বইছে আবার চৈতী হাওয়া ১৪.

0
420

বইছে আবার চৈতী হাওয়া

১৪.
আশিক বাসায় ফিরলো অনেক রাত করে। আজ ওর মন ভালো নেই। আজ মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী। কেমন করে ও আজকে দিনটা ভুলে গেল। আগেতো কখনো এরকম হয়নি। বাসায় ফেরার পর মনে পড়েছে। অনুষ্ঠান নিয়ে এত ঝামেলার মধ্যে ছিল যে দিন তারিখের হিসাব ছিল না। বাসায় ফিরে দেখল বাবার মুখ থমথমে। ভেবেছিল বাবা হয়তো কিছু কড়া কথা শোনাবে। সেটা হলে হয়তো এত মন খারাপ লাগত না। কিন্তু বাবা কিছুই বলেননি। কেমন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন ওকে দেখে। সেই দীর্ঘশ্বা্সের মধ্যে মিশেছিল একরাশ হতাশা।

মা বেঁচে থাকতে কখনো তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে দেখেনি বাবাকে। আর এখন তার আচার-আচরণ দেখলে মনে হয় স্ত্রীর কত অন্তপ্রাণ ছিলেন। সচরাচর আশিকের কাছে এটা অভিনয় মনে হয়। তবে আজ কেন যেন খুব খারাপ লাগলো বাবার ফুলে উঠা চোখ দেখে। আশিক আস্তে আস্তে হেঁটে আফসিনের ঘরে চলে গেল। পড়ার টেবিলের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা। চশমাটা পর্যন্ত খুলেনি। পাশে দুধের গ্লাস ঢাকা দিয়ে রাখা। আশিক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মা বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই এমনটা হতো না। কত যত্ন করেই না খাওয়াতো। আচ্ছা, আশিক যদি এখন একটা বিয়ে করে তবে তার বউ কি পারবে এই সংসারটাকে ধরে রাখতে? বিয়ের কথা ভাবলেই অবশ্য ভয় করে ওর। বাবা মায়ের মধ্যে একটা অসুস্থ সম্পর্ক দেখেছে ছোটবেলা থেকে।

আশিক খুব আস্তে আস্তে আফসিনের চশমাটা খুলে দিল, তারপর ওকে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। কম্বলটা গায়ে দিয়ে লাইট বন্ধ করে দরজা টেনে নিজের রুমে চলে গেল। বাইরে থেকে ওকে অগোছালো, এলোমেলো মনে হলেও ভেতরে ভেতরে আশিক অসম্ভব গোছানো একটা ছেলে। যে কেউ ওর ঘরে ঢুকলেই সেটা বুঝতে পারবে।

এই ঘরটা আগে আশিকের মায়ের ছিল। নিচে আলাদা একটা চেম্বার থাকা সত্ত্বেও আরিফ সাহেব উপরে আলাদা আরেকটা অফিস বানিয়েছিলেন। বইপত্র টেবিল চেয়ারের সঙ্গে একটা খাট ও ছিল সেখানে। বেশিরভাগ সময় ওখানেই থাকতেন। আসিয়া মারা যাবার পর আশিক খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। মায়ের মৃত্যুটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। সেই পুরোটা সময় ও এই ঘরেই ছিল। এরপর সুস্থ হয়ে ওঠার পর এই ঘর থেকে আর যাওয়া হয়নি। পরবর্তীতে আশিক ঘরটাকে নিজের মতো করে গুছিয়ে নিয়েছে। ঘরের সঙ্গে লাগোয়া একটা বড় ক্লজেট ছিল। ইউনিভার্সিটিতে ওঠার পর আশিক ওটাকে নিজের লাইব্রেরী বানিয়েছে। পুরোনো দিনের বাড়ি বলে ঘরটা যথেষ্টই বড়, সঙ্গে বিশাল বারান্দা। নিজের ঘরে খুব একটা আসবাব রাখেনি আশিক, শুধু মায়ের খাটটা রেখে দিয়েছে আর লেখার টেবিল। একপাশে একটা ছোট কফি কাউন্টার। করেছে। রাত জেগে লেখালেখি করলে আশিক নিজেই নিজের জন্য কফি বানিয়ে খায়। নিচে যেতে ইচ্ছে করে না আর। লাইব্রেরীটা ওর ভীষণ প্রিয়। দেয়াল জোড়া বইয়ের তাক। একপাশে একটা ইজি চেয়ার রাখা, তার পাশে ছোট্ট টি-টেবিল। মায়ের গাছের খুব শখ ছিল। পুরো ছাদ জুড়ে বাগান করেছিল। আশিক ওখান থেকে মায়ের প্রিয় কিছু গাছ এনে নিজের বারান্দায় রেখেছে। আরিফ সাহেব অবশ্য মালি রেখেছেন। তারা নিয়মিত ছাদের গাছের পরিচর্যা করে। আশিকের ছাদে যেতে খুব ভালো লাগে। প্রতিদিনই ভরে উঠে ও ছাদে যায়।

আশিক অনেক সময় নিয়ে স্নান করল, তারপর গরম কফির মগ নিয়ে ছাদে চলে গেল। ওদের বাড়িটা দোতালা। আশেপাশে বড় বড় বিল্ডিং হলেও আরিফ সাহেবে পুরনো বাড়িটা ভাঙেননি। এর চেয়ে আর বড়ও করেননি। আসিয়া খুব যত্ন করে সবকিছু সাজিয়েছিল অথচ এক বছরও থাকতে পারলো না।

ছাদের এই কোনটা আশিকের খুব প্রিয়। পাশে একটা বড় হাসনাহেনার ঝাড়। আশিক রেলিং এর উপর কফির মগ রেখে রেলিঙে ভর দিয়ে দাঁড়ালো। রাত গভীর হয়েছে। রাস্তায় জনসমাগম কম। সোডিয়াম লাইটের হলদেটে আলোয় চেনা শহরটাকেও বড্ড অচেনা লাগছে। কুয়াশা পড়েছে বেশ। আশিক অন্যমনস্ক হয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল। আজ সন্ধ্যা বেলায়ও দেখেছে ওকে। একই জায়গায় দাঁড়িয় ছিল। তবে আজ পরনে ছিল শাড়ি।তবু চিনতে ভুল হয়নি। আজ ঠিক করেছিল কথা বলবে ওর সঙ্গে। কিন্তু পারেনি। কাছাকাছি আসার আগেই রাস্তা পার হয়ে হলের ভেতর ঢুকে গেছে মেয়েটা। তবুও একটা জিনিস জানা হলো যে ও কোথায় থাকে। আশিক ঠিক করেছে ওকে খুঁজে বের করবে I যদি সত্যি সত্যি কোনদিন ওকে পায় তবে খুব যত্ন করে রাখবে। কোনদিনও মায়ের মতন অযত্নে , অবহেলায় পড়ে থাকতে দেবে না। যত্ন করে ভালবাসায় মুড়িয়ে রাখবে।

১৫.

আশিকের সঙ্গে মীরার প্রথম দেখা হয়েছিল ডিপার্টমেন্টের পিকনিকে। সেই বছর পিকনিক একটু দেরি করেই হয়েছিল। গাজীপুরে পিকনিক। খুবই কমন স্পট। তার পরেও মীরার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম পিকনিক। ওর উছছাসই অন্য রকম। তখন শুভর সাথে ওর প্রেমের সম্পর্কেটা সবে হয়েছে। বাসে মীরা ওর বন্ধুদের সঙ্গে বসেছিল। কিন্তু ওখানে যাবার পর দেখল সব জুটিরা সবাই একে একে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। মিরা এদিক ওদিক তাকিয়ে শুভকে খুঁজছিল। তাকিয়ে দেখলো শুভ দূরে ওর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও শুভ এলোনা দেখে মীরা ওকে মেসেজ করল। তারও কিছুক্ষণ পর শুভ আস্তে আস্তে হেঁটে এসে বলল
-কি হয়েছে?
-কিছু না। চলনা একটু ওদিকে যাই। ব্রিজের কাছ থেকে হেঁটে আসি।
দুজনে একসঙ্গে হাটতে হাঁটতে ব্রিজ পার হয়ে ছোট একটা বাগানের মত জায়গায় গেল। জায়গাটা বেশ ছায়া ঘেরা একটা গাছের নিচে হেলান দিয়ে বসে মিরা শুভকে বলল
-বস
মীরার বেশ ক্লান্ত লাগছে। কেমন ঘুম ঘুম পাচ্ছে। গত রাতে ঘুম হয়নি একেবারেই। প্রথম পিকনিকে যাবার উত্তেজনা। রিমার সঙ্গে অনেক গল্প হচ্ছিল। কি পরে যাবে, কখন রওনা দেবে, কেমন করে সাজবে এসব করতে করতেই রাত ভোর হয়ে গেল। ঘুমাতে পারেনি। বাসে ও ঘুমাতে পারেনি। বন্ধুরা মিলে হইচই করে গান গাইছিল।শুভ আশেপাশে তাকিয়ে বলল
-কেমন লাগছে পিকনিক?
– ভালো। খুব ভালো। শুধু একটু ঘুম পাচ্ছে
– ঘুম পাচ্ছে কেন? রাতে কি ঘুমাওনি?
– না
– কেন কোনো সমস্যা হয়েছে?
মীরা একটু হাসলো, কিছু বলল না।
– ঘুমের সমস্যা হলে একটা ঘুমের ওষুধ খেতে পারতে।
– কি?
– ঘুমের ওষুধ। এই ধরো শর্ট একটিং কোনো একটা বেনজোডায়াযেপিন
– সেটা কি জিনিস?
-বেনজোডায়াযেপিনের নাম শোনোনি? সেকেন্ড ইয়ারে পড়বে। এরা চমৎকার কাজ করে। মেকানিজমটা দারুন।
মিরা বিরস মুখে বলল ও
– কেমন করে কাজ হয় তোমাকে বলছি। এরা যেটা করে সেটা হল ক্লোরাইড চ্যানেল ওপেন করে দেয়, যার ফলে সেলের হাইপার- পোলারাইজেশন হয় এবং…
এসব জ্ঞানের কচকচানি মীরার ভালো লাগছিল না। এড়িয়ে যাবার জন্য ও বলল -বুঝতে পারছি না। বাদ দাও না
-এভাবে বললে বুঝবে না। দাড়াও ছবি একে দেখাচ্ছি। শুভ পকেট থেকে নোটপ্যাড আর কলম বের করল। মীরা হতভম্ব হয়ে গেল। কোনমতে বলল
– তুমি পিকনিকেও নোটপ্যাড আর কলম নিয়ে এসেছো?
– তাতে কি হয়েছে? শুনোই না। দেখো আমি তোমাকে ছবি একে দেখাচ্ছি। নিউরন গুলার সংযোগ স্থলে যখন…
মিরা উঠে দাঁড়িয়ে বলল
– থাকো তুমি তোমার বেনজোডায়াযেপিন নিয়ে
– আরে! কি হলো?
মীরা আর একটা কথাও না বলে হন হন করে হাটা দিল। ততক্ষণে কালচারাল প্রোগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। সামনে ছোট একটা স্টেজ বানানো হয়েছে। আর তার থেকে একটু দূরে মেঝেতে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওর কিছু বন্ধুবান্ধব অডিয়েন্সের মধ্যে বসে ছিল। মীরা আস্তে করে ঢুকে ওদের পাশে বসে পড়ল। একটা রবীন্দ্র সংগীত হচ্ছে। থার্ড ইয়ারের রেশমা আপা গাইছে। চমৎকার গলা। গানের পর আবৃত্তি শুরু হল। আবৃত্তি করতে যে ছেলেটা স্টেজে উঠেছে মীরা তাকে আগে কখনো দেখেছে বলে মনে করতে পারল না। লম্বা মতন শ্যামলা করে মাথা ভর্তি কোকড়ানো চুল। পাঞ্জাবির সঙ্গে জিন্স পরা। কবিতা বরাবরই মীরার খুব প্রিয়। ও কবিতা লেখেনা আবৃতি ও করে না, তবে ওর একটা কবিতার খাতা আছে। প্রিয় কবিতাগুলো সাধারণত লিখে রাখে। আবৃত্তি শুরু হলে মীরা চমৎকৃত হল। যেমন সুন্দর কন্ঠস্বর তেমনি ভালো আবৃত্তি। তাছাড়া এই কবিতাটা মীরার ভীষণ প্রিয়।

তারা- একটি দুটি তিনটি করে এলো
তখন- বৃষ্টি-ভেজা শীতের হাওয়া
বইছে এলোমেলো,
তারা- একটি দু’টি তিনটি করে এলো।
থই থই থই অন্ধকারে
ঝাউয়ের শাখা দোলে
সেই- অন্ধকারে শন শন শন
আওয়াজ শুধু তোলে।
ভয়েতে বুক চেপে
ঝাউয়ের শাখা , পাখির পাখা উঠছেকেঁপে কেঁপে।
তখন- একটি দু’টি তিনটি করে এসে
এক শো দু শো তিন শো করে
ঝাঁক বেঁধে যায় শেষে
তারা- বললে ও ভাই, ঝাউয়ের শাখা,
বললে, ও ভাই পাখি,
অন্ধকারে ভয় পেয়েছো নাকি ?
যখন- বললে, তখন পাতার ফাঁকে
কী যেন চমকালো।
অবাক অবাক চোখের চাওয়ায়
একটুখানি আলো।
যখন- ছড়িয়ে গেলো ডালপালাতে
সবাই দলে দলে
তখন- ঝাউয়ের শাখায়- পাখির পাখায়
হীরে-মানিক জ্বলে।
যখন- হীরে-মানিক জ্বলে
তখন- থমকে দাঁড়াঁয় শীতের হাওয়া
চমকে গিয়ে বলে-
খুশি খুশি মুখটি নিয়ে
তোমরা এলে কারা?
তোমরা কি ভাই নীল আকাশের তারা ?আলোর পাখি নাম
জোনাকি
জাগি রাতের বেলা,
নিজকে জ্বেলে এই আমাদের
ভালোবাসার খেলা।
তারা নইকো- নইকো তারা
নই আকাশের চাঁদ
ছোট বুকে আছে শুধুই
ভালোবাসার সাধ।

আবৃত্তি শেষ হলে টুম্পা পাশ থেকে মীরার কানে কানে বলল
-আমি তো প্রেমে পড়ে গেলাম রে
-কে উনি?
– চিনিস না? আশিক ভাই, আমার ক্রাশ। এতদিন শুধু ক্রাশই ছিল রে। আজকে তো পুরো প্রেমে পড়ে গেলাম। এখনই উনার কাছে গিয়ে বলতে ইচ্ছা করছে

তারা নইকো- নইকো তারা
নই আকাশের চাঁদ
ছোট বুকে আছে শুধুই
আপনাকে ভালোবাসার সাধ।

মীরা হি হি করে হেসে ফেলল।

চলবে……

আজকের কবিতার নাম “জোনাকিরা” লিখেছেন আহসান হাবীব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here