বইছে আবার চৈতী হাওয়া ৫২

0
223

বইছে আবার চৈতী হাওয়া
৫২

মীরা একটানে কাগজটা ছিড়ে কুচি কুচি করে ফেলল, তারপর একদিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। রাগে, দুঃখে, অভিমানে ওর সমস্ত শরীরের অঙ্গার হয়ে যাচ্ছে। শেষ রাতের দিকে বৃষ্টি পড়েছে। বাতাসে ঠান্ডা ভাব, তবু মীরা তোয়াক্কা করল না। শাওয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঠান্ডা জলের স্পর্শে শরীর কেঁপে উঠলো। অনেকক্ষণ ভেজার পর যখন কাঁপুনি ধরে গেল, তখন হঠাৎ করেই মনে পড়ল, এমনি এমনি নিশ্চয়ই এই কথাটা লেখেনি আশিক। নিশ্চয়ই এটার কোন মানে আছে। মীরা তাড়াতাড়ি শাওয়ার বন্ধ করে মাথায় তোঁয়ারে পেঁচিয়ে, পোশাক পাল্টে বেরিয়ে এল।
ঘরের ভেতর তাকিয়ে চমকে উঠলো। পুরো ঘর পরিপাটি। দৌড়ে লাইব্রেরীতে ঢুকে দেখল ছিড়ে ফেলা কাগজের চিহ্নমাত্র নেই। মীরা দৌড়াতে দৌড়াতে নিচে নেমে গেল। রোজিনা ওকে দেখে এক গাল হসে বলল
– ভাবি নাস্তা খাইবেন না?
– রোজিনা আমার ঘরে কতগুলো কাগজ পড়ে ছিল, সেগুলো কোথায়?
– বুয়া আসছিল, ঝাড়ু দিয়া ফালাইয়া দিছে
ওর ইচ্ছা হল রাগে হাত কামড়াতে। কি যেন ছিল শব্দটা? কি, কিতা ফিতা কিছু একটা হবে। ধুর! কেন যে রাগ দেখিয়ে ছিঁড়তে গেল। মীরা বিরস মুখে উপরে চলে গেল। নাস্তা খেতে ইচ্ছা করছে না। ফোন চেক করে দেখলো আশিকের কোন ফোন আসেনি। ও নিজেই কি একটা ফোন করবে?
মীরা সারা বিকেল ছটফট করলো। সন্ধ্যার পর আর থাকতে না পেরে আশিককে ফোন করল। ওর ফোন সুইচ ওফ বলছে।

আশিক ঘরে ঢুকলো সাড়ে এগারোটা নাগাদ। ঘরের আলো জ্বলছে। বালিশে মুখ গুজে মীরা ঘুমিয়ে আছে। আশিক আলো নেভালো না। স্নান সেরে পাঞ্জাবী
পায়জামা পরে একটা সাল জরিয়ে নিল। তারপর বিছানার উল্টোদিকের চেয়ারে বসে একদৃষ্টিতে মীরার মুখের দিকে চেয়ে রইল। আজ সারাদিন ও অফিসে বসে অপেক্ষা করেছে। কখন মীরা ওর জবাব পেয়ে ফোন করবে। কিন্তু ওর ফোন আসেনি। আশিক একটা দীর্ঘ শ্বাসফেলে বাতি নিভিয়ে বিছানায় এসে বসল।

৫৩

মাথার উপর ফুলস্পিডে ফ্যান ঘুরছে। ঘরটাতে বোধহয় এসিও চালানো আছে, তবু রাসেল টের পাচ্ছে ওর জুলফির কোন বেয়ে চুইয়ে চুইয়ে ঘাম ঝরছে। এই বাড়িতে ও আগেও বহুবার এসেছে তবে এই ঘরটিতে ঢোকার সৌভাগ্য কখনো হয়নি। ছোটবেলা থেকে কৌতুহল ছিল অনেক। কিন্তু সেটা এইভাবে নিবৃত্ত হবে তা কল্পনাতেও ছিল না।

রাসেলের সামনে যে মানুষটি বসে আছে তাকে সে যথেষ্ট সমীহ করে ছোটবেলা থেকেই, তবে এই মুহূর্তে শ্রদ্ধা সমীহ সব বাদ দিয়ে যে অনুভূতিটা মনের মধ্যে কাঁপন ধরাচ্ছে সে এক অপরিসীম ভয়। আরিফ সাহেব রাসেলের দিকে তাকিয়ে আছেন চিলের দৃষ্টি নিয়ে, অবশ্য কথা শুরু করলেন অত্যন্ত অমায়িক ভঙ্গিতে ।
– কেমন আছো রাসেল? আজকাল তো আসোই না
অত্যন্ত সহজ আলাপচারিতার ভূমিকা, যদিও রাসেল জানে এ আলাপ এত সহজ হবে না। গতরাতে উনি নিজে ফোন করে রাসেলকে আসতে বলেছেন। ব্যাপারটা এত সহজ হলে নিশ্চয়ই আশিককে দিয়ে খবর পাঠাতেন। রাসেল আলতো হাতে কপালের ঘাম মুছে বলল
– জি আঙ্কেল ভালো আছি
– খুব গরম পড়েছে তাই না ?
আরিফ সাহেব বেল বাজালেন। রফিক দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে এক কোনায় মাথা নিচু করে দাঁড়ালো। রফিক কখনোই চোখে চোখে তাকায় না । কোন প্রশ্ন ও করে না।
– দুই গ্লাস আমের জুস দিয়ে যাও তো রফিক
রফিক বেরিয়ে গেলে আরিফ সাহেব আবার কথা শুরু করলেন
– আমের জুস যে এত মজার খাবার আগে কখনো বুঝতে পারিনি। এই শীতে আম পাওয়াটা কঠিন। আমার এক ক্লায়েন্ট পাঠিয়েছে ইন্ডিয়া থেকে । এ বছর দেশে ও ভালই আম হবে মনে হচ্ছে। যেরকম বৃষ্টি হচ্ছে । তুমি কি বলো?
– জি আঙ্কেল? ঠিক বুঝতে পারছি না
– বৃষ্টির কথা বলছিলাম আরকি
– ও আচ্ছা, জ্বি .. মানে..
– সেদিন বৃষ্টির সময় তুমি কোথায় ছিলে?
– জ্বি , কোন দিন?
– যেদিন আশিকের ওখানে ইন্সিডেন্টটা হয়
– আঙ্কেল আমি রাইফেল স্কয়ারের পাশে বনফুল মিষ্টির দোকানে আটকা পড়েছিলাম। আমার সঙ্গে আরো অনেকেই ছিল।
আশিক তো তোমাকে ওর ওখানে যেতে বলেছিল তাই না? মিরাকে পিক করতে ।
– জি আঙ্কেল। আমি ওখানেই যাচ্ছিলাম, কিন্তু ওই, পথের মধ্যে রিকশা থেকে পড়ে গেলা্‌ তারপর মোবাইল ভেঙে গেল আর…..
– তারপর বাড়ি ফিরলে কি করে?
– ওই আশেপাশের লোকজন একটা রিক্সা করে তুলে দিল আর কি। পায়ে ব্যথা পেয়েছিলাম…
– বলো কি! ওই বৃষ্টির মধ্যে আশেপাশের লোকজন তোমাকে রিক্সা করে দিল? বাংলাদেশের মানুষের মানবিকতা বোধ একেবারে নষ্ট হয়ে যায়নি দেখছি।
তা বাসায় পৌঁছেছ কটায়?
– সাড়ে বারোটা নাগাদ
– সরাসরি বাসায় গিয়েছিলে?
– জি আঙ্কেল
– তোমার বাসাতো শ্যামলী তাই না?
– জি, রিং রোড
– সেক্ষেত্রে তো তুমি মিরাকে নিতেই পারতে। তুমি ওই পথেই যাচ্ছিলে
– আসলে পায়ে ব্যথা পেয়েছিলাম খুব
আরিফ সাহেব ব্যাথিত মুখে বললেন
– ও তাহলে আর কি করে যাবে। তা ডাক্তার দেখিয়েছিলে?
– জি দেখেছিলাম
– কোন ডাক্তার?
রাসেল একটু ফাপড়ে পড়ে গেল। এতসব প্রশ্ন উত্তর ভেবে আসেনি ও। একটু গুছিয়ে রেখেছিল কিভাবে কি বলবে কিন্তু এখন সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। আমের জুস এসে গেছে। আরিফ সাহেব ইশারায় খেতে বলছন। রাসেল গ্লাস তুলে চুমুক দিল। অতি সুস্বাদু জুস কিন্তু খেতে চিরতার রসের মতন মনে হচ্ছে। কোনমতে গলা দিয়ে নামিয়ে বলল
– পাড়ার ডাক্তার। সামনে ফার্মেসিতে বসে
– ও আচ্ছা। মীরা যে ওখানে ছিল এই খবরটা তুমি, সুমন আর মারুফ ছাড়া তো আর কেউ জানতো না। তাই না?
– ইয়ে মানে মিরা যদি কাউকে বলে থাকে
– সেই সম্ভাবনা কম। যাইহোক, সুমনের অ্যালিবাই আছে। ও প্রিন্টিং প্রেসে ছিল সারারাত। বাকি রইল মারুফ। তোমার কি মনে হয়, মারুফ এই কাজটা কেন করেছে?
– কোন কাজটা আঙ্কেল?
– ও তোমাকে তো জানানো হয়নি। পুলিশ দরজাটা পরীক্ষা করে জানতে পেরেছে যে দরজা আটকে যায়নি। কেউ বাইরে থেকে লক করে দিয়েছিল এবং এটা কেউ ইচ্ছাকৃতভাবেই করেছে। এখন প্রশ্নটা হচ্ছে কে করেছে? এখানে কার স্বার্থ জড়িত থাকতে পারে। তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে ইনফরমেশনটা কার কাছে ছিল। তোমার কি মনে হয় মারুফ এই কাজটা কেন করেছে?
– আঙ্কেল আমার মনে হয় মারুফ মীরাকে পছন্দ করে। ওরা একই এলাকার……
আরিফ সাহেব হাসতে হাসতে বললেন
– যদি সেটাই হয়ে থাকে, সেই ক্ষেত্রেতো মারুফের সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে মীরাকে ওখান থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার কথা। বন্ধুর সঙ্গে ওকে এক ঘরে আটকে দেয়ার কথা নয়।
আমি ঠিক …
রাসেল মনে মনে অনেক কিছু ভেবে রেখেছিল। অনেক যুক্তি দাড় করিয়ে রেখেছিল কিন্তু এই লোকটার সামনে সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগছে। তবে ও মনে মনে একটা খুশির ঢেউ টের পাচ্ছে। যাক, সন্দেহের তীরটা ওর দিক থেকে ঘুরে মারুফের দিকে গেছে।
আশিককে তোমার কেমন লাগে রাসেল?
আচমকা এই প্রসঙ্গ পরিবর্তনে রাসেল একটু হকচকিয়ে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
– জি? জি মানে …। ভালো
– হ্যাঁ, আশিক আসলে ওর মায়ের মতন হয়েছে। হুট করে রেগে যায়। আবার সহজে ক্ষমাও করে দেয়। একেবারেই আমার মতন হয়নি। আমি আইনের লোক তো, ক্ষমা টমা করতে পারি না। দোষ করলে শাস্তি পেতে হবে এই নীতিতেই বিশ্বাস করি। যদিও আমার বিশ্বাস অবিশ্বাসে কিছু যায় আসে না, যেটা সত্য সেটা তো বের হয়ে আসবেই। গেটের বাইরে একটা ক্যামেরা লাগানো ছিল। কেউ একজন উঠে দরজাটা লক করেছে। অন্ধকারে তার মুখ ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না, তবে একটা স্পেশাল টিম গঠন করা হয়েছে। দ্রুতই তারা বের করে ফেলবে।

রাসেল কাঠ হয়ে বসে রইল। আরিফ সাহেব আবার বেল বাজালেন। রফিক এলে দাড়িয়েছে। তিনি থম্থমে গলায় বললেন
– আর এক গ্লাস আমের জুস দিয়ে যাও তো

রাসেল কুল কুল করে ঘামতে লাগলো।

চলবে…………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here