#সংসারের_সাতকাহন
পর্ব ৯
সোনিয়া পার্লার থেকে ফিরে জুমার আজানের পরে। বাসায় ফিরলে ওর মামাতো বোন একটা প্লেটে করে সামান্য পোলাও এনে ওকে খাইয়ে দেয়। বাসার সব পুরুষেরা জুমার নামাজ শেষ করে বাসায় ফিরে। বেলা ৩টা বেজে যায় তাও বরযাত্রী আসার খবর নাই। সবাই মুটামুটি টেনশনে পরে যায়। সোনিয়াকে কল দিতে বলে সবাই। সোনিয়া কল দিলে রিং হয় কেউ ধরেনা। এভাবে কয়েকবার চলার পরে সোনিয়ার থেকে নম্বর নিয়ে একার হাসবেন্ড কল দেয় সাইফকে। তখন ওরা জানায় ওরা চারটার মধ্যে এসে যাবে।
সোনিয়ার চাচা একটু রাগ করেন, হাঁটা দূরত্বে বাসা, এতো দেরী করার তো কোন কারন নাই। ৪.১৩ তে সাদিকেরা আসে। সাদিক, ওর মা, ওর দাদী আর ওর বাবা কারে বাকিরা সবাই হেঁটে। সোনিয়ার নানা আংটি পরিয়ে সাদিককে কার থেকে নামান। সকল ফর্মালিটি শেষ করে মেয়েরা নিচে সোনিয়াদের বাসায় ঢুকে আর ছেলেরা যায় উপরে একার বাসায়। সিঁড়িতে সোনিয়ার চাচাতো বোন, মামাতো বোনেরা সাদিককে গেট ধরে। সাইফ যে টাকা দেয় তা ওদের পছন্দ হয়না। সোনিয়ার এক চাচাতো বোন বলে এতো কম টাকা তো আজকাল কাজের মেয়ের বিয়েতেও দেয়না। এই কথা শুনে সাদিকের রাগ উঠে যায় কিন্তু নতুন জামাই তাই কিছু বলতে পারেনা।
সাদিকেরা উপরে গিয়ে বসে। একটু পরে আসে কাজী সাহেব। উনি দুইপক্ষের থেকে সব শুনে নিয়ে লিখে রেডি করে নিচে যান সোনিয়ার এজেন নিতে। সোনিয়া কাজী সাহেব বলার পরে এত দ্রুত ‘কবুল’ বলে যে উপস্থিত সবাই থমকে যায়। কাজী সাহেব নিজেকে সামলে নিয়ে আরও দুইবার কবুল বলা শুনে উপরে যান। উপরে গিয়েও দেখেন একই কাহিনী। সাদিকও সোনিয়ার মতো দ্রুত জবাব দেয়। বিয়ে পড়ানো হলে কাজী সাহেব দুয়া করে খাওয়াদাওয়া সেরে চলে যান।
সাদিকের জন্য সাজানো স্পেশাল প্লেট আসে। কিন্তু সাদিক প্রায় কিছুই খায়না। সোনিয়ার চাচাত বোনের কথা তখনও ওর মাথায় ঘুরছে। বিয়ে পরানোর পরে সাদিক সাইফকে বলে “বিয়ে তো হয়ে গেছে, সোনিয়া তো এখন আমার বউ তাইনা? তাহলে আমি ওকে নিয়ে চলে যাই।” সাইফ হেসে উঠে সাদিকের কথায়। বলে “ধৈর্য ধর, সোনিয়ার মা বাবা এখনও তোমার হাতে তাদের মেয়েকে তুলে দেয়নি।”
সবার খাওয়াদাওয়া হয়ে গেলে সাদিককে নিচে ডাকা হয়। সেখানে সোনিয়াকে তুলে দেয়া হয় সাদিকের হাতে। সোনিয়া সেই সময় এক ফোঁটাও চোখের পানি ফেলে নাই। সবাই অবাক হয়ে যায়। না সোনিয়া, না ওর বাবামা। মনে হচ্ছে ব্যাপারটা এমন যে সোনিয়ারও বিয়ের তাড়াহুড়া, ওর বাবামায়ের ও মেয়ে বিদায়ের তাড়াহুড়া। আসল ব্যাপার হল সোনিয়ার সেদিন বিদায় হয়নি, সাদিক ওদের বাসাতেই থাকছে। যেহেতু সোনিয়াকে অন্য কোথাও যেতে হচ্ছেনা তাই ও ভাবছে কান্না করে মেকআপ নষ্ট করি কেন?
সাদিকের হাতে তুলে দেবার পরে ওরা সবাই আবার উপরে চলে যায়, মুরুব্বিরা বাদে। সেখানে দুজনের একসাথে ফটোসেশন হয়, মালাবদল হয়, মিষ্টি খাওয়া, আয়না দেখান সহ নানারকম মেয়েলি আচার অনুষ্ঠান হয়। এদিকে সাদিকেরা আসার সময় গেট ধরেও সুবিধা করা যায়নি, যেহেতু সাদিক থেকে যাচ্ছে জন্য জুতা চুরি করেও সুবিধা করা যাবেনা তাই সোনিয়ার কাজিনেরা কিঞ্চিৎ মন খারাপ করে।
সন্ধ্যার পরে সবাই যার যার বাসায় চলে যাবে তাই তখনই সোনিয়াকে বাসর ঘরে নিয়ে যায়। গিয়ে দেখে ওর কাজিনেরা ঘর অন্ধকার করে মেঝেতে ফুল দিয়ে তার মাঝে ছোট একটা কেক আর মোমবাতি জ্বালিয়ে রেখেছে। সোনিয়া দরজার সামনে যেতেই ওরা সোনিয়াকে গেটে আটকায়, বলে এখানেই কেক কেটে ঘরে ঢুকো। সোনিয়া ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নিভাতেই সবাই চিৎকার করে উঠে Happy birthday to u, তখন সোনিয়া বলে “আরে আমার বার্থডে চলে গেছে দুই মাস আগে, ৩রা সেপ্টেম্বর, আজ ৩রা নভেম্বর এখন কিসের বার্থডে?”
ওর কাজিনেরা সমস্বরে বলে নতুন জীবনে প্রবেশের বার্থডে। সোনিয়াকে রুমে দিয়ে ওর কাজিনেরা বিদায় নিয়ে চলে যায়। তখন মালা, জুঁই, রাদিক, সাইফ ওরা সবাই আসে বাসর ঘরে ছবি তুলতে। সোনিয়াকে খাটে বসিয়ে দিয়ে চারপাশে সবাই গোল হয়ে বসে ছবি তোলার জন্য। দয়া করে সাদিককেও বসতে দেয় এক কোনায়। ফটোসেশনের পরে সবাই চলে যায়। সাদিক আর সোনিয়া একা হয়ে যায়। টুকটাক কথা বলতেই ডাকতে আসে সোনিয়ার সেই কাজিন, যে গেটে কথা বলেছিল সাদিকের সাথে। সোনিয়ার মা ওদের নিচে ডাকছে। খাওয়াদাওয়া শেষে ওরা উপরে আসে, নক করে দেখে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ, রাত তখন ১২টা। সোনিয়া একার নম্বরে কল দিয়ে দেখে বন্ধ, তখন উপায় না দেখে কলিং বেল চাপে। একার হাসবেন্ড এসে দরজা খুলে দেয়। একার বাসার মেইন এন্ট্রি ড্রইং রুম দিয়ে। ড্রইং রুমে ঘুমাতো একার বাসার মেইড। তাকে একা বলেছিল সে যেন দরজা খুলে রেখে ঘুমায় কারন সোনিয়ারা উপরে আসবে। কিন্তু সে সব কাজ শেষ করে ঘুমানোর সময় সেটা ভুলে গিয়ে অভ্যাসমতো দরজায় উপর নিচে ছিটকিনি দিয়ে ঘুমায়। যার কারণে ওরা ঢুকতে পারেনা।
ওরা রুমে চলে আসে। সোনিয়া বলে ও ফ্রেশ হবে, সাদিক অনুরোধ করে থাকনা আরো কিছুক্ষণ। কিন্তু সোনিয়ার স্কিনে মেকআপ বেশিক্ষণ থাকলে ওর সমস্যা হয় তাই স্কিনের দোহাই দিয়ে ও একটা তাঁতের থ্রিপিস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। রুমে ঢুকেই সোনিয়া প্রথমেই সাদিককে একটা সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্ন করে। সোনিয়া ভেবেছিল সাদিক উত্তর দিতে পারবেনা। কিন্তু সোনিয়াকে অবাক করে দিয়ে সাদিক ওর প্রশ্ন শেষ হবার সাথে সাথেই উত্তর দেয়।
সোনিয়া ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে সাদিক রুমে নাই, ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। সোনিয়া ব্যালকনিতে গিয়ে রুমের দেঁয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায় আর সাদিক দাঁড়িয়ে ছিল বারান্দার গ্রিলে পিঠ ঠেকিয়ে। রোজার ঈদের ঠিক ১০ দিন পরে ওদের বিয়ে হয়, সুতরাং বুঝতেই পারছেন আকাশে চাঁদের অবস্থান ও সাইজ কেমন ছিল রাত ১২টার পরে। সোনিয়া চাঁদের দিকে তাকিয়ে সাদিককে বলে। “দেখ আজকের পরিস্কার আকাশে চাঁদটা কত সুন্দর লাগছে।” উত্তরে সাদিক বলে, “আমিতো চাঁদ দেখছিই। এইযে আমার সামনে।” সোনিয়া প্রথমে অবাক হয় কারন সাদিক আছে চাঁদের দিকে পিঠ দিয়ে, তাহলে কেমনে দেখল? পরমুহুর্তে কথার মানে বুঝতে পেরে লজ্জা পায়, সেই সাথে একটা ভালোলাগাও কাজ করে যে সবাই বলছে সাদিক কথা বলেনা কাঠখোট্টা আসলে তা না।
সোনিয়াকে ব্যালকনিতে রেখে সাদিক রুমে গিয়েই ফিরে আসে একটা খাম হাতে নিয়ে। সোনিয়া জানতে চাইলে বলে খুলে দেখতে। সোনিয়া খুলে দেখে ১০০ টাকার কয়েকটা চকচকে নোট। সাদিকের সামনে সে আর গুণতে যায়না। লজ্জা শরম বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। বগুড়ায় অক্টোবরের শেষের দিক থেকেই হালকা ঠান্ডা পরে। তাই বাইরে থেকে ওরা ভিতরে এসে বসে। সোনিয়ার প্রচন্ড ঘুম পায়, তাই ও উঠে খাটের ভিতরের দিকে গিয়ে পিঠের নিচে বালিশ দিয়ে হেলান দিয়ে বসে। সাদিক কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলে উঠে……..
#সংসারের_সাতকাহন
পর্ব ৯
©সৈয়দা রাজিয়া বিল্লাহ