#সংসারের_সাতকাহন
পর্ব ১১
মাগরিবের পরে হালকা নাস্তা করে বেরিয়ে যায় সাদিক আর সোনিয়া। বাইরে গিয়ে ওদের সাথে দেখা হয় সাইফের। সাদিক জানায় ওরা মার্কেটে যাবে, সাইফ ও যেন সাথে যায়। তিনজন মিলে গিয়ে সাদিকের জন্য শার্ট আর প্যান্ট কিনে দুই সেট। তারপর সাইফ বলে এখন চল তোমাদের সারপ্রাইজ দেই। বলে দুইটা রিকশা ডেকে ওদের উঠতে বলে নিজে একটায় উঠে যায়।
সোনিয়ার পরনে আকাশী আর সিলভার কম্বিনেশনে একটা টিস্যু কাতান শাড়ি, হাত ভরা চুরি আর শাড়ির সাথে মানানসই সাজ। এই সাজে সাইফ ওকে সারপ্রাইজ দিতে নিয়ে যায় ভুরিকাবাব খাওয়াতে, রাস্তার ধারে। সোনিয়া সত্যিই সারপ্রাইজড হয়, সাদিক হয় কিঞ্চিৎ বিরক্ত। স্ট্রীটফুড সোনিয়ার খুব পছন্দ কিন্তু পরিবারের কেউ পছন্দ করে না আর ওর সাথে যাওয়ার কেউ নাই তাই স্ট্রিটে বসে স্ট্রিট ফুড খাওয়া ওর হয়ে উঠে না। পার্সেল করে বাসায় নিয়ে যায়, খেতে খেতে সেই স্বাদ আর থাকেনা।
বিয়ের ঠিক পরদিনই কাতান শাড়ি গয়না পরা অবস্থায় ভাসুর ওকে স্ট্রিট ফুড খাওয়াতে এনেছে তাতে সোনিয়া দুইটা সারপ্রাইজ পায়। প্রথমত স্ট্রিটে বসে স্ট্রিট ফুড খাওয়া হচ্ছে আর দ্বিতীয়ত কোন মেয়েই চিন্তা করবেনা এমন গেট আপে রাস্তায় বসে খাবার খাওয়ার কথা। সাদিক যখন জানতে পারে সোনিয়া খুশি হয়েছে তখন ওর বিরক্তি চলে যায়। সাইফ একার কাছে জেনে নিয়েছিল সোনিয়ার পছন্দ সম্পর্কে। এর মাঝে গত কয়েকদিন সে সাদিককে না বলেই বিভিন্ন জনের কাছে খোঁজ নিয়েছে ভুরিকাবাব কে ভালো বানায়। সেই মতোই আজ সে উপস্থিত হয় ওদের নিয়ে।
খেতে বসে সোনিয়া দেখে ওর চারপাশে মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। সবাই অবাক চোখে কাতান শাড়ি পরা বউয়ের রাস্তার ধারে বসে স্ট্রিটফুড খাওয়া দেখছে। ও একটু মজাও পায়। বিয়ের আগে থেকেই ও একটু উলটাপালটা ধরনের পাগলামী করতে পছন্দ করত। এখন বরের আর ভাসুরের প্রশ্রয়ে মনে হচ্ছে এমন পাগলামী আরো জমে উঠবে।
ওদের খাওয়া প্রায় শেষের দিকে এই সময় সাদিকের ফোনে মালার কল আসে। ফোন ধরতেই মালা বলে, “কইরে তোরা? তোদের বাড়ি নিতে আসছি, তোর শ্বশুরবাড়িতে এসেছি আর তোরা নাই। তাড়াতাড়ি আয়।” সাদিক মালার কথা ওদের জানালে সাইফ কাবাবের বিল ক্লিয়ার করে দুইটা রিকশা ডেকে একটায় ওদের তুলে দিয়ে আরেকটা নিয়ে সেও ওদের সাথেই যায়।
সোনিয়াদের বাসায় পৌঁছে দেখে মালা আর রাদিক ড্রইংরুমে বসে আছে। সোনিয়াকে দেখেই বলে উঠে, “ভাবি চল তোমার বাড়িতে নিয়ে যাই।” সোনিয়া ওদের সাথে কিছুক্ষন কথা বলে ভিতরের রুমে এসে ওর ট্রলি ব্যাগ গুছিয়ে নেয়। ব্যাগ নিয়ে বাইরে আসতেই শুনে ওর মা মালার সাথে কথা বলছে, এগিয়ে গিয়ে দেখে উনি মালার হাত ধরে বলছেন, “মা, আমার মেয়েটা কোনদিন এক গ্লাস পানিও ঢেলে খায়নি। ওকে দিয়ে আমি পেঁয়াজ ও ছিলে নেইনি কখনও। এখন বিয়ে হয়েছে, ওকে শ্বশুরবাড়িতে অনেক কিছুই করতে হবে। ধীরে ধীরে শিখে নিবে ইনশাআল্লাহ্। সেই সময়টা ওকে দিও প্লিজ। জানোই তো আমার এক মেয়ে আল্লাহর কাছে চলে গেছে, এখন আমার সবকিছুই সোনিয়া। ওকে তোমরা কষ্ট দিওনা মা।” মালা হাত ধরে আশ্বস্ত করে উনাকে।
সাদিকদের বাসা আর সোনিয়াদের বাসা হাঁটা দূরত্বে। বড় রাস্তার এপার আর ওপার, কিন্তু তাই বলে নতুন বউকে তো আর হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়না। সাইফ একটা রিকশা ডেকে নিয়ে এলে সোনিয়া আর মালা উঠে পরে। রিকশাওয়ালা ছিল পাড়ারই পরিচিত তাই সে হেঁটেই রিকশা নিয়ে যায়, পাশে পাশে ট্রলি ব্যাগ টেনে হেঁটে যায় তিনভাই -সাদিক, রাদিক আর সাইফ।
বহুবার আসায় পরিচিত সাদিকদের বাসার গেটে রিকশা থামতেই অবাক হয়ে যায় সোনিয়া। সব আত্নীয়স্বজন দরজার দুই পাশে সার দিয়ে দাঁড়ানো। সোনিয়াকে রিকশায় বসতে বলে মালা নেমে ভিতরে যায়। কিছুক্ষন মা মেয়ে এসে দাঁড়ায় রিকশার সামনে। সাদিকের মায়ের কথায় রিকশা এমন জায়গায় দাঁড় করায় যাতে রিকশা থেকে সোনিয়া নামলেই ওর পা পরবে একদম দরজার ভিতরেই। সোনিয়া রিকশায় বসে থাকতেই উনি সোনিয়াকে মিষ্টি খাইয়ে দেন, সাদিককে বলেন সোনিয়াকে এসে হাত ধরে নামাতে। সাদিক মায়ের আদেশ পালন করে। সোনিয়া রিকশা থেকে নেমেই নিচে তাকিয়ে দেখে মেইন এন্ট্রি থেকে রুমের দরজা পর্যন্ত একটা লাল শাড়ি বিছানো। মালা ওকে সেই লাল শাড়ির উপর দিয়েই হেঁটে যেতে বলে। সোনিয়া হাঁটা শুরু করলেই দুই দিক থেকে শুরু হয় ফুলবর্ষণ।
অভিভুত হয়ে যায় সোনিয়া ওকে এভাবে বরণ করে নেয়ায়। লাল শাড়ির উপর পা দিয়ে ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখে দরজার সামনে ফিতা বাঁধা আর ফিতার ওপারে কখন রাদিক চলে গেছে সোনিয়া টেরই পায়নি। রাদিক ওর দুই বন্ধু ও কাজিনদের নিয়ে দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে। ওদের আবদার না মিটালে ঘরে ঢুকাতে দিবেনা। সোনিয়ার শাশুড়ি ওর হাত ধরে ঘরে নিয়ে ঢুকিয়ে নিয়ে বলে “সাদিক বাইরে থাকল ওকে ধর।”
সোনিয়াকে নিয়ে গিয়ে ওর রুমে বসানো হয়। সেখানে ফুল দিয়ে সাজানো খাটে বসানো হয় ওকে। একে একে সবাই এসে সোনিয়াকে মিষ্টিমুখ করায়, ছবি তোলে, শাশুড়ি ও মালা সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। এতো মানুষের ভীড়ে সোনিয়ার চোখ খুঁজে বেড়ায় সাদিককে, সেটা খেয়াল করে রাদিক। পাশে বসে আস্তে করে বলে, “এতোদিন ভাইয়াকে চিনতেন না, আমাকে খুঁজতেন, এখন ভাইয়াকে পেয়েই ভুলে গেলেন আমাকে। ভাইয়া বাইরে আছে, ভাইয়ার বন্ধুরা আসছে তাই কথা বলতেছে।” উত্তরে সোনিয়া শুধু হাসে।
ভীড় পাতলা করার জন্য সোনিয়ার শাশুড়ি মোস্তারি বেগম ওর হাত ধরে অন্য রুমে নিয়ে যান, সেখানে ছিল সোনিয়ার খালাশাশুড়িরা। উনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, উনারা সোনিয়াকে এটা সেটা জিজ্ঞেস করতে থাকেন।মালা সোনিয়ার দিকে এক নজর তাকিয়ে বুঝতে পারে সোনিয়া অস্বস্তি বোধ করছে, কাছে এসে জিজ্ঞেস করে “ভাবি চা বানাচ্ছি, তুমি চা খাবা?” উত্তরে সোনিয়া জানায় ওর চায়ে চিনি না দিতে। এক খালাশাশুড়ি বলে উঠেন “কি ব্যাপার সাদিকের বউয়ের ডায়াবেটিস নাকি?” ‘সাদিকের বউ’ কথাটা মধুর মতো শুনায় সোনিয়ার কানে তাই সে উত্তর দেয় “না খালা, আপনাদের এখানের সবাই এতো মিষ্টি যে আমার চায়ে মিষ্টি লাগবেনা।” সবাই হেসে উঠে, পরিস্থিতি সহজ হয়ে যায়।
বন্ধুদের বিদায় দিয়ে সাদিক ঘরে এসে দেখে ঘর খালি, কৌতূহল নিয়ে খালাদের ঘরে উঁকি দিতেই দেখে সোনিয়া খালাদের সাথে গল্প করছে। সে সোনিয়ার পিছন দিকে থাকায় সোনিয়া তাকে দেখতে পায়না, কিন্তু ওর খালাদের সাথে আপন করে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করতে দেখে মন ভরে যায় সাদিকের। মনে মনে ভাবে পরিবারের সাথে যদি বউ এডজাস্ট করতে না পারে সেই ভয়ে ও বিয়েতেই রাজি হচ্ছিল না, অথচ ওর বউ বাসায় পা দেয়ার ঘন্টা না পেরুতেই কি সুন্দর সবার সাথে হেসে গল্প করছে।
সোনিয়া সাদিককে না দেখলেও মালা ঠিকই দেখে। ও খালাদের অনুমতি নিয়ে সোনিয়াকে নিয়ে ওর রুমে গিয়ে বলে চেঞ্জ করে নাও। সোনিয়া শাড়ি বের করতেই মোস্তারি বেগম এগিয়ে এসে বলেন “শাড়ি পরার দরকার নাই, থ্রিপিস পর।” সোনিয়া চেঞ্জ করে বাইরে বের হলে মালা ওকে কলপাড় নিয়ে যায়। হাতমুখ ধুয়ে ঘরে আসতেই ওর শাশুড়ি খাবার রেডি করে তাড়া দেন রাতের খাবারের জন্য, ওর শ্বশুর বরাবর তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরেন, আজ জেগে আছেন শুধু ছেলের বউয়ের সাথে খাবেন বলে। একসাথে সবাই খেতে বসে, টেবিলের দুই মাথায় বসে শ্বশুর আর বউমা। শাশুড়ি জানান সব রান্না করেছে মালা নিজে। মোস্তারি বেগম বউমার প্লেটে ভাত তুলে দিয়ে যেই হাসের মাংসের তরকারির বাটিটা হাতে নিয়েছেন সোনিয়ার প্লেটে তরকারি দেয়ার জন্য, মালা এক ঝটকায় উনার হাত সরিয়ে দিয়ে বাটিটা সরিয়ে নেয়। অবাক হয়ে মালার দিকে তাকায় সোনিয়া………..
#সংসারের_সাতকাহন
পর্ব ১১
©️সৈয়দা রাজিয়া বিল্লাহ