একা আন্টি উনার মেয়ে নাবাকে একটা কেজি স্কুলে ভর্তি করান। কিছুদিন পরে জানতে পারেন স্কুলে নতুন টিচার নেয়া হবে। উনি এসে সোনিয়াকে জানান। পরে সোনিয়ার বাবা মা রাজি হলে সোনিয়া সেই স্কুলে এপ্লাই করে।
একা আন্টির পরিচিতির জন্য নাকি সোনিয়ার নিজের মেধায় জব হয়ে যায় ওর সেই স্কুলে। নাবার সাথে আরো বেশি সময় কাটানোর সুযোগ হয়। স্কুলে সোনিয়াকে একটাই ক্লাস নিতে হত, নাবাদের ক্লাস। মাসখানেক ক্লাস নিতেই অভিভাবকদের কাছে প্রিয় শিক্ষক হয়ে উঠে সোনিয়া।
সোনিয়া নিজ দায়িত্বে প্রতি সপ্তাহে বাচ্চাদের ক্লাস টেস্ট নিত, বাচ্চাদের ক্লাসের প্রগ্রেস নিয়ে অভিভাবকদের সাথে আলোচনা করে। সহকর্মীদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণে অল্পদিনেই সবার মন জয় করে নেয় সোনিয়া।
স্কুলের সময়ের বাইরে সোনিয়া ওর প্যাশন, সেলাই নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। ঢাকা যাওয়ার আগে ও কিছু মেয়েদের দিয়ে সেলাই করিয়ে নিত। ঢাকা থেকে ফিরে ওদের সাথে আবারও যোগাযোগ করে। আস্তে আস্তে শুরু করে ওর পুরনো বিজনেস।
এভাবেই চলে আসে রমজান মাস। দিনে দিনে একার সাথে সোনিয়ার গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। একা বিভিন্ন জায়গা থেকে সোনিয়ার জন্য বিয়ের প্রস্তাব আনে সোনিয়ার মায়ের অনুরোধে। কিন্তু সোনিয়া বিয়েতে রাজি হয়না। বিয়ের প্রস্তাব এলেই মুনিয়ার মৃত মুখ চোখে ভেসে উঠে সোনিয়ার। বিয়ের নামেই ভয় পায়। একাকে অনেক অনুরোধ করে বিয়ের প্রস্তাব না আনতে। সোনিয়ার বাবা মা রেগে যায় সোনিয়ার উপর। একা উনাদের বুঝায় সোনিয়াকে আরো সময় দিতে। হাল ছেড়ে দিয়ে সোনিয়ার বাবা মা কেউই ওকে বিয়ের কথা বলেনা আর।
মিলন পর্ব
সাদিকের কাজিন সাইফ আসে সাদিকের সাথে দেখা করতে। দুজনের বয়সের পার্থক্য মাত্র ৬ মাস। ছোট থেকেই দুজন একসাথে বড় হয়েছে। মানিকজোড় যাকে বলে। দেখা হতেই একে অপরকে জড়িয়ে ধরে। অনেক গল্প জমে আছে দুজনের, চার বছরের বেশি সময় পরে দেখা হল। দুই ভাইয়ের।
পরদিন বগুড়ায় থাকা আত্নীয়দের সাথে একে একে গিয়ে দেখা করে আসে সাদিক। সবারই একই কথা – চার বছর পরে দেশে আসছ, বিয়ে করে যাবা। বাসায় ফিরে মাকে সব জানিয়ে বলে এইজন্যই আমি আসতে চাইনি দেশে। বিয়ের কথা আমাকে যেন আর কেউ না বলে, তাহলে আমি চলে যাব।
প্রথম রোজা, চার বছর পরে মায়ের হাতে বানানো ইফতার নিয়ে বসেছে সাদিক। ইফতারের প্লেট সামনে নিয়েই চোখে পানি চলে আসে ওর। মনে মনে দুয়া করে আল্লাহ যেন ওর মা-বাবার সকল চাওয়া পূরণ করে। সেই মুহূর্তে সাদিকের মা-বাবা ইফতার সামনে নিয়ে আল্লাহর কাছে ছেলের বিয়ের জন্য দুয়া করছিলেন।
পরদিন সাদিক ঘুম থেকে উঠার আগেই মোস্তারী বেগম যান সাইফদের বাসায়, সাইফের মা উনার জা। যেকোনো বিষয়ে পরামর্শের জন্য মোস্তারী বেগম ভরসা করেন উনার এই জায়ের উপর। জা হালিমা বেগমকে জানান সাদিকের জন্য একটা মেয়ে দেখে রেখেছেন মনে মনে কিন্তু রাদিক ছাড়া এখনো এই ব্যাপারে কেউ জানেনা। সাদিকের কাছে কেমনে কথা পারবেন বুঝতে পারছেন না। জায়ের কাছে শুনে হালিমা বেগম কাজের জায়গায় গিয়ে মেয়ে দেখে আসেন।
একই পাড়ায় থাকার সূত্র ধরে সোনিয়াকে অনেক দিন ধরেই মনে মনে পছন্দ করে রেখেছেন মোস্তারী বেগম। রাদিকের ও পছন্দ তাকে। মালাপু যখন দেশের বাইরে চলে যায় তখন থেকেই সে সোনিয়াদের বাসায় যাতায়াত করত। সদ্য তার বোন দেশের বাইরে গেছে জানার পরে সোনিয়া তার সকল স্নেহ ঢেলে দিয়েছিল রাদিকের উপর। সেকারণেই মা ছেলে দুজনেরই তাকে খুব পছন্দ। কিন্তু সমস্যা হল বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে?
মোস্তারী বেগমের পছন্দের মেয়ের ব্যাপারে আস্তে আস্তে পরিবারের সবাইই জেনে যায় কিন্তু কেউই সাহস করে সাদিককে বলতে পারেনা। এভাবেই চলে যায় পুরো রোজা, ঈদ চলে আসে। ঈদের পরদিন সবাইকে বাসায় দাওয়াত দেন হালিমা বেগম। সেখানেই দুপুরের খাওয়ার সময় সুযোগ বুঝে সাদিকের বিয়ের কথা পারেন সবার মাঝে। সবাই যেহেতু জানতোই মেয়েটা কে সেহেতু তারাও যার যার নিজেদের মতো সোনিয়ার গুণকীর্তন শুরু করে দেয়। পরিবারের সবার মুখে সোনিয়ার এতো সুনাম শুনে প্রথম বারের মতো নরম হয় সাদিক।
সবার মুখে কন্যার গুণকীর্তন শুনে সাদিক মনে মনে ভাবে ‘যেহেতু মুটামুটি সবাইই তাকে চিনে আর ভালো বলতেছে তাহলে একবার দেখাই যাক মেয়েটাকে। আমিতো বিয়ে করতে চাচ্ছিলাম না যদি অন্য পরিবারের মেয়ে আমাদের পরিবারে অশান্তি করে সেই ভয়ে।’
সাইফের সাথে এই ব্যাপারে হালকা আলোচনা করে সাদিক। সাদিক ওকে উৎসাহ দিয়ে বলে, “সবাই যেহেতু ভালো বলতেছে তাহলে বুঝতে হবে মেয়েটা আসলেই ভালো। আর চাচীতো এমনি এমনি কাউকে পছন্দ করবে না। নিশ্চয় পছন্দ করার মতো কারণ আছে। তুই আর না করিস না।”
সাইফের এই কথা শুনে ভাবার জন্য আরো কিছু সময় চায় সাদিক। সাইফ ওকে মনে করিয়ে দেয় ওর ছুটি আর মাত্র দেড় মাস। বেশি ভাবতে গিয়ে সময় যেন নষ্ট না করে।
সোনিয়ার মা ঈদের একদিন পরে গ্রামের বাড়ি যায় ওদের বাড়ির কাজের মেয়েটাকে রেখে আসার জন্য। রান্না করে রেখেই যান উনি। দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে এই সময় একা নিচে আসে। সোনিয়া, ওর বাবা আর একা গল্প করছে এই সময় হঠাৎ দরজায় নক হয়। শব্দ শুনে দরজা খুলতে যায় সোনিয়া। দরজা খুলেই দেখে সামনে ওর স্কুল লাইফের ক্রাশ মালা দাঁড়িয়ে, সাথে মালার মেয়ে, আর একটা মহিলা। মালা পরিচয় করিয়ে দেয় ওর কাজিন বলে। নাম জুঁই।
মালা আর সোনিয়া একই স্কুলে পরত। মালার মিষ্টি হাসি খুব পছন্দ ছিল সোনিয়ার। একসাথে স্কুলে যেত দুজন। সোনিয়া যখন ক্লাস সেভেনে পড়ে তখন মালা পরত নাইনে। এস এস সি পরীক্ষার পরে মালার বিয়ে হয়ে যায়। পরের বছর সে চলে যায় দেশের বাইরে, হাসবেন্ডের কাছে। এদিকে মালা যাওয়ার পরপরই রাদিককে সোনিয়ার বাবার কাছে প্রাইভেট পড়াতে দেন ওর বাবা। সেই সূত্রে রাদিক ওদের বাড়িরই ছেলে হয়ে যায়। তার উপর মালা ছিল সোনিয়ার ক্রাশ তাই মালা বাইরে যাওয়ার পরে রাদিক যাতে মালার অভাব খুব বেশি অনুভব না করে সেজন্য সোনিয়া ওর সকল স্নেহ উজাড় করে দেয় রাদিকের উপর। রাদিকের খোঁজ নিতেই সোনিয়া কয়েকবার রাদিকদের বাসায় যায়। তখনই রাদিকের মা ওকে পছন্দ করে রাখেন সাদিকের জন্য কিন্তু কাউকে সেটা বলেন না।
সোনিয়া মালাকে দেখে খুব খুশি হয়ে যায়। অনেকদিন পরে দেখা ওর লেডিক্রাশের সাথে। হাত ধরে টেনে ঘরে নিয়ে বসায় ওকে। তখন গল্পের ছলে জুঁই জানায় ওর কাজিন সাদিকের জন্য মেয়ে খুঁজতেছে ওরা। সোনিয়ার খোঁজে কেউ আছে নাকি? সোনিয়া জানায় ওর ফ্রেন্ড সার্কেলের সবারই বিয়ে হয়ে গেছে। মুখ চাওয়া চাওয়ি করে হাসে দুই বোন। তারপর ……
#সংসারের_সাতকাহন
পর্ব ৩
©️সৈয়দা রাজিয়া বিল্লাহ