বৈধ_দৃষ্টি #পর্বঃ৩৩

0
338

#বৈধ_দৃষ্টি
#পর্বঃ৩৩
#ফাতেমা_জান্নাত

“فنامة الأسري يسرى ،

“ফা’ইন্নামা আল উসরি ইউসরা,
অবশ্যই কষ্টের সাথেই রয়েছে স্বস্থি
(সুরা ইনশিরাহ,আয়াত ;৫-৬)

সাফওয়ান এর চোখ খুশির অশ্রুপাত হচ্ছে।পৃথিবীর সব থেকে সুখি মানুষ এর তালিকায় নিজে কে উপরস্থ মনে হচ্ছে।পারি পার্শ্বিক মানুষ এর হাজারো তিক্ত কথায় যখন সহ্য ছাড়া হয়ে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে-ই আল্লাহ খুশির সংবাদ দিয়েছে।

ডাক্তার যখনি এসে সাফওয়ান কে বললো সে আর রাফিয়া বাবা মা হতে চলছে।সাফওয়ান যেন পুরো স্থির হয়ে গেলো। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাফওয়ান। ডাক্তার সাফওয়ান এর দিকে তাকিয়ে সাফওয়ান কাধঁ চাপড়ে বলে,

—অভিনন্দন সাফওয়ান। নিজ এর ওয়াইফ এর যত্ন নিও।খেয়াল রেখো দ্বিগুণ পরিমাণে।

বলে-ই ডাক্তার চলে যায় নিজ এর কেবিনে। এই দিকে ডাক্তার এর কথা সাফওয়ান এর কর্ণপাত হয়েছে বলে মনে হয় না।অধিক খুশি তে সে স্থির হয়ে গেছে।সাবিনা এসে সাফওয়ান এর কাঁধে হাত রাখে।সাফওয়ান এর কোনো প্রকার হেল দোল না পেয়ে তিনি এবার সাফওয়ান কে মৃদু ঝাঁকিয়ে বলে,

—এভাবে স্থির হয়ে আছিস কেন?ডাক্তার কি বলেছে শুনেছিস?

সাফওয়ান সম্বিত ফিরে আসে।হুট করে-ই সাবিনা কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়।সাবিনা কে জড়িয়ে ধরেই কেঁদে কেঁদে বলে,

—মা আমি বাবা হবো।আমাদের পরিবারে নতুন সদস্য আসবে আলহামদুলিল্লাহ। তুমি দাদুমণি হবে মা।

পরোক্ষণে-ই সাবিনা কে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চোখ মুখ মুছে নেয়।মুখে হাসির রেখা টেনে সাবিনা কে সুধায়,

—আমি ডাক্তার এর সাথে কথা বলে আসছি মা।তুমি গিয়ে রাফিয়ার কাছে বসো।

সাবিনা ঠিক সাফওয়ান এর সামনে দাঁড়িয়ে সাফওয়ান এর মাথা টা দুই হাতে ধরে এগিয়ে এনে কপালে চুমু দিয়ে বলে,

—আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি আল্লাহ যাতে আমার ছেলে কে এভাবে সব সময় হাসি খুশি রাখে এবং আমার ছেলের সাথে জুড়ে যাওয়া মেয়ে টা কে ও।আল্লাহ তোদের এবং তোদের অনাগত সন্তান কে সুস্থ রাখুক দোয়া করি বাবা।

সাফওয়ান হেসে দেয় মা এর কথায়।সাবিনার কপালে চুমু দিয়ে রাফিয়ার কাছে যেতে বলে সে ডাক্তার এর কেবিন এর দিকে যায়।

সাবিনা রাফিয়ার কেবিনে ঢুকে দেখে রাফিয়া চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।সাবিনা টুল টা টেনে নিয়ে রাফিয়ার পাশে বসে নিঃশব্দে। রাফিয়ার মাথায় হাত ভুলিয়ে দিতে-ই রাফিয়া চোখ খুলে তাকায়।সাবিনা কে দেখে হেসে দেয়।শাশুড়ি কে বলে,

—বাবা কোথায় মা?

সাবিনা রাফিয়ার কথার প্রত্যুত্তর এ বলে,

—অফিসে।এই মুহূর্তে বের হতে পারবে না।তাই আসতে পারেনি।

—আচ্ছা।আপনি খেয়েছেন মা?

—এখনো খাইনি।বাসায় গিয়ে সবাই এক সাথে খাবো ইনশাল্লাহ। একদম কথা বলবে না
চুপটি করে শুয়ে থাকো।

রাফিয়া আর কিছু-ই বলেনি।কিন্তু তার দুই চোখ চার দিকে সাফওয়ান কে খুঁজে চলছে। সাফওয়ান এর ছায়া টা ও তার নজরে পড়ছে না।
রাফিয়া কে চার দিকে তাকাতে দেখে সাবিনা হেসে দেয়।রাফিয়ার মুখে হাত দিতে-ই রাফিয়া চমকে গিয়ে তাকায় সাবিনার দিকে।সাবিনা হেসে বলে,

—সাফওয়ান ডাক্তার এর সাথে কথা বলতে গিয়েছে।এক্ষুনি চলে আসবে।

রাফিয়া ও আর কিছু বলে না।পুনরায় চোখ বন্ধ করে।সাবিনা রাফিয়ার পাশে-ই বসে থাকে।রাফিয়ার মাথায় হাত ভুলাতে থাকে।

🌸🌸

ডাক্তার এর সামনে চেয়ারে বসে আছে সাফওয়ান।ডাক্তার কিছু একটা কাজ করছে।কাজ টা শেষ হতে-ই সাফওয়ান এর দিকে তাকিয়ে বলে,

—বলো সাফওয়ান।কি বলতে এসে ছিলে?

সাফওয়ান ডাক্তার এর সামনে একটা চেয়ার টেনে বসে।দুই হাত টেবিল এর উপরে রেখে ডাক্তার এর দিকে তাকিয়ে বলে,

—আঙ্কেল,রাফিয়ার কি কোনো সমস্যা হয়েছে?

ডাক্তার সাফওয়ান এর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বুঝার চেষ্টা করে সাফওয়ান ঠিক কি সমস্যার কথা বুঝাতে চাইছে।নাহ,চেষ্টা করে ও বুঝতে না পেরে ডাক্তার বলে,

—সমস্যা বলতে ঠিক কি বুঝাতে চাইছো তুমি?

সাফওয়ান পুনরায় নড়ে চড়ে বসে ডাক্তার কে সুধাল,

—এই যে রাফিয়া সেন্সলেস হয়ে গেলো।এটা কোনো সমস্যা না তো?আই মিন দুই মাস আগে ও তো এপেন্ডিসাইটিস এর কারণে সেন্সলেস হয়ে গেছিলো ও।এখন আবার কোনো কম্পলিকেশন দেখা যায় নি তো?

ডাক্তার সাফওয়ান এর কথা শুনে আহাম্মক এর ন্যায় তাকিয়ে আছে সাফওয়ান এর দিকে।একজন নারী কনসিভ করলে মাঝে মাঝে কিংবা প্রথম দিকে সেন্সলেস হবে এটা তো স্বাভাবিক।
তাছাড়া এটা তো বর্তমান জেনারেশনে সবাই জানে।আর সাফওয়ান কিনা জানে না?

ডাক্তার সাফওয়ান কে বলে,

—আল্লাহর রহমতে তোমার ওয়াইফ সুস্থ আছে।কনসিভ করলে প্রথম প্রথম এমন সেন্সলেস হবে।এটা তো সবাই জানে।তুমি এটা নিয়ে এত টেনশন করছো কেন?

—কারণ দুই মাস আগে-ই রাফিয়া এভাবে-ই সেন্সলেস হয়ে যাওয়ার পর জানতে পেরেছি ওর এপেন্ডিসাইটিস ধরা পড়েছে।আর আজ আবার সেন্সলেস হওয়ার পর জানতে পারলে নতুন সদস্য আসছে,আলহামদুলিল্লাহ।কিন্তু তবু ও চিন্তা টা আমার থেকে-ই যায়।তাছাড়া শুনেছি অনেক এর নাকি কম্পলিকেশন দেখা যায় প্রথম অবস্থা তেই।সেই জন্য আমি পুরো পুরি শিউর হতে চাচ্ছি রাফিয়া আল্লাহর রহমতে ঠিক আছে তো?ওকে নিয়ে আমি আর কোনো রিস্ক নিতে পারবো না।এক বার এর অপারেশন এই আমাকে ও এমন ভয় পাইয়ে দিছিলো যে,থাক সে সব না বলি।রাফিয়া সম্পূর্ণ সুস্থ আছে তো আঙ্কেল?

—আলহামদুলিল্লাহ সুস্থ আছে।দুপুর এর দিকে রাফিয়া কে ডিসচার্জ করে দিবো। বাসায় নিয়ে যেও।

—আচ্ছা আঙ্কেল। আসি এখন।আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।

সাফওয়ান ডাক্তার কে সালাম দিয়ে-ই বেরিয়ে আসে ডাক্তার এর কেবিন থেকে।রাফিয়ার কেবিন এর দিকে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হয়।পর মুহূর্তে কিছু ভেবে রাফিয়ার কেবিনে না গিয়ে হসপিটাল এর এক পাশে এসে দাঁড়ায়। যেখানে শব্দ নেই কোনো।প্যান্ট এর পকেট থেকে ফোন টা বের করে অফিস এর বস কে ফোন করে।সকালে রাফিয়া কে এনে হসপিটালে এডমিট করে একবার বস কে ফোন করে বুঝিয়ে বলে ছুটি নিয়ে ছিলো আজকে-র।

সাফওয়ান বস কে ফোন দেয়।দুই বার রিং হতে-ই অপর পাশ থেকে কল রিসিভ করে।সাফওয়ান মৃদু হেসে বলে,

—আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ স্যার।

—ওয়ালায়কুম সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। তোমার ওয়াইফ এর কি অবস্থা এখন সাফওয়ান?

সাফওয়ান হেসে দিয়ে বলে,

—আলহামদুলিল্লাহ নতুন সদস্য আসছে স্যার।

—আলহামদুলিল্লাহ।তোমার স্ত্রীর খেয়াল রেখো?

—ইনশা আল্লাহ।স্যার অফিসে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?আমি আসবো?

সাফওয়ান এর বস না সূচক সম্মতি জানিয়ে বলে,

—আরে নাহ।তোমার আসার দরকার নেই।তুমি তোমার স্ত্রীর খেয়াল রেখো।এই সময় স্ত্রীর পাশে স্বামী থাকা টা সব চেয়ে বেশি প্রয়োজন।

—জি। আমি ইনশা আল্লাহ কাল সকালে সময় মতো অফিসে জয়েন করবো স্যার।

—আরে এতো চাপ নিও না।স্ত্রীর খেয়াল রাখো।রাখছি।

—আল্লাহ হাফেজ। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।

—ওয়ালায়কুম সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।

সাফওয়ান ফোন কেটে দেয়।পা বাড়ায় রাফিয়ার কেবিন এর দিকে।

🌸🌸

সাফওয়ান রাফিয়ার কেবিনে প্রবেশ করতে-ই সাবিনা বেরিয়ে যায়।আমজাদ সাহেব ও এসেছে।রাফিয়ার সাথে কথা বলে তিনি ও বেরিয়ে যায়।সাফওয়ান এসে রাফিয়ার পাশে বসে।রাফিয়ার এক হাত টেনে হাতে অধর ছুঁয়ে দেয়।সাফওয়ান এর চোখে পানি টলমল করছে।রাফিয়া হাত বাড়িয়ে সাফওয়ান এর মাথার চুল গুলো তে হাত গলিয়ে গুছিয়ে দেয়।কেমন এলোমেলো হয়ে আছে সাফওয়ান এর চুল।গুলো।

সাফওয়ান এর চোখে রাফিয়ার দৃষ্টি পড়তে-ই রাফিয়া দুই ভ্রু কুঁচকে নেয়।সাফওয়ান দিকে প্রশ্নাত্মক চাহনি দিয়ে বলে,

—আপনি কাঁদছেন কেন সাফওয়ান?

রাফিয়ার কথা টা বলতে দেরি হলে ও সাফওয়ান রাফিয়া কে জড়িয়ে ধরতে দেরি হয় নাই।রাফিয়া কে জড়িয়ে ধরে-ই কেঁদে দেয় সাফওয়ান। ঠোঁটে হাসি চোখে পানি দুই জন এর।এই যেন এক অন্যরকম খুশির মুহূর্ত।সাফওয়ান রাফিয়া কে ছেড়ে দেয়।রাফিয়ার সমস্ত মুখশ্রী তে আদরে আদরে ভরিয়ে তুলে।রাফিয়া ও চুপ করে থাকে।সাফওয়ান নিজেকে ধাতস্থ করে রাফিয়া কে বলে,

—রাফিয়া আমি বুঝতে পারছি না আমি ঠিক কিভাবে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করবো? ঠিক যে ভাবেই শুকরিয়া আদায় করতে যায়,মনে হচ্ছে কম হয়ে যাচ্ছে।বলে না ধৈর্য্যের ফল মিষ্টি হয়।এই যে এত দিন সবার এত এত তিক্ত কথা ধৈর্য্য ধরে শুনে এসেছি।তার ফল হিসেবে হয়তো আল্লাহ আমাদের এই নেয়ামত দিচ্ছে।আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ।রাফিয়া আপনি খুশি তো?

রাফিয়া চোখ এর পানি মুছে বলে,

—যেখানে আল্লাহ খুশি হয়ে আমাদের নেয়ামত দিচ্ছে।যেই নেয়ামতে আমার স্বামী আমার পরিবার এর সকলে খুশি। সেই নেয়ামত কে অগ্রাহ্য করে আমি খুশি না হয়ে থাকি কি ভাবে?আলহামদুলিল্লাহ আমি ও অনেক খুশি।

সাফওয়ান রাফিয়া কে নিজের প্রশস্ত বক্ষে মিশিয়ে নেয়।আজ থেকে যে রাফিয়া শুধু তার স্ত্রী নয়,তার সন্তান এর মা ও।আর এই মেয়ে টা কে জড়িয়ে ধরলে তার বক্ষ শীতল হয়।এই মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলে দৃষ্টি মিলালে তার চক্ষু শীতল হয়।তবে কি এটাই বৈধ দৃষ্টি,বৈধ সম্পর্ক এর জোর?

চলবে ইনশাআল্লাহ

ভুলত্রুটি মার্জনীয়। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here