বইছে আবার চৈতি হাওয়া
৫১.
মীরা টের পাচ্ছে ওর চোখ জলে ভরে উঠছে। এভাবে আরো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে হয়তো কেঁদেই ফেলবে। চট করে উল্টোদিকে ঘুরে ও ব্যস্তসমস্ত হয়ে কড়াইতে খুন্তি নাড়তে লাগলো। সেই অবস্থাতেই বলল
– কিছু লাগবে আপনার?
– একটু লাগবে।
– কি?
– তোমাকে।
মীরা ভীষণভাবে চমকে উঠল। আশিক নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
– আমার বইগুলো খুঁজে পাচ্ছি না। তুমি বোধহয় কোথাও গুছিয়ে রেখেছো। একটু পড়াশোনা করতাম, পরীক্ষা তো প্রায় এসে গেছে।
– তাই বলুন। চলুন আমি বের করে দিচ্ছি।
মীরা চপল পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল। গুছিয়ে রাখা বইপত্র বের করে দিল, আশিক সেসব নিয়ে শোবার ঘরের টেবিলেই বসলো। মীরার কাজ শেষ, তবু যেতে ইচ্ছা করছে না। কি অদ্ভুত নেশায় পেয়ে বসেছে ওকে। কোন মানুষের প্রতি এই ধরনের তীব্র আকর্ষণ ওর জীবনে এই প্রথম। এ যেন ঠিক পরিণত বয়সের প্রেম নয়, যেন সেই কিশোর বয়সের বাঁধভাঙ্গা উথাল পাথাল প্রেম। মীরার জীবনে আশিক প্রথম পুরুষ নয়, তবে অনুভূতিটা নতুন। শুভর প্রতি ওর একটা ভালো লাগা ছিল, কিন্তু যত দিন গেছে, যতটা ও শুভকে জানতে পেরেছে, সেই ভালো লাগা দিনকে দিন তলানিতে এসে ঠেকেছে। পক্ষান্তরে আশিকের প্রতি ছিল ওর গভীর বিশ্বাস আর শ্রদ্ধাবোধ; কিন্তু যত ও আশিকের কাছাকাছি এসেছে, কবে-কখন-কি করে যে ওর অনুভূতিগুলো আকার বদলেছে, ও নিজেও জানে না। যে ভালোবাসায় শুধু তীব্র আকর্ষণই থাকে না, তার সঙ্গে মিশে থাকে গভীর শ্রদ্ধাবোধ সেই ভালোবাসার শেকড় বোধহয় হৃদয়ের অনেক গভীরে যায়। এত সহজে ঝরো বাতাসে সেটা উপড়ে ফেলা যায় না।
– কিছু বলবে?
মীরাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আশিক প্রশ্ন করল। মীরা একটু চমকে গেল, হঠাৎ করে বলার মত কিছু খুঁজে পেল না। আমতা আমতা করে বলল,
– বলছিলাম যে, চা খাবেন? না একবারে খাবার দেবো?
– এখন কিছু লাগবে না।
মীরা আর কিছু বলল না। নিচে নেমে গেল। কেমন মন খারাপ লাগছে। রান্নাবান্না শেষ হয়ে গেছে। মীরা ঝটপট ডিম ভেজে ফেলল। টেবিলে খাবার সাজিয়ে একবার চট করে বাকিদের খোঁজ নিয়ে নিল। জানতে পারল ওদের ফিরতে দেরি হবে।
খাবারের আয়োজন দেখে আশিক একটু অবাক হয়ে গেল।
– তুমি কি বৃষ্টি বলে খিচুড়ি করেছ?
– এমনি করলাম।
– ভালো করেছো। আমার খিচুড়ি ভীষণ প্রিয়।
– খিচুড়ির সঙ্গে কি খেতে ভালো লাগে? গরুর মাংস?
– সেটা হলে বেস্ট হয়, তবে ডিম ভাজিও ভালো লাগে, আর আলু ভর্তাটা বোনাস।
খেতে খেতে গল্প হল অনেক। আবার সেই আগের মতন সহজ সাবলীল গল্প। কিন্তু কোথায় যেন একটা আড়াল রয়ে যাচ্ছে। মীরা টের পায় যেন একই টেবিলের পাশাপাশি দুটি চেয়ারের মাঝখানেও তাদের মাঝে অনেক দূরত্ব। যেন একটা বিশাল সমুদ্রের দুটো ছোট ছোট দ্বীপ, যারা চাইলেও কাছাকাছি আসতে পারেনা।
মীরা খাবার পর চা করলো। তারপর বলল, -চলুন ছাদে গিয়ে চা খাই।
সকালের বৃষ্টির পর কেমন একটা স্নিগ্ধ আবহাওয়া। মৃদু হাওয়া দিচ্ছে। বসবার মতন শুকনো কিছু নেই ছাদে। চেয়ারগুলো সবই ভেজা। আশিক রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। অনতি দূরত্বে মীরাও দাড়িয়ে রইল চায়ের মগ হাতে। কোন অদ্ভুত কারণে ও আশিকের চোখের দিকে তাকাতে পারছে না।
ছাদেও গল্প হল অনেকক্ষণ। এক পর্যায়ে মীরা ওর সেই প্রশ্নটা করেই ফেলল। মুখ নামিয়ে অনুচ্চ স্বরে বলল,
– আপনাকে একটা প্রশ্ন করি?
– হ্যাঁ কর।
– আপনি আমাকে কেন বিয়ে করেছেন?
অনেকক্ষণ পর্যন্ত জবাব না পেয়ে মীরা মুখ তুলে চাইল। ও ভেবেছিল আশিক হয়ত রাগ করবে। তাকিয়ে দেখল আশিকের ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি। ও বলল,
– তোমার এই প্রশ্নের জবাবটা আমি কাল দেব।
মীরা সারা বিকেল ছটফট করল। কতবার ভাবল গিয়ে বলবে কাল নয়, এখনই বলতে হবে। কিন্তু আশিক ছাদ থেকে নামছেই না। অনেক রাত করে ঘরে এল, তারপর বইপত্র নিয়ে লাইব্রেরীতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। মীরা গভীর রাত পর্যন্ত জেগে অপেক্ষা করল। তারপর একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। রাত করে ঘুমানোর দরুন ভোরে ঘুমও ভাঙলো না। যতক্ষনে ঘুম ভাঙলো, ঘরের মধ্যে রোদের হুটোপুটি। ও এক ছুটে ঘর বারান্দা এক করেও আশিকেকে কোথাও খুঁজে পেল না। ছুটতে ছুটতে ছাদে গেল, সেখানেও নেই। নিচে নেমে জানতে পারল আশিক বেরিয়ে গেছে। মীরা একটু ধাক্কা খেলো। তারপরেই মনে পড়ল, ও জানে কোথায় ওর জবাব লুকিয়ে আছে।ইশ! এতক্ষণ কেন মনে পড়েনি? মীরা দৌড়ে লাইব্রেরী ঘরে ঢুকে গেল। প্রতিদিনের মতো আজও সাইড টেবিলে খাতাটা খোলা পড়ে আছে; শুধু আজ অন্যান্য দিনের মতন কোন কবিতা নেই সেখানে। মীরার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। পুরো পাতা জুড়ে শুধু একটি শব্দ
“মাহাল কিতা”
মীরা চেয়ারের হাতল ধরে হাঁটু মুড়ে মেঝেতে বসে কান্নায় ভেঙে পড়ল। এসবের মানে কি ?
চলবে …………
শব্দটার অর্থ আমি দিতে পারতাম, ইচ্ছে করেই দিলাম না। সব কষ্ট শুধু আমিই করবো আর পাঠকেরা মজা করে পড়বে, তা তো হবে না। একটু কষ্ট তো তাদেরও করা উচিত।