বইছে আবার চৈতি হাওয়া
৫০.
ছাদে উঠে আশিক থমকে গেল। ছাদের এক কোণ দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে মীরা। বাগান বিলাসের ঝাড়ের পেছনে ওর ছিপছিপে দেহাবয়ব নজরে পড়ছে। গোলাপি ফুল গুলোর আড়ালে ওর বৃষ্টিস্নাত মুখটায় চোখ আটকে গেল আশিকের। এর আগে ওকে দেখেছে অন্ধকারের অবনীলে। কখনো কোন শরীরী আকর্ষণ অনুভব করেনি ওর প্রতি , কিন্তু আজ ওকে এই অবস্থায় দেখে কেমন একটা শিরশিরে অনুভূতি হল। দুদিকে হাত প্রসারিত করা আকাশের দিকে মুখ করা ওর এই প্রতিচ্ছবিটা কেমন অপার্থিব ঠেকছে। আশিক অপলক চেয়ে রইল।
মীরা চোখ মেলে ওকে দেখে তাকিয়ে রইল দু এক মুহূর্ত, তারপর লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে পাশ কাটিয়ে নেমে গেল। মীরা চলে যাবার পর আশিক কিছুক্ষণ ছাদে হাঁটলো। বৃষ্টির পর গাছগুলো দেখতে খুব ভালো লাগে। মনে হয় যেন আজ ওদের মনে অনেক আনন্দ। কিছুক্ষণ ভেজা ফুলগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখল, তারপর রেলিং এর কাছে এসে দাঁড়ালো। বৃষ্টির পর শহর জুড়ে ব্যস্ততা নেমেছে। যে যার কাজে ছুটে যাচ্ছে। ভাড়ী বর্ষনের পর এই শহর জোড়া ব্যস্ততা দেখতে খুব ভালো লাগে আশিকের, কিন্তু আজ মন বসছে না। কেমন অস্থির লাগছে। আশিক ধীরপায়ে নিচে নেমে গেল।
ঘরে ঢুকে মোটামুটি একটা ধাক্কার মতন খেলো। মীরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুল মুছছে।ওর পরনে আকাশী নীল শাড়ী। মীরা কি গান গাইছে গুনগুন করে? মীরা পেছন ফিরে আছে। চুলগুলো একপাশে সরানো। ওর সরু কোমরের অনেকটা দৃশ্যমান। আশিকের বুকে কাপন ধরল। ও চোখ সরিয়ে নিয়ে ওয়াটার হিটারে চায়ের জন্য জল চাপালো। শব্দ শুনে মীরা পেছন ফিরে দেখল, হাতের তোয়ালে বারান্দার রেলিংয়ে মেলে দিয়ে ঘরে ঢুকে বলল
– কফি বানাচ্ছেন ?
– হ্যাঁ, তুমি খাবে?
– আপনার কষ্ট না হলে দিন
– এ কেমন কথা? তুমি আমার জন্য এত কষ্ট করলে আর আমি তোমাকে সামান্য কফি খাওয়াতে পারব না?
– আমি আবার কি করলাম?
– এই যে আমার জ্বরের সময় এত কষ্ট করলে
– তাহলে আপনিও আমার জন্য কিছু করুন
– কি করব বল
– আমাকে একটা কবিতা শোনান
আশিক অবাক হলেও সেটা প্রকাশ করল না। মীরার হাতে কফির মগ দিয়ে চেয়ারে বসলো, তারপর বলল
– কি কবিতা শুনবে বলো
– এক মিনিট দাঁড়ান, আমি এনে দিচ্ছি
মিরা আলমারির ভেতর থেকে একটা বই বের করে নিয়ে এলো, তারপর আশিকের হাতে দিয়ে কফির মগ নিয়ে বিছানার উপর বসলো। কফিতে চুমুক দিয়ে বলল
– বুকমার্ক দেয়া আছে
আশিক একবার চোখ বুলিয়ে পড়া শুরু করল
“মেয়েটা পাখি হতে চাইল
আমি বুকের বাঁদিকে আকাশ পেতে দিলাম।
দু-চার দিন ইচ্ছে মতো ওড়াওড়ি করে বলল,
তার একটা গাছ চাই।
মাটিতে পা পুঁতে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম।
এ ডাল সে ডাল ঘুরে ঘুরে ,
সে আমাকে শোনালো অরণ্য বিষাদ।
তারপর টানতে টানতে
একটা পাহাড়ি ঝর্ণার কাছে নিয়ে এসে বলল,
তারও এমন একটা পাহাড় ছিল।
সেও কখনো পাহারের জন্য নদী হোতো।
আমি ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে মেয়েটিকে বললাম,
নদী আর নারীর বয়ে যাওয়ায় কোনও পাপ থাকে না।
সে কিছু ফুটে থাকা ফুলের দিকে দেখিয়ে
জানতে চাইল,
কি নাম ?
বললাম গোলাপ।
দুটি তরুণ তরুণীকে দেখিয়ে বলল,
কি নাম ?
বললাম প্রেম।
তারপর একটা ছাউনির দিকে দেখিয়ে
জিজ্ঞেস করলো,
কি নাম ?
বললাম ঘর।
এবার সে আমাকে বলল,
তুমি সকাল হতে জানো ?
আমি বুকের বাঁদিকে তাকে সূর্য দেখালাম”।
কবিতা শেষ করে আশিক মুখ তুলে তাকালো। মীরা মুগ্ধ দৃষ্টতে তাকিয়ে আছে। আশিক বই বন্ধ করে বলল
– ভালো হয়েছে?
– অনেক সুন্দর হয়েছে। এটা আমার প্রিয় কবিতা
– তুমি বোধ হয় রুদ্র গোস্বামীর ভক্ত
– হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন।
– কেন বলতো?
– উনার কবিতা আমার সহজ লাগে
– সিরিয়াসলি মিরা? তোমার কবিতা এজন্য ভালো লাগে যে সেটা সহজ?
– বুঝতে না পারলে ভালো লাগবে কি করে?
– কবিতা শুধু বোঝার ব্যাপার নয়। অনুধাবন করারও একটা ব্যাপার আছে। তুমি জীবনানন্দ, তারাপদ রায়, মাইকেল মধুসূদন পড়ে দেখো। সমন্বয়ের একটা ব্যাপার আছে। ছন্দ নিয়েও অনেক খেলা যায়।
মীরার মেজাজ খারাপ লাগছে। এত সুন্দর একটা কবিতা পড়ার পর কি সব খটমটে ব্যাপার নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে। মীরা এড়িয়ে যেতে বলল
– কেন এই কবিতা আপনার ভালো লাগে না?
– লাগে, কিন্তু এতসব কবিতা থাকতে তুমি এটা কেন পড়তে বললে সেটা বুঝলাম না
মীরা উঠে দাঁড়িয়ে বলল
– আপনি তো কিছুই বোঝেন না
তারপর ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
আশিক কিছুক্ষণ ওর যাত্রা পথের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর হাসতে হাসতে আনমনে মাথা নাড়ল। কদিন থেকে ও লক্ষ করছে মিরা অকারনেই ওর আশেপাশে ঘুরঘুর করে। ওর ঘোর লাগা দৃষ্টি নজর এড়ায় না আশিকের। মেয়েদের এরকম মুগ্ধতা দেখে ও অভ্যস্ত। এটা নতুন কিছু নয়। প্রথম ওকে দেখে সবার মধ্যেই এক ধরনের মুগ্ধতা জন্মায়। ওর বলিষ্ঠ গড়ন, ঝকঝকে হাসি , আন্তরিক ব্যবহার, পুরুষালী ব্যক্তিত্ব মেয়েদেরকে মুগ্ধ করে; কিন্তু আশিক জানে ওকে গভীরভাবে জানলে এই মুগ্ধতা বেশী দিন থাকবে না। ওর মনের ভেতরকার অন্ধকারাচ্ছন্ন জগত আলোকিত করার মতো গভীরতা এসব হালকা ধরনের মেয়েদের মধ্যে নেই। তাই সেসব মেয়েদের ও সযত্নে এড়িয়ে গেছে।
মীরাকে ওর অন্যরকম মনে হয়েছিল। সেই মিরার চোখেও ঘোর লাগলো। একি শুধু সাময়িক মুগ্ধতা, নাকি আরো গভীর কিছু? আশিক জানে না। যদিও তাতে কিছু যায় আসে না। মীরা যেরকম ওকে ঠিক সেই রকম ভাবেই ভালোবাসে ও। হয়তো এটাই ওর নিয়তি। তা নাহলে এই পৃথিবীতে এত মেয়ে থাকতে কেন মীরার মধ্যেই তাকে খুঁজে পেল যাকে ও আজন্ম খুঁজছিল।
কতদিন জ্বরের ঘোরে টের পেয়েছে মীরার শীতল আঙুলের স্পর্শ। কতদিন ইচ্ছে করে ওষুধ খায়নি, যেন আবার জ্বর আসে। যেন আবার মীরা ওর কাছে এসে বসে। ওর সেই উৎসুক চিন্তিত দৃষ্টি অন্তরের অন্তস্থল পর্যন্ত শীতল করে দিত। মনে হতো সব উত্তপ চলে যাচ্ছে। মীরা ওকে এই কবিতা কেন পড়তে দিয়েছে ? ও কি চাইছে, আশিক ওকে এরকম কিছু বলুক? ও কি জানে এর চেয়ে আরো অনেক গভীর অনেক আবেগময় কবিতা ও লিখেছে মীরার জন্য। কোনদিন কি বলতে পারবে সেটা? ঠিক জানে না । জানে না মিরার এই ঘোর কতদিন থাকবে। হয়তো কদিন পর আর ভালো লাগবে না। আবার ফিরে যেতে মন চাইবে নিজের সত্যিকারের ভালোবাসার কাছে। কেউ কি জানে এই চিন্তাটা কতটা কাঁপিয়ে দেয় ওকে? আশিক চায় না মীরা ওর অভ্যাসে পরিণত হোক। ভালোবাসা ছেড়ে তবু থাকা যায় অভ্যাস ছেড়ে থাকা মুশকিল।
আশিক নিচে নেমে গেল। দ্বিধাবিভক্ত মনটাকে খুব কষ্ট করে একত্রিত করার চেষ্টা করল। মনের একটা অংশ বলে মিরাকে কাছে আসতে না দিতে, যেন চলে গেলেও মনটা ভেঙে না পড়ে। আর মনের অন্য অংশ সারাক্ষণ শুধু ওর কাছে থাকতে চায়। কাকে ফেলে যে কে জিতে যায় বোঝা মুশকিল।
আশিক রান্নাঘরের দরজা ধরে দাঁড়ালো। মীরা একমনে কাজ করে যাচ্ছে। কোমরে আঁচল গুঁজে দিয়েছে। পাক্কা গিন্নি লাগছে ওকে। এরকম একটা দৃশ্য ও কল্পনায় দেখেছিল। সত্যি সত্যি কখনো দেখবে ভাবতে পারেনি। মীরা চমকে তাকাল। বুকের মধ্যে ফু দিয়ে বলল
– আপনি আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছেন। এই রকম করে কেউ?
আশিক জবাব দিল না। হাসলো একটু। কি অদ্ভুত মাদকতা সেই হাসিতে। মীরা চোখ ফেরাতে পারে না। বুক ধরফর করে।
চলবে…….