বইছে আবার চৈতি হাওয়া
২৮.
লাইব্রেরীতে ঢুকে শুভ থমকে গেল। মীরা আশিক আর মারুফ একটা কম্পিউটার টেবিলে বসে কাজ করছে। আশিকই মূলত কাজটা করছে মীরা পাশ থেকে দেখিয়ে দিচ্ছে। শুভর মেজাজটা এমনিতেই খারাপ ছিল আরো খারাপ হয়ে গেল। অসংখ্যবার ফোন দেওয়ার পরে ও মীরা ফোন ধরেনি। ক্যাম্পাসেও এড়িয়ে গেছে। শুভ কষ্ট করে মাথা ঠান্ডা রেখে এগিয়ে গেল। না, আর কোন ভুল করা যাবে না। একবার মাথা গরম করে ভুল করে ফেলেছে। আগে হলে ও এত বিচলিত হতো না। মীরা আর কদিন রাগ করে থাকতো, কদিন পর ঠিকই ওর কাছে আসত আবার। কিন্তু এখন কেন যেন মনে হচ্ছে এই জিনিসটা দীর্ঘায়িত হলেই ওদের সম্পর্কটা ভেঙে যাবে। সে ক্ষেত্রে মীরা ওর চোখের সামনে আশিকের সঙ্গে….। না, আর ভাবতে পারছে না। যে করেই হোক এটা ঠিক করতে হবে। শুভ এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়ালো, তারপর বলল
-মীরা তোমার সঙ্গে কথা আছে। একটু আসবে
মীরা অন্যদিকে তাকিয়েই বলল
-আমার কাজ এখনো শেষ হয়নি
শুভ খুব নরম গলায় বলল
-তাহলে কাজ শেষ করো, আমি বাইরে অপেক্ষা করি
– কাজ শেষ করে আমি টিউশনিতে যাব অপেক্ষা করার দরকার নেই
শুভ ভেতরে ভেতরে রাগে ফেটে পড়লে ও বাইরে সেটা প্রকাশ করল না। বলল
– প্লিজ মীরা
মীরা কিছু বলতে যাচ্ছিল, আশিক ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল
-মিরা, যেটুকু আছে আমরা করে ফেলতে পারবো। তুমি যাও।
বাধ্য হয়ে মিরাকে উঠতে হলো। আশিক তাকিয়ে আছে। শুভ আর মীরা
হেটে বেরিয়ে যাচ্ছে। মীরা শুভর দিকে তাকাচ্ছে না, অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বলছে। আশিক একটু হাসলো। মেয়েটা বোধহয় রেগে গেলে তার দিকে তাকায় না। আশিক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারো কাজে মনোযোগী হল। অনুষ্ঠানের আর বেশি বাকি নেই। কাজগুলো দ্রুত শেষ করে ফেলতে হবে
শুভর অনেকটা সময় লাগলো মীরাকে ম্যানেজ করতে; তবে শেষ পর্যন্ত সফল হল। অনেক করে বুঝিয়ে বলল যে , ও খুব ইনসিকিউরড ফিল করছিল। মিরাকে এখানে একা ফেলে যাবার কথা কিছুতেই ভাবতে পারছিল না। এই মুহূর্তে বাসায় কথা বলা সম্ভব হচ্ছিল না, তাই জোর করছিল বিয়ের জন্য। ভেবেছিল হয়তো পরিবারের দোহাই দিলে মীরা রাজি হবে , তাই ওসব বলেছিল। ওর পরিবার সম্পর্কে এই ধরনের মন্তব্য করার কোন ইচ্ছাই ওর ছিল না। যা বলেছে তার জন্য অনেক বার করে ক্ষমা চাইলো।
শুভ ওর দাদা বাড়িতে থাকে। ওদের যৌথ পরিবার চাচা চাচি এবং চাচাতো ভাই বোনদের সঙ্গে। শুধুমাত্র ওর বাবা-মা দেশের বাইর থাকে। সামনে ওর চাচাতো বোনের বিয়ে, সেই উপলক্ষে শুভর বাবা মা দেশে আসছে। শুভ প্রতিশ্রুতি দিল, এবার বাবা-মা দেশে ফিরে এলে মিরাকে ওদের সঙ্গে দেখা করবে। মীরা যেভাবে চায় সেভাবেই বাড়িতে প্রস্তাব পাঠানো হবে।
কৌশল করে শুভ আশিকের ব্যাপারটা এড়িয়ে গেল, যেন ওদের দুজনকে নিয়ে ওর মনে কোন সন্দেহের উদ্রেকই হয়নি। সময় লাগলেও শেষমেষ মীরা মেনে নিল। যেহেতু ওর নিজের বাড়ি থেকেও বিয়ের কোন চাপ নেই, বড় চাচা সৌরভের বিয়েটা মেনে নিয়েছেন ,কাজেই আপাতত বিয়ের প্রসঙ্গ নিয়ে না ভাবলেও চলবে।
কয়েকটা দিন এভাবেই চলল। মীরা সবটা মেনে নিয়েছে। সবকিছু আবার আগের মতন হয়ে গেলেও কোথায় যেন একটা তাল কেটে গেছে। ওদের সম্পর্কে যেটুকু বা গভীরতা ছিল সেটাও আর খুঁজে পেল না মীরা। সম্পর্কটা কেমন ভাসা ভাসা, শরতের মেঘের মতন। এই আছে তো এই নেই। অবশ্য আপাতত এত কিছু নিয়ে ভাবার সময় নেই মীরারা। টিউশনি জুয়েলারির অর্ডার ,অনুষ্ঠানের কাজ এসব নিয়েই মহাব্যস্ত হয়ে আছে। আশিকের কথা মতো মীরা ওদের কাছে কিছু এডভান্স দাবি করেছে। ওরাও খুব সহজভাবে মেনে নিয়েছে। দুই হাজার টাকা বিকাশ করে দিয়েছে। মীরা সমস্ত জিনিসপত্র কিনে সেটগুলো রেডি করে ফেলেছে; কিন্তু সমস্যা বেধেছে অন্য জায়গায়। ওরা কিছুতেই পিক করতে চাইছে না, বলছে ডেলিভারি করতে। উত্তরার একটা ঠিকানা পাঠিয়েছে। মীরা বুঝতে পারছে না কি করে ওখানে যাবে।
এবার বইমেলা বেশ জমজমাট ভাবে হচ্ছে। মীরার খুব ইচ্ছা ছিল যাবার; কিন্তু এত ব্যস্ততার মধ্যে আছে , তাই আর সময় করে উঠতে পারছে না। সবমিলিয়ে দম ফেলার সময় নেই।
স্টেজ ডেকোরেশনের সমস্ত ব্যানার প্রিন্ট হয়ে চলে এসেছে। আশিকের অফিসে রাখা আছে। আজকে পাঁচটার সময় মিটিং। সবকিছু ফাইনাল করে ফেলতে হবে। মীরার ক্লাস ছিল না। তিনটার সময় সাধারণত ও টিউশনতে যায়। একবারে পড়ানো শেষ করে আশিকের অফিসে যাবে ঠিক করল। পড়ানো শেষ করতে করতে সাড়ে চারটার বেশি বেজে গেল। মিরা ঝটপট রিক্সা নিয়ে আশিকের অফিসে চলে গেল। ভেবেছিল পৌছে দেখবে সবাই চলে এসেছে। কিন্তু ওখানে পৌঁছে কাউকেই দেখতে পেল না। সেদিনকার মতই সদর দরজা খোলা। মীরা ভেতরে ঢুকেও কাউকে খুঁজে পেল না। ছাদ বারান্দা থেকে শব্দ ভেসে আসছে। নিশ্চয়ই সবাই ওখানে আড্ডা দিচ্ছে। মীরা আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল। ওই তো, আশিক ভাইকে দেখা যাচ্ছে। আর কেউ তো নেই। একাই হেঁটে হেঁটে রিহার্সেল করছে। নিশ্চয়ই এই কবিতাটাই আবৃত্তি করবে প্রোগ্রামের দিন। মীরা ভিতরে গেল না , পাছে ওকে দেখে আশিক ভাই থেমে যায়। ওখানেই দেয়ালের সঙ্গে সেটে দাঁড়িয়ে রইল। কি অদ্ভুত সুন্দর আবৃত্তি করে করে আশিক ভাই। ইচ্ছে করে সারাদিন ধরে শুনতে।
ইচ্ছে ছিলো তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো
ইচ্ছে ছিলো তোমাকেই সুখের পতাকা করে
শান্তির কপোত করে হৃদয়ে উড়াবো।
ইচ্ছে ছিলো সুনিপূণ মেকআপ-ম্যানের মতো
সূর্যালোকে কেবল সাজাবো তিমিরের সারাবেলা
পৌরুষের প্রেম দিয়ে তোমাকে বাজাবো, আহা তুমুল বাজাবো।
ইচ্ছে ছিলো নদীর বক্ষ থেকে জলে জলে শব্দ তুলে
রাখবো তোমার লাজুক চঞ্চুতে,
জন্মাবধি আমার শীতল চোখ
তাপ নেবে তোমার দু’চোখে।
ইচ্ছে ছিল রাজা হবো
তোমাকে সাম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো,
আজ দেখি রাজ্য আছে রাজা আছে
ইচ্ছে আছে, শুধু তুমি অন্য ঘরে।
চলবে……
আজকের কবিতা “ইচ্ছে ছিল” লিখেছেন হেলাল হাফিজ