বইছে আবার চৈতী হাওয়া
৬৭
-তুই এখানে?
এই মুহূর্তে এই মানুষটিকে ও ঠিক আশা করেনি। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার চোখে ও একই রকম বিস্ময়। সে একটু শ্লেষের সঙ্গে বলল
-তোর কাছ থেকে আমি এটা আশা করিনি আশিক
আশিক একটু থমকে গেল। তারপর বলল
– কি আশা করিসনি? কিংবা আমার প্রশ্ন করা উচিত কি আশা করেছিল তোরা আমার কাছ থেকে?
– আমরা? আমি জানিনা আমরা বলতে তুই ঠিক কি মিন করছিস তবে আজকে তোকে একটা সত্যি কথা বলবো
কিসের সত্যি কথা?
চল বাইরে গিয়ে কথা বলি
আশিকের যেতে ইচ্ছা করছিল না কিন্তু খুব জানতে ইচ্ছা করছে মীরা কেমন আছে। তাই ও আর আপত্তি করল না। হাটতে হাটতে দুজন জলের ধারে চলে গেল। অনেকক্ষণ নিরবে হাটাল দুজন। আশিকের খুব জানতে ইচ্ছা করছে মীরা কোথায় আছে, কেমন আছে। ওর টেস্ট রিপোর্টে কি এসেছে। ভয়ের কিছু নেই তো? অনেকক্ষণ হয়ে গেছে শুভ কিছু বিলছে না। আশিক অধৈর্য গলায় বলল
-কিছু বলবি বলছিলি
শুভ ধ্যান ভাঙ্গা কণ্ঠে বলল
– তুই কি জানিস তোকে আমি কি ভীষণ ঈর্ষা করি? সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকে আমি দেখেছি মেয়েরা সব তোর জন্য পাগল হয়ে যেত। আমার এত ভালো রেজাল্ট করার পরেও টিচারেরা তোর পেছনে ঘুরত। তবু কোনদিন তোকে আমার ঈর্ষা হয়নি। কখন হয়েছে জানিস?
– কখন? আমার বিয়ের পর?
-না বরং এবার যখন আমি ফিরে আসি তারপর। আমি মিরার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম
আশিক চমকে উঠলো কিন্তু কিছু বলল না। এটাই তো স্বাভাবিক যে ও মীরার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। শুভ কেমন ঘোর লাগা কন্ঠে কথা বলেই যাচ্ছে।
-আমি জানি না এই দুই মাসে তুই কি এমন করেছিস যেটা আমি গত দুই বছরেও করতে পারিনি। মীরা তোকে যে পরিমাণ ভালোবাসে এর একশ ভাগের এক ভাগও যদি আমাকে ভালবাসত তাহলে আমি ওর জন্য জীবন দিয়ে দিতাম।
আশিক কপাল কুঁচকে বলল
এসব কি বলছিস তুই? মীরা কোথায় এখন? কেমন আছে ও?
ভালো নেই
আশিকের ইচ্ছা হল সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শুভর গলা চেপে ধরতে। যার ভালো থাকার জন্য ও নিজের দিকে তাকালো না, নিজের ভাল থাকার কথা ভাবল না সে কি না ভালো নেই? আশিক দাতে দাঁত পিষে বলল
তুই যদি মিরাকে একটুও কষ্ট দিস তাহলে আমার কথা শুনে রাখ, তোকে আমি খুন করে ফেলব
শুভর হাসিটা কেমন ফ্যকাশে দেখালো। ও বলল
মরে যাওয়া মানুষকে আর কি মারবি তুই? তারপর গা ঝাড়া দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
আমি সামনের সপ্তাহে চলে যাচ্ছি। তুই মিরাকে নিয়ে ভালো থাকিস
আশিকের সব কেমন এলোমেলো লাগছে। ও কোনমতে বলল
মিরা কোথায় এখন?
ময়মনসিংহে। কেন তুই জানিস না? আমার কাছ থেকে পালাতে ও নিজের নাম্বার চেঞ্জ করেছে, তবুও আমি মরিয়া হয়ে ওর নতুন নাম্বার জোগাড় করে ওকে ফোন করেছিলাম, শুধু একটা প্রশ্ন করার জন্য
কি প্রশ্ন?
এই যে, আমাদের দুই বছরের সম্পর্ক আমি কি ওর মনের কোথাও একটু জায়গা জুড়েও নেই? ও আমাকে কি বলল জানিস ?
কি?
বলল ওর মনে শুধু একজনেরই রাজত্ব সেখানে অন্য কারো জন্য তিল পরিমাণ স্থান নেই
আশিকের কথা আটকে গেল। অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও কিছু বলতে পারল না। শুভ এগিয়ে এসে ওর ডান হাতটা আশিকের কাঁধে রেখে মৃদু একটা চাপ দিয়ে বলল
আমি অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছি। তোরা ভালো থাকিস
আশিক জরাগ্রস্থের মত হোটেলের রিসেপশনে এসে বলল
আমাকে একটা ঢাকার ফ্লাইট যোগাড় করে দিতে পারবেন?
পরের দিনের ফ্লাইট পাওয়া গেল কিন্তু অত রাতে কোন ফেরি পাওয়া গেল না। পরবর্তী ফেরি সকাল আটটায়। একটা রাত নিদারুন অন্তর দহনে দগ্ধ হয়ে কাটাল ও। আশিক বাড়ি পৌঁছল দুপুরের পর। বাড়িতে ঢুকে মনে হল পুরা বাডিতে কোন প্রানের চিহ্ন নেই।
সকাল থেকে আরিফ সাহেবের মন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। আজ সকালে দুটো চিঠি এসেছে। একটা ময়মনসিংহ থেকে। মীরার চিঠি। রেজিস্ট্রি করে পাঠীয়েছে। মীরা ও নিশ্চই ফোনে না পেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে। তিনি নিজেও অনেকবার ফোন করেছেন। প্রতি বারই আশিকের ফোন বন্ধ পেয়েছেন। এই ছেলের কি সমস্যা তিনি বুঝতে পারছেন না। নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করল। তারপর সব কিছু এত ভাল যাচ্ছিল। এমন লক্ষ্মী একটা মেয়ে আর সে কিনা এখন এভাবে ডুব দিল। ছেলেকে কি করবেন সেতো পরের কথা কিন্ত অন্য চিঠি পেয়ে তার মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে। এটা এসেছে ডাক্তার রসিদের ক্লিনিক থেকে। মীরার রিপোর্টের কপি পাঠয়েছেন। কিছু বিঝতে না পেরে উনি ক্লিনিকে ফোন দিয়েছিলেন। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে যা বুঝলেন তার সারমর্ম হল তিনি মীরা এবং আশিককে দেখা করতে বলেছিলেন কেউই আসেনি। উনি নিজে থেকে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলেন কাউকেই পাননি মীরার রিপোর্টের ব্যাপারে যা বললেন সেটা শোনার পর তার মাথা কাজ করছে না। আনন্দ ভয় এবং বিস্ময়ের মিশ্র অনুভুতি হচ্ছে। আনন্দের সংবাদ তো বটেই কিন্তু তার চেয়ে বেশি ভয় হচ্ছে মীরার জন্য। আর বিস্মিত তিনি হচ্ছেন আশিকের আচরণে। এই রকম একটা সংবাদ পাবার পর ওর এমন নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার মানে কি?মনের কোনে একটা সন্দেহ উকি দিচ্ছে। এমন তো নয় যে এই খবর জানার পরেই ও উধাও হয়ে গেছে। এই সম্ভাবনাটাকে আমলে আনতে পারছেন তিনি। আশিকের চরিত্রের সঙ্গে এটা যায় না। ছেলেকে তিনি চেনেন। তাহলে কি হতে পারে?
তিনি তার চেম্বারের এমাথা থেকে ওমাথা কয়েকবার পায়চারি করলেন। আশিকের সঙ্গে অতি সত্বর যোগাযোগ করে প্রয়োজন। তিনি আবারো আশিককে ফোন দিলেন। যথারীতি বন্ধ। চেম্বারের দরজা খুলে বেরিয়ে তিনি চমকে গেলেন। সদর দরজার সামনে আশিক দাড়িয়ে আছে। আরিফ সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছেলেকে পর্যবেক্ষণ করলেন। আশিক দাড়িয়ে আছে পরাজিত সৈনিকের মতো। ক্লান্ত বিদ্ধস্ত চেহারা। ছেলেকে দেখে তার রাগ হওয়া উচিত কিন্ত কেন যেন আসম্ভব মায়া হল। ছেলেটা বড় অভিমানী আর চাপা। নিজের কষ্ট কাউকে দেখাতে পারেনা। তিনি ছেলেকে ঘরে নিয়ে গেলেন। আশিক ঘরের এক কোনে দাড়িয়ে রইল। বসল না।
তোমার একটা চিঠি এসেছে
চিঠি? আমার?
হ্যাঁ। মীরা পাঠিয়েছে।
আশিক কিছু বলতে যাচ্ছিল, আরিফ সাহেব ওকে থামিয়ে দিয়ে বললেন
আরো একটা চিঠি এসেছে ডক্টর রসিদের ক্লিনিক থেকে। মিরার রিপোর্টের কপি পাঠিয়েছেন।
আশিক হাত বারিয়ে চেয়ারের হাতলটা ধরল তারপর ভাঙ্গা গলায় বলল
মীরার কি খারাপ কিছু হয়েছে বাবা?
আরিক সাহেব যা বোঝার বুঝে নিলেন। উঠে এসে ছেলের কাধে হাত রেখে বললেন
আমরা কাল ওকে আনতে যাচ্ছি। তুমি ও চলো।
কি হয়েছে ওর?
আজকের দিনটা রেস্ট নাও। চিঠিগুলো পড় সব বুঝতে পারবে।
আমি এখনি যাব।
আজকে গাড়ি নেই। সারভিসিং এ গেছে
আমার গাড়ি লাগবে না।
আশিক ওর ব্যগটা তুলে বেরিয়ে গেল।
বাসটা ছাড়ার পরপরই বৃষ্টি শুরু হল। আশিক জানালার কাচ তুলে দিয়ে মীরার চিঠিতা খুলল। কি অদ্ভুত পুরো চিঠিটা এমন ঝাপসা হয়ে আছে কেন?
চলবে…………