো ওর শরীরের গন্ধ। আশিক নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
-আমাকে একটু বের হতে হবে
মীরা একটু অপ্রস্তুত বোধ করল। তাড়াতাড়ি করে বলল
-আচ্ছা আমি চলে যাচ্ছি। আপনাকে অনেক বিরক্ত করলাম। আসলে এগুলো নিয়ে কারো সঙ্গে কথা বলতে পারি না তো, তাই….
– এত অস্বস্তি বোধ করার কিছু নেই। কোন সাহায্য লাগলে আমাকে বলবে
– থ্যাঙ্ক ইউ

অফিস তালা বন্ধ করে নিচে নেমে এলো দুজন। আশিক বলল
-তুমি কোথায় যাবে? হলে?
-না একটু নিউ মার্কেটে যাব। কয়েকটা জিনিস কিনতে ভুলে গিয়েছিলাম। আপনি কোথায় যাবেন?
আশিকের আসলেই কোথাও যাবার নেই। মিরাকে এড়ানোর জন্য বলেছিল। হুট করে কিছু মাথায় আসছে না।
– আজিমপুরে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাব
– ও, তাহলে তো ওই দিকেই। চলেন একসঙ্গে যাই।
আশিক আর কোন অজুহাত খুঁজে পেল না। অগত্যা একটা রিকশা নিয়ে নিউমার্কেটের উদ্দেশ্যে রওনা দিল দুজন। অনেকক্ষণ দুজনের কেউ কোন কথা বলল না। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চারিদিকে নিয়নের আলো জ্বলে উঠেছে। নিউ মার্কেট প্রায় চলে এসেছে। আশিকের একটু মন খারাপ লাগছে, আর হয়তো এভাবে কখনো মীরার সঙ্গে রিক্সায় ওঠা হবে না। না হলেই ভালো, কি দরকার অহেতুক মায়া বাড়িয়ে। মীরা হঠাৎ করেই বলল
– আমার মন খারাপ হলে আমি কেনাকাটা করি এতে মন খুব দ্রুত ভালো হয়ে যায়।
– তাই নাকি?
-আপনিও ট্রাই করে দেখতে পারেন। চলুন আপনাকে একটা দোকানে নিয়ে যাই। আমি ওখানে প্রায়ই যাই।

মীরা ওকে একটা বইয়ের দোকানে নিয়ে গেল। এই দোকানটায় আশিক প্রায়ই আসে। দোকানিরা ওকে ভালই চেনে। দেখেই সালাম দিল। জানতে চাইলে কি লাগবে। আশিক একটা হাত তুলে বুঝিয়ে দিল আজকে কিছু নেবে না। মীরা ঝটপট দুটো বই কিনে ফেলল। তারপর বলল
-আপনি কিছু কিনবেন?
-ঠিক আছে
-তাহলে চলেন যাই
বাইরে বেরিয়ে একটা বই আশিকের হাতে দিয়ে বলল
-এটা আপনার জন্য
-তোমারও মন খারাপ নাকি
– না আমার মন খারাপ না। আমার মন খুবই ভালো; তবে মাঝে মাঝে মন ভাল থাকলেও বই কিনলে আরো ভালো হয়ে যায়।
মীরা হাসছে , হাসছে আশিক নিজেও। এক মুহূর্তের জন্য ওর মনে হল সময়টা যদি এখানেই থমকে যেত।

আশিকের চমক ভাঙ্গল ফোনের রিংটোন এর শব্দে। মীরার ফোন বাজছে মীরা হাতের ব্যাগ পত্র গুছিয়ে ফোনটা কানে গুঁজে বলল
– হ্যাঁ শুভ বলো
– তুমি কোথায় মীরা?
-নিউমার্কেটে, কেন?
– একা?
– না আশিক ভাই আছেন সঙ্গে
শুভর চোয়াল শক্ত হলো , তবে ও সেটা প্রকাশ করল না ,আন্তরিক কণ্ঠে বললো
– আমিও এখানেই আছি। পেছন ফিরে দেখো

মীরা পেছন ফিরে অবাক হয়ে গেল। শুভকে রিকোয়েস্ট করলেও ও এখানে আসতে চায় না। শুভ হাসতে হাসতে হাত নাড়ছে। মীরার মুখে একরাশ হাসি ফুটে উঠলো। আজকের দিনটা সত্যিই খুব ভালো। শুভ এগিয়ে এসে আশিকের সঙ্গে হাত মেলালো; তারপর বলল
-কিরে দোস্ত কি খবর?
– এইতো, এখানে একটা কাজে আসছিলাম। তোরা থাক আমি গেলাম।
আশিক এগিয়ে গেল। মীরার কাছ থেকে বিদায় ও নিল না। মীরার একটু খারাপ লাগলো।কি হতো একবার বলে গেলে।শুভ বলল
-চলো কোথাও বসি
-আচ্ছা

মার্কেট থেকে বেরিয়ে আশিক আর রিক্সা নিলো না, হাঁটতে হাঁটতে ক্যাম্পাসের ভেতরে ঢুকে পড়ল। আজ আবার একটু শীত পড়েছে। শীতের সাথে বিষন্নতার কি একটা গভীর সম্পর্ক আছে? আছে বোধ হয়। শীতের রাতে মন খারাপ হলে তা যেন আরো প্রকট হয়ে যায়। আশিক আরে অন্ধকারে হাটতে হাঁটতে একা একাই বললো

মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই
কেউ তা বোঝে না সকলি গোপন, মুখে ছায়া নেই
চোখ খোলা তবু চোখ বুজে আছি, কেউ তা দেখেনি
প্রতিদিন কাটে দিন কেটে যায় আশায় আশায়

মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই
বিকেল বেলায় একলা একলা পথে ঘুরে ঘুরে
একলা একলা পথে ঘুরে ঘুরে পথে ঘুরে ঘুরে
কিছুই খুঁজি না কোথাও যাই না কারুকে চাইনি
কিছুই খুঁজি না কোথাও যাই না
আমিও মানুষ আমার কী আছে অথবা কী ছিল
আমার কী আছে অথবা কী ছিল
ফুলের ভিতরে বীজের ভিতরে ঘুণের ভিতরে
যেমন আগুন আগুন আগুন আগুন আগুন
মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই

চলবে…..
আজকের কবিতা “মন ভালো নেই “ লিখেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here