বইছে আবার চৈতি হাওয়া ৪৫.

0
361

বইছে আবার চৈতি হাওয়া
৪৫.

আরিফ সাহেব তাকিয়ে আছেন। মীরা ব্যস্ত ভঙ্গিতে সকলের প্লেতে লুচি তুলে দিচ্ছে। লুচি গুলো আগে থেকে ভাজা হয়নি। মীরা গরম গরম ভেজে রান্নাঘর থেকে এনে সবার প্লেটে দিচ্ছে। লুচির সঙ্গে আলুর দম। ভাজা জিরা আর তেঁতুলের ক্বাথ দেয়াতে অন্যরকম স্বাদ এসেছে, কিন্তু সেই স্বাদ মুখে লাগছেনা আরিফ সাহেবের। উনি এক দৃষ্টিতে মিরাকে দেখছেন। মীরা খুব যত্ন করে আশিককে খাবার দিচ্ছে। তবে কি ওদের মধ্যে সব ঠিক হয়ে গেছে? কিংবা এমনও হতে পারে আশিক অসুস্থ বলে এত যত্ন করছে। উনি নিশ্চিত বিয়ের রাতে মীরা ওকে কিছু বলেছে, যে কারণে পরদিন থেকেই আশিক বাইরে রাত কাটাচ্ছে। উনি নিজেও তো তাই করেছিলেন। বিয়ের দিন রাতে আসিয়ার সঙ্গে কি কুৎসিত ব্যবহারটাই না করেছিলেন। ওনার সঙ্গে যা ঘটেছিল তাতে আসিয়ারতো কোন হাত ছিল না, তারপরও উনি তাকে সহ্য করতে পারতেন না। সেই তুলনায় মীরার ঘৃণা থাকাটা তো স্বাভাবিক। আশিকের কারণেই ওর সম্পর্কটা ভেঙে গেছে।

এই মেয়েটার মধ্যে নিজের ছায়া দেখতে পান তিনি। যখনই দেখতে পান মনে মনে আতঙ্কে শিউরে ওঠেন। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেন তার ছেলের জীবনটা যেন ওর মায়ের মতন না হয়।

– আপনাকে আর কিছু দেব বাবা? আপনি তো কিছুই খাচ্ছেন না

আরিফ সাহেব চমক ভেঙে তাকালেন।

– আর কিছু লাগবে না মা। তুমিও আমাদের সঙ্গে বসে যাও।
– আমি আর রোজি পরে খাচ্ছি।

আরিফ সাহেব আর কথা বাড়ালেন না। খাবারে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করলেন। অত্যন্ত সুস্বাদু খাবার। অনেক বছর পর এ ধরনের পদ রান্না হয়েছে। আসিয়া বেঁচে থাকতে খুব করতো এসব। আশিকের খুব প্রিয় ছিল। মীরা কি জেনে শুনেই করেছে? না কি এটা কাকতালীয় ব্যাপার? আরিফ সাহেব আবারও মীরার দিকে তাকালেন। খাবারের মাঝখানেই মীরা আশিককে ওষুধ খাইয়ে দিচ্ছে। আশিকের হাতে আলুর দমের ঝোল, তাই মিরা ওষুধ মুখে তুলে দিচ্ছে। আশিক বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অর্থাৎ এটা স্বাভাবিক নয়। আশিকের দৃষ্টি দেখে বুকের ভেতর একটা সূক্ষ্ম যন্ত্রণা অনুভব করলেন আরিফ সাহেব। মৃত্যুর কিছুদিন আগে আসিয়া খুব অসুস্থ ছিল। তখন এভাবেই তার যত্ন করার চেষ্টা করতেন তিনি। সে সময় ঠিক এরকমই বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত আসিয়া। সেই দৃষ্টিতে কি বিস্ময়ের সঙ্গে আরও কিছু মিশে থাকতো? জানা হয়নি, আর জানার কোন উপায়ও নেই। আচ্ছা আশিক কি মিরাকে আগে থেকেই ভালোবাসতো? মেয়েটা ভালো। আশিকের ওকে ভালো লাগাটা অস্বাভাবিক নয়। অবশ্য ভালো খারাপে কিছু আসে যায় না। ভালো তো আসিয়াও ছিল। কই তাকে তো ভালো লাগেনি বরং এমন একজনকে ভালো লেগেছিল যে তার ভালোবাসা পাওয়ার কোন যোগ্যতাই রাখে না।

কি এমন বয়স ছিল তখন তার। ওদের মতই, বা ওদের থেকে কমই হবে। তখন আরিফ সাহেব কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হয়েছেন। দুই ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছোট। বড় বোনের বিয়ে হয়েছিল পাশের গ্রামে। তেমন একটা আর্থিক সচ্ছলতা না থাকায় বোনের ছেলেমেয়েরা ওনাদের বাড়িতেই থাকতো। এটা অবশ্য নতুন কিছু ছিল না। আরিফ সাহেবের বাবা ছিলেন দিলদরিয়া মানুষ। কারো কষ্ট সহ্য করতে পারতেন না, অথচ তার নিজের বোন মারা গেল অল্প বয়সে। বোনের একমাত্র মেয়ে আসিয়া ছোটবেলা থেকেই তাদের বাড়িতেই মানুষ। ভীষণ রকমের লক্ষীপনা আর সংসারী ছিল মেয়েটা। সবসময় মায়ের সঙ্গে হাতে হাতে কাজ করতো। মামা বাড়িতে বড় হওয়া, আর দশটা অনাথ মেয়ের মতন জীবন ছিল না আসিয়ার। মামা-মামী তাকে নিজের সন্তানের মতন স্নেহ করতেন। আরিফ সাহেব অবশ্য কখনো এগুলি খেয়াল করতেন না। এইচএসসির পর তার স্বপ্ন ছিল ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হবার। চেষ্টা চরিত্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চান্সও পেলেন, কিন্তু ঢাকায় থাকার কোন জায়গা ছিল না তার। এখনকার মতন এত হোস্টেল ছিল না সে সময়। বাবা তার এক ছাত্রকে চিঠি লিখে দিয়েছিলেন যেন একটু থাকার ব্যবস্থা করে দেন। সেই ছাত্রের বাসায় যেয়ে আরিফ সাহেব হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। গুলশানের বিশাল বাড়ি, যদিও আরিফ সাহেবের জায়গা হয়েছিল মুলবাড়ির বাইরের দিকের কোয়ার্টারে। ড্রাইভারের সঙ্গে রুম শেয়ার করে থাকতে হতো। সেই বয়স থেকেই আরিফ ভীষণ বাস্তববাদী আর উচ্চাকাঙ্ক্ষী। তিন জোড়া মোটে শার্ট প্যান্ট ছিল তার। সেটাই ধুয়ে ইস্ত্রী করে ঝকঝকে তকতকে করে পরে যেত সবসময়। এমনিতেই আরিফ দেখতে সুন্দর, কথাবার্তায় ও খুব স্মার্ট। অনেক মেয়ে মুগ্ধ হতো তাকে দেখে, কিন্তু সেই সময়কার মেয়েরা হুটহাট ছেলেদের সাথে এত মিশতো না। আগ বাড়িয়ে মুগ্ধতা ও প্রকাশ করত না। এ নিয়ে অবশ্য তার কোন অনুশোচনা ছিল না। ওর চোখে তখন বড় হবার স্বপ্ন। এই স্বপ্নের মধ্যেই আরেকটা স্বপ্ন যোগ হলো, যেদিন প্রথম সিলভিয়াকে দেখল।

একদিন বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকতেই চোখ পড়লো ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা একটা মিষ্টি মুখ। চারিদিকে গোলাপি বাগান বিলাসের ঝাড়, মাঝখানে যেন একটা ছোট্ট পরী। আরিফের মাথা ঘুরে গিয়েছিল। একজন মানুষ এত সুন্দর কি করে হতে পারে? কেমন পুতুল পুতুল তুলতুলে বেড়ালের মতন। কিন্তু আরিফ নিজের সীমাবদ্ধতা জানে। এই ধরনের মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব কিংবা প্রেম তো দূরে থাকুক কথা বলতেও যথেষ্ট যোগ্যতা লাগে। আরিফ সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছিল।

সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস শুরু হবার পর সিলভিয়ার বাবা একদিন নিজে থেকে এসেই বলেছিলেন

– তুমি তো কোন কোচিং না করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে গেলে শুনেছি। সিলভিয়া এবার ভর্তি পরীক্ষা দেবে। ওকে একটু দেখিয়ে দিও তো।

সেই থেকে শুরু হয়েছিল আরিফের অন্দরমহলে প্রবেশাধিকার। আরিফ সাহায্য করেছিল আন্তরিকভাবেই। সেই সময়ে ওর চোখে মুগ্ধতা দেখেছিল আরিফ। দিনকে দিন সেই মুগ্ধতা বাড়তে দেখেছে ও। তবু সযত্নে এড়িয়ে গেছে। অনেকবার পড়ার ছলে ওর কাছে আসার চেষ্টা করেছে সিলভিয়া তবু আরিফ নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিল।

সেবার ঈদের ছুটিতে সবাই বাড়ি গিয়েছিল। আরিফ পরীক্ষার কারণে যেতে পারেনি। ঈদের আগের দিন রাতে আরিফ ঘুমোতে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, সেই সময় হুট করে সিলভিয়া ঘরে এসে উপস্থিত হয়েছিল। আজ এত বছর পর মনে হয় যদি তার জীবনে সেই রাতটা না আসতো তাহলে আজ তার জীবনটা অন্যরকম হতো।

মীরা বিকেলের নাস্তা তৈরি করেছে পিয়াজু ঘুঘনি আর ডালপুরি। কাল রাতে আশিক খেতে চেয়েছিল। নিচে নেমে রোজিনাকে বলেছিল আটা মাখাতে আর ডাল সিদ্ধ দিতে কিছুটা ভিজিয়েও রাখতে। রোজিনা হাসতে হাসতে বলেছিল
– কেন ভাবি? ভাইজান ডালপুরি খাইতে চাইছে?
– হ্যাঁ, তুমি কি করে বুঝলে?
– ভাইজানের জ্বর আসলে এইসব খাইতে চায়। ফ্রিজে ফ্রোজেন পুরী আছে। ভাইজা দেই?
– না আমি বানাচ্ছি। বেশি সময় লাগবে না। তুমি একটু সাহায্য করলেই হবে।
রাতে আর খাবার তৈরি করা হয়নি। আশিক ঘুমিয়ে পড়েছিল। মিরা ঠিক করেছিল পরদিন বিকেল বেলা বানাবে।
রোজিনা খুবই চটপটে আর কাজের। মীরার পক্ষে একা এত কিছু বানানো সম্ভব হতো না। মীরা এই খাবারগুলো বানানো শিখেছে ওর বড় চাচীর কাছ থেকে। বড় চাচী এই সমস্ত খাবারগুলি অসাধারণ বানায়। এমনিতে বড় চাচি ওদের দেখতে পারেনা, মায়ের সঙ্গে নিত্যদিন ঝামেলা লেগে থাকে। কিন্তু কোন কিছু শেখানোর ব্যাপারে ভদ্র মহিলা ভীষণ রকমের উদার । মীরা রান্নাবান্নার হাতে খড়ি তার কাছেই। বাড়ির সবাই তার খাবারের স্বদে মুগ্ধ। এটাও আরেকটা কারণ, যে মা বড় চাচীকে দেখতে পারে না। বাবা কখনো মায়ের রান্না খেয়ে তৃপ্ত হতো না। সারাক্ষণ বড় চাচির সঙ্গে তুলনা করত। একমাত্র বড় চাচাই বলতেন

– খাবার হল বেঁচে থাকার জন্য। আমাদের নবীজি অত্যন্ত অল্প আহার করতেন। তার প্রিয় খাবার ছিল খেজুর এবং দুধ। এসব বাড়াবাড়ির কোন দরকার নাই। সাধারণ খাবার রান্না করো।

কিন্তু বাড়ি ভর্তি বাচ্চাদের যন্ত্রণায় তাকে আবারো এসব বানাতে হতো। এবং এটা তিনি আনন্দের সাথেই করতেন। মিরা ও আনন্দের সাথেই করে। তার ও খুব ভালো লাগে এসব নতুন নতুন মুখরোচক নাস্তা তৈরি করতে।

এই বাড়িতে খুব সুন্দর সুন্দর সিরামিকের প্লেট বাকি মগ আছে। কেউ তেমন একটা ব্যবহার করে না। মীরা খাবারগুলো সুন্দর করে টেবিলে সাজিয়ে রোজিনা কে বলল
– যাও তোমার ভাইয়াকে ডেকে নিয়ে আসো
রোজিনা দৌড়ে গেল। ফিরেও এলো দ্রুতই। মিরা ওকে চায়ের জল চাপাতে বলে পিয়াজু গুলো ভেজে ফেললো। চায়ের জল ফুটে গেছে। মীরা উঁকি দিয়ে দেখল আশিক এখনো আসেনি। মিরা কপালের ঘাম মুছে রোজিনাকে আবারও, আশিক আর আফসিনকে ডাকতে পাঠালো। আফসিনকে ডাকতে হলো না। ও নিজেই নিচে নেমে এসেছে। বোঝা যাচ্ছে ঘুমিয়ে ছিল। চোখ ডলতে ডলতে এসে বসল। খাবার দেখে চোখ বড় বড় করে বলল
– ভাবি এত কিছু তুমি বানিয়েছ?
– না, আমি আর রোজিনা দুজন মিলে বানিয়েছি। কিন্তু তোমার ভাইয়া কোথায়? এখনো আসছে না যে। সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে। অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার সময় হয়ে গেছে।

– কি জানি, আমি তো বললাম
– ঠিক আছে, তুমি খাওয়া শুরু কর, আমি ডাকছি।

মীরা ঘরে গিয়ে দেখলো আশিক বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে একটা বই পড়ছে। মীরা কাছে গিয়ে বলল
– আপনাকে এতক্ষন ধরে ডাকছি, আসছেন না কেন? ওষুধ খেয়েছেন?
আশিক মুখ তুলে তাকাল। মীরার কপালে বিন্দু বিন্দুর ঘাম। আগুনের আচে মুখ লালচে হয়ে আছে। আশিক মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ওকে এইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মিরা হেসে ফেলল। তারপর বলল
– আপনি এমন ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, মনে হচ্ছে আমাকে খেয়ে ফেলবেন। আমি যখন রুমনকে ওষুধ খাওয়াতাম ও ঠিক এইভাবেই তাকিয়ে থাকতো।
আশিক ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলো
– রুমন কে?
– আমার ছোট বোন রোমানা। আমি যখন ওর মুখ চেপে ধরে ওকে ওষুধ খাওয়াতাম ও ঠিক এভাবেই তাকিয়ে থাকতো। কিন্তু তাকিয়ে থেকে লাভ হবে না। ওষুধ আপনাকে খেতেই হবে। তাড়াতাড়ি নিচে আসুন।

মিরা বেরিয়ে গেল। ওই তো সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে। আশিক তাকিয়ে আছে। ওর বুকের মধ্যে চিনচিনে একটা ব্যথা অনুভব করছে। খুব ইচ্ছা করছে মিরাকে হাত ধরে টেনে পাশে বসিয়ে….. বাকিটুকু আর ভাবতে পারছে না। আশিক হাতের বইটা রেখে বলল

আমারো আছে বুকের মধ্যে এক্ষুণি চাই ধ্বনি,
যখনই আমি তোমাকে ভাবি, তক্ষুণি তা শুনি।
সময় বসে ভেংচি কাটে- এক্ষুনি নয় সব,
আমিও বুঝি, তোমাকে পাওয়া একটু অসম্ভব।
চলবে……..
আজকের কবিতার নাম “তবু তোমাকে চাই” লিখেছেন নির্মলেন্দু গুণ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here