বইছে আবার চৈতি হাওয়া ৩৪.

0
206

বইছে আবার চৈতি হাওয়া
৩৪.

আরিফ সাহেবের সামনে যে ভদ্রলোক বসে আছেন, তাকে দেখলে মনের মধ্যে এক ধরনের শ্রদ্ধাবোধ জাগে। হালকা-পাতলা গড়ন, পরনে সাদা পায়জামা, পাঞ্জাবি। গৌড়বর্ণ ভদ্রলোকটিকে দেখলেই বোঝা যায় এককালে যথেষ্টই সুদর্শন ছিলেন। তবে তার বাহ্যিক সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে এক ধরনের আত্নিক সৌন্দর্য চোখে পড়ে। ইনি মীরার বড়চাচা।

আসার পরে যথেষ্ট সমাদর করেই ভেতরে নিয়ে বসানো হয়েছ তাদেরকে। আরিফ সাহেব একটু আলাদা করে কথা বলতে চেয়েছেন। আশিক আর রফিক বাইরের ঘরে বসে আছে। আরিফ সাহেব টেলিফোনে জানিয়েছিলেন যে উনারা আসছেন। এখানে আসার পর উনি সমস্ত ঘটনা এজাজ সাহেবকে বিস্তারিত বুঝিয়ে বলেছেন। জানিয়েছেন যে কর্মসূত্রে ওনার কিছু লোকের সঙ্গে শত্রুতা রয়েছে। তারা প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে এই কাজটা করেছে। মীরার ওখানে আটকে যাওয়াটা একটা নিছক দুর্ঘটনা বই আর কিছু নয়। যথেষ্ট দুঃখ প্রকাশ করেছেন মীরাকে এভাবে হেনস্থা হতে হয়েছে বলে। ভদ্রলোকের মুখভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনি নিশ্চিন্ত হয়েছেন। হয়তো সকাল থেকে খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলেন। আরিফ সাহেব দীর্ঘদিন যাবত নানান ধরনের মানুষ নিয়ে কাজ করেছেন। সৎ, অসৎ, বোকা, বুদ্ধিমান ছদ্মবেশি ভালো মানুষ, সব ধরনের লোকই তার চেনা। উপরন্তু তিনি দীর্ঘদিন অন্যের বাড়িতে আশ্রিত ছিলেন। মানুষের মেজাজ মর্জি বুঝে তাকে চলতে হয়েছে। তাই কারো মুখ ভঙ্গি দেখেই আচ করে ফেলতে পারেন কার মাথায় কি চলছে। সে দিক দিয়ে বলতে গেলে অবশ্য এজাজ সাহেব খোলা বইয়ের মতন। ভদ্রলোককে খুব ভালো লেগে গেল আরিফ সাহেবের। এরকম একটা পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে পারলে মন্দ হবে না। তবে মেয়েটাকে নিয়ে তিনি একটু চিন্তার মধ্যে আছেন। যতদূর শুনেছেন মেয়েটার অন্য একজনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। এইসব ঘটনার কারণে সেটা নষ্ট হয়েছে। সে ক্ষেত্রে মেয়েটার পক্ষে মেনে নেয়া একটু কষ্টকর হবে। উনার নিজেরও কি হয়নি? আর তার মাশুল দিতে হয়েছিল আশিয়াকে। উনি মনেপ্রাণে চান তার ছেলের জীবনটা যেন ওর মায়ের মতন না হয়।

এজাজ সাহেব খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতে ভিতরে চলে গেলেন। আরিফ সাহেব মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছেন কিভাবে বিয়ের কথাটা বলা যায়। উনি যথেষ্ট বাকপটু মানুষ তবুও ভীষণ নার্ভাস লাগছে, হয়তো ছেলের প্রতি অত্যধিক ভালোবাসা তাকে দুর্বল করে দিয়েছে।

এজাজ সাহেব যতটা নিশ্চিন্ত ভাব নিয়ে ভেতরে গিয়েছিলেন তার চেয়েও বেশি অন্ধকার ও চিন্তিত মুখ নিয়ে ফেরত এলেন। অস্বস্তি নিয়ে বললেন
– ভাই সাহেব, আপনারা এত দূর থেকে কষ্ট করে এসেছেন, একটু খাওয়া দাওয়া করেন।
– বাড়িতে কি কোন ঝামেলা হয়েছে?
– জী না, তেমন কিছু না
– আমাকে বলতে পারেন
– একটু পারিবারিক সমস্যা হয়েছে। এই আর কি। আমি দেখছি। আপনারা চিন্তা করবেন না।
বৈঠকখানায় খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আরিফ সাহেব ছেলে এবং রফিকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এজাজ সাহেবকে যথেষ্ট অন্যমনস্ক মনে হচ্ছে, যদিও ভীষণ আন্তরিকতার সঙ্গে খাওয়া দাওয়া পরিবেশন করছেন। তবু কেন যেন মনে হচ্ছে উনি নিজের মধ্যে নেই। আশিকদের সঙ্গে খেতেও বসলেন না।

খাওয়া দাওয়ার পর আরিফ সাহেব আশিক আর রফিককে গাড়ি করে কিছু কিনতে পাঠালেন। ওদের সঙ্গে মামুন ও এসেছে। এই মুহূর্তে ওর বাড়িতে আছে। ফেরার সময় তাকেও নিয়ে আসতে বললেন। সবাই চলে গেলে আরিফ সাহেব এজাজুল ইসলামকে ডেকে বললেন
-আপনার সঙ্গে কিছু জরুরী কথা ছিল ভাই, যদি একটু সময় দিতেন
এজাজ সাহেব বসলেন। কোন রকম ভূমিকা না করেই বললেন
-ভাই সাহেব আমার বাড়িতে একটু ঝামেলা চলছে
-যে আমি জানি
– আপনি জানেন? এজাজ সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন
-জি ,সেই বিষয়েই একটু কথা বলতে চাই
– জি বলুন
– আমি আমার ছেলের সঙ্গে আপনার ভাতিজির বিয়ে দিতে চাই
– জ্বী? কিন্তু ওর বিয়ে তো ঠিক হয়ে গেছে
– দেখেন ভাই, আপনার ছেলের অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক হয়েছিল, শুধুমাত্র এই ঘটনাটা ঘটার কারণেই আপনি এই সিদ্ধান্তটা নিলেন। এটা ওদের দুজনের কারো জন্যই ভালো হবে না।
– কিন্তু আপনার ছেলে…
– ওর বিয়েতে মত আছে। ও নিজে থেকেই বিয়ে করতে চাইছে।
এজাজ সাহেব একটু অস্বস্তি নিয়ে বললেন -দেখেন ভাইসাহেব, আমরা অত্যন্ত সাধারণ পরিবারের মানুষ। মীরাকে আমি নিজের মেয়ের মতন স্নেহ করি। আপনার ছেলের ব্যপারেতো আমি কিছুই জানিনা…..
– আমি আপনাকে আশ্বস্ত করতে পারি, নিজের ছেলে বলে বলছি না, আশিক অত্যন্ত সৎ এবং ভালো মনের ছেলে। ও এখনো পাস করেনি কিন্তু একটা ব্যবসা শুরু করেছে, কাজেই আর্থিক দিক দিয়েও…
– ভাই সাহেব, আমি আর্থিক দিকের কথা ভাবছি না। আমি চাই মীরার একটা ধার্মিক ছেলের সঙ্গে বিয়ে হোক। আপনার ছেলে কি নামাজ পড়ে?
আরিফ সাহেব অনেকটাই অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেলেন। আসিয়া বেঁচে থাকতে আশিক নিয়মিত নামাজ পড়তো। বরং উনি নিজেই ধর্মের ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন। আসিয়ার সবকিছু ওনার কাছে বাড়াবাড়ি মনে হতো। মা মারা যাবার পর ছেলেটা কেমন যেন উদাসীন হয়ে গেল। ধর্ম কর্ম ছেড়ে দিল। এমনকি মায়ের কবর জিয়ারত করতেও যায় না। বরং আজকাল উনি নিজেই ধর্মের ব্যাপারে ঝুঁকেছেন। যদিও সেটাকে সঠিক ধর্মাপালন বলা ঠিক হবে না। প্রতি শুক্রবার মসজিদে যান, রমজান মাসে রোজা রাখেন, অতটুকুই। আশিক অবশ্য ততটুকু ও করেনা। এজাজ সাহেব আবারও বললেন

– রিজিকের মালিক আল্লাহ। আর্থিক অবস্থা নিয়ে আমি ভাবি না। আমি চাই মীরা মায়ের এমন একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে হোক যে হালাল উপায়ে উপার্জন করবে। নিয়মিত নামাজ কালাম করবে।
আরিফ সাহেব ভাবনায় পড়ে গেলেন। তার উপার্জন হালাল কিনা এভাবে কখনো ভেবে দেখা হয়নি। পেশাগত কারণে তাকে অজস্র মিথ্যা কথা বলতে হয়। সত্যকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্য প্রমাণ করতে হয়। তবে তিনি কখনো নিরপরাধকে শাস্তি দেয়ার ব্যাপারে উৎসাহ দেননি, কিংবা অপরাধীকে মুক্ত করার জন্য লড়াই করেননি। আরিফ সাহেবের চিন্তিত মুখ দেখে এজাজুল ইসলামের ঠোটে মৃদু হাসির রেখা দেখা দিল। উনি বললেন
– কি হলো ভাই সাহেব, চিন্তায় পড়ে গেলেন?
এবার আরিফ সাহেব বিচক্ষণতার পরিচয় দিলেন। মৃদু হেসে বললেন
– ভাই সাহেব মা মরা ছেলে তো, বিয়ে হয়ে গেলে নামাজ-কালাম করবে ইনশাল্লাহ। আর যদি তার পেশার কথা বলেন তাহলে ও একটা ব্যবসা শুরু করেছে। ব্যবসা করা তো হালাল। আমাদের নবীজি ও ব্যবসা করতেন। আপনি চাইলে খোঁজ-খবর নিয়ে দেখতে পারেন। আমার ছেলের ব্যাপারে আলহামদুলিল্লাহ আমার বিশ্বাস আছে।
-আলহামদুলিল্লাহ! তাহলে আর আমার কোন আপত্তি নেই।
– আপনার ভাতিজির সঙ্গে কথা বলবেন না?
-তার প্রয়োজন পড়বে না। মীরা আমার কোন কথা ফেলবে না।

মীরা কাথামুড়ি দিয়ে শুয়েছিল। দরজা ধাক্কানোর শব্দে উঠে চোখ মুছে দরজা খুলল। বাইরে এজাজ সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। উনি কোন ভূমিকা না করেই বললেন
-আমি সুমনাকে পাঠাচ্ছি, তুমি তৈরি হয়ে নাও মীরা। বাদ মাগরিব তোমার বিয়ে।
মীরা চমকে উঠলো। তার মানে কি এরা সৌরভ ভাইকে কোনখান থেকে ধরে নিয়ে এসেছে? তবে কি বড় চাচা জেনে গেছে যে ওই সৌরভকে পালতে বলেছিল? চাচাকে আর কোন কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস হলোনা মীরার। ও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

হালিমার মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। কোথাকার কোন ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। উনার মত কেউ জানতেও চাইলো না। যা ইচ্ছে তাই করুক। উনি আর এসবের মধ্যে থাকতে চান না। মেঝ মেয়েকে মীরার কাছে পাঠিয়ে দিয়ে উনি রান্নার তদারকিতে চলে গেলেন।
সুমনা এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। পড়াশোনার বাইরে ওর তেমন কোন কিছুতেই বিশেষ আগ্রহ নেই। ওর উপর দায়িত্ব পড়েছে মিরাকে বউ সাজানোর। বউ সাজানো দূরে থাক সুমনা শাড়ি পর্যন্ত পরতে জানে না। সব সময় মীরাই ওকে সাজিয়ে দিত। শাড়ি পরিয়ে দিত, কোন অনুষ্ঠানে থাকলে। যেহেতু সৌরভের সঙ্গে বিয়ের সব কিছু ঠিকঠাক ছিল, কাজেই বাদবাকি প্রস্তুতি সব ঠিকই আছে, শুধু পাত্রবদল হয়েছে। নিচে রান্নাবান্নার আয়োজন চলছে। কাজী সাহেবও চলে এসেছেন। মীরা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল
-সৌরভ ভাইকে কি ওরা ধরে নিয়ে এসেছে?
-না
-তাহলে কার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে আমার?
– ঢাকা থেকে গাড়ি করে এসেছে
– কে? দেখেছিস তুই?
– তিনজন এসেছে
মিরা বিরক্ত কন্ঠে বললো
– তিনজনের সঙ্গে তো আর বিয়ে হচ্ছে না?
– না, তা কি করে হবে ?
মীরার ইচ্ছা হলে সুমনাকে টেনে একটা চড় বসিয়ে দিতে। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে বলল
-তাহলে কার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে? তুই দেখেছিস?
-হ্যাঁ
– পরিচিত কেউ? দেখতে কেমন?
– চিনি না, কিন্তু দেখতে সুন্দর
– সুন্দর মানে কি?
-লম্বা, শ্যামলা কোকরানো চুল
– এখানে সুন্দরের কি আছে?
– খুব ম্যানলি দেখতে
-ও বাবা, তুই দেখি আবার আজকাল ম্যানলি ও বুঝিস
সুমনা জবাব দিল না।
-ছেলের নাম জানিস?
– জানি, চাচা কাজী সাহেবকে বলছিলেন, তখন শুনেছি
– একটা কথার সহজ উত্তর দিতে পারিস না তুই?
-আমি আবার কি বললাম?
– ছেলের নাম কি?
– আশিকুজ্জামান
মিরা হতভম্ব হয়ে গেল। আশিকুজ্জামান? মানে আশিক ভাই? আশিক ভাইয়ের সঙ্গে ওর বিয়ে হবে? উনি এখানে কি করে এলেন?

চলবে…..

কারা কারা বই হাতে পেয়েছেন? ছবি দিবেন প্লিজ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here