বইছে আবার চৈতি হাওয়া
২৯.
মেঘের গর্জন শুনে আশিক আকাশের দিকে তাকালো। সন্ধ্যা নামতে এখনো দেরি আছে, কিন্তু আকাশ অন্ধকার হয়ে আছে। কি অদ্ভুত! একটু আগেও ঝলমলে রোদ ছিল। এখন মনে হচ্ছে ঝুম বৃষ্টি নামবে। হঠাৎই দু-একটা বৃষ্টির ফোঁটা ওর মুখের উপর এসে পড়ল। আশিক দরজার দিকে এগিয়ে গেল। ভেতরে ঢুকে চমকে তাকিয়ে বলল
তুমি কখন এলে মীরা?
মীরা একটু লজ্জা পেয়ে বলল
-এইত কিছুক্ষন। আপনি রিহার্সাল করছিলেন তাই আর বিরক্ত করিনি। এই কবিতাটাই করবেন প্রগ্রামের দিন?
-আরে ধুর! একুশে ফেব্রুয়ারিতে কেউ এই কবিতা পড়ে?
– সুন্দর হচ্ছিল খুব
– থ্যাঙ্ক ইউ
বাইরে মেঘের গাজন শুরু হল সেইসংগে পাল্লা দিয়ে ঝড়ো হাওয়া। পুরানো দিনের জানালার কপাটগুলো শব্দ করে আছড়ে পড়তে লাগলো। আশিক জানালা বন্ধ করে ঘরের আলো জেলে দিল। তারপর চিন্তিত মুখে বলল
-রাসেল আর মারুফের আসার কথা, ব্যনার আর স্পিকারগুলো নিয়ে। এই রকম অবস্থা থাকলে তো জিনিসগুলো সব নষ্ট হয়ে যাবে। তারপর একটু থেমে বলল
-মীরা তুমি বস, আমি আসছি। আশিক পাশের ঘরে গিয়ে মারুফকে ফোন করে জানতে পারলো যে, ও ডেকরেটরের ওখানে আটকা পরেছে। রাসেলকেও ফোন দিল কিন্তু ও ধরলো না। আশিক ফিরে এসে মীরাকে কোথাও দেখতে পেল না। রান্নাঘরে উকি দিয়ে দেখল , ও কি যেন সব তৈরি করছে , আশিক কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে রইল। ওকে দেখতে ভালো লাগছে। কি সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কাজ করছে, মনে হচ্ছে যেন এটা ওরই রান্নাঘর। আশিকের হঠাৎই মনে হল ,আচ্ছা , মীরার আর ওর যদি একটা সংসার হত তাহলে কেমন হতো? এই রকম ঝুম বৃষ্টির দিনে মিরা চা আর পিয়াজু বানাত, তারপর দুজন গল্প করতে করতে রাত ভোর করে দিত। নিজের ভাবনায় আশিক নিজেই বিরক্ত হল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্নাঘরে ঢুকে বলল
– তুমি কিছু খুঁজছো মিরা?
– হ্যাঁ একটা বড় বাটি খুজছিলাম
– ওপরের তাকে আছে দেখো
আশিক আর কিছু জানতে চাইলো না, রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আবার ফোনে ব্যস্ত হয়ে গেল।
মীরা কেটলিতে চায়ের জন্য জল চাপিয়েছে। ইলেকট্রিক কেটলিগুলো দু-মিনিটের মধ্যেই জল ফুটিয়ে ফেলে। মীরা ব্যাগ থেকে চানাচুর বের করে বাটিতে ঢাললো। আসার আগে স্টার থেকে কিনেছে। সাধারণত মীরা টুকটাক খাবার রাখে নিজের রুমে। কখনো ক্লাস করতে দেরী হলে বা ল্যাব থাকলে ফিরে এসে সন্ধ্যাবেলা খায়।
আজ চা পাতা খুঁজতে গিয়ে তাকের মধ্যে এক প্যাকেট মুড়ি খুঁজে পেয়েছে, তাই মনে হল একটু মুড়ি মাখাতে। বাড়িতে থাকতে বিকেলবেলার নাস্তা বানানোর দায়িত্বটা ছিল মীরার। কোনদিন পিয়াজু, কোনদিন মুড়ি মাখা বা চটপটি-ফুচকা, আলুর বড়া আরো কত কি বানাত। সন্ধ্যে হলে সৌরভ ভাই আর বড় চাচা বাড়ি ফিরলে সবাই একসঙ্গে খেত। কি মিষ্টি ছিল সেই দিনগুলো। আজ কেন যেন বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে। পেছনের উঠোনে এইরকম বৃষ্টিতে ওরা তিন বোন একসঙ্গে ভিজতো। মা খুব রেগে যেতেন।
একটু সরিষার তেল থাকলে খুব ভালো হতো , সঙ্গে কাঁচা মরিচ, পেয়াজ আর ধনেপাতা তার একটুখানি টমেটো। যাক, কি আর করা। শুধু মুড়ি চানাচুরই খেতে হবে। মীরা যত্ন করে দুটো বাটিতে মুড়ি মাখা নিয়ে ঘরে ঢুকে দেখল আশিক পাশের ঘরে ফোনে কথা বলছে। মুড়ি নেতিয়ে যাবে বলে মীরা তাড়াতাড়ি রান্না ঘরে চা করতে চলে গেল।আশিক কথা শেষ করে ঘরে এসে শুনলো মিরা তখনও রান্নাঘরে ঠুনঠান করে কিছু করে যাচ্ছে। টেবিলের দিকে তাকিয়ে ও হতভম্ব হয়ে গেল। ওখান থেকেই গলা উচিয়ে বলল
-মিরা, এটা কি তুমি বানিয়েছ?
– জি আশিক ভাই, আপনি শুরু করেন , আমি চা নিয়ে আসছি
মীরা চা নিয়ে ফিরে এসেছে, ততক্ষণে আশিক খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। মীরা চেয়ারে বসে চায়ের কাপ টেনে নিল। আশিক খুব আগ্রহ করে খাচ্ছে, দেখে মনে হচ্ছে অসম্ভব ক্ষুধার্ত। মীরা আস্তে আস্তে বলল
– আপনি কি সকাল থেকে এখানেই?
– হ্যাঁ কাজগুলো শেষ করছিলাম
– কিছু খেয়েছেন সকাল থেকে?
– না কিছু খাওয়া হয়নি, ভেবেছিলাম কিছু অর্ডার দেব, পরে ভুলে গেছি।
মীরার একটু খারাপ লাগলো। এমন কাজ পাগল হয় মানুষ। মিরা ওর বাটিটা এগিয়ে দিয়ে বলল
-আপনি এটাও খেয়ে নিন
– না না, আর লাগবে না। তুমি খাও
-আরও আছে। আমি খেয়ে নেব। আপনি নিন, আমি চা নিয়ে আসছি
মীরা চা আনতে উঠে গেল। আশিক কিছুক্ষণ ওর যাত্রা পথের দিকে তাকিয়ে রইল। মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। এরকম বৃষ্টির দিনে মা এসব ভাজা-ভুজি খুব করতেন। আশিক খুব ভালবাসত খেতে, এখনো ভালবাসে, তবে এখন আর কেউ এত যত্ন করে খাওয়ায় না। মীরা চা নিয়ে ফিরে এসেছে। আশিক খেতে খেতেই বলল
-তুমি যখন এখানেই আছো তখন এসো তোমার কাজটা শেষ করে ফেলি। একটা কাজ অন্তত হোক
-আচ্ছা
খাওয়া শেষ করে দুজনেই ল্যাপটপে ব্যস্ত হয়ে গেল। বাইরে তখনও ঝড়ের তীব্রতা একইভাবেই চলছে, কিন্তু দুজনেই কাজে এমন ডুবে ছিল যে কেউ খেয়াল করল না। কাজ শেষ করতে করতে আটটা বেজে গেল। আশিক তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুলে কপালে দুই পাশ চেপে ধরে বলল
-যাক তোমার কাজটা অন্তত শেষ হল, তোমার আর না আসলেও চলবে।
হঠাৎই জানালার কাজ ভাঙার শব্দে দুজনে সম্বিত ফিরে পেল। পুরনো জানালার কাচ ঝড়ের দাপটে ভেঙ্গে পড়েছে। আশিক চিন্তিত মুখে উঠে গেল। ঘড়ি দেখে বলল
-তোমার ফেরার ব্যবস্থা করা উচিত। রাত বাড়ছে। দাঁড়াও, আমি বাসায় ফোন দিয়ে দেখি গাড়ির কি অবস্থা।
বাড়িতে ফোন দিয়ে জানা গেল গাড়ির কার্বুরেটরে জল ঢুকে অবস্থা খারাপ। গ্যারেজে নিতে হয়েছে। আশিক চিন্তিত কন্ঠে আবারো বলল
-চলো আমিই তোমাকে দিয়ে আসছি। হলে যাবে তো?
-হলে অথবা শ্যামলী যেটা সুবিধা হয়
দরজা খুলতেই প্রচন্ড ঝড়ের দাপটে দরজা আবারো আছড়ে পড়ল। সেইসঙ্গে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল একগাদা ভেজা পাতা আর খানিকটা বৃষ্টির জল। আশিক তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দিল। পাশের বারান্দা থেকে দেখল আশেপাশে রিক্সা দেখা যাচ্ছে না। ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৃষ্টির বেগ ও বাড়ছে। কিছুক্ষণ উবারের জন্য চেষ্টা করল কিন্তু সুবিধা করতে পারলো না। নেটওয়ার্কের অবস্থাও ভালো না। মীরাকে বলল
-তোমার ফোনের কি অবস্থা, দেখতো
মীরা ফোন বের করে দেখল যথারীতি ওর ফোনে কোন চার্জ নেই। আশিক মারুফকে ফোন করে দেখল ও বাসায় চলে গেছে। রাসেলকে আবার ফোন করে জানা গেল ও কাছাকাছিই আছে।
রাসেলের বাসা মোহাম্মদপুর, এই মুহূর্তে ধানমন্ডির একটা দোকানে অপেক্ষা করছে ও। ঝড় একটু কমলে বাসায় ফিরবে। আশিক জানতে চাইল
-তুই ফেরার পথে আমার এখান থেকে মীরাকে নিয়ে শ্যামলী পৌঁছে দিয়ে, বাড়ি যেতে পারবি?
– মীরা কোথা থেকে এলো?
– ওতো বিকাল থেকেই ছিল।
– বলিস কি?
তাহলে তো ভালোই টাইম কাটাইতেছো মামু। শেষের কথাটা আর আশিককে বলল না, বরং জানালো মিরাকে পিক করে নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেবে।
মীরা পুরোটাই শুনলো কিন্তু কিছু বলল না। এখন আসলে আর কোন অপশন নেই। আশিক চকিতে একবার মীরার দিকে তাকালো। ওর মুখ কালো হয়ে আছে। আশিক টের পায় রাসেলের সাথে ও ঠিক কমফোর্ট ফিল করে না। কিন্তু এখন বিপদ বলে কথা। আশেপাশে কোন রিক্সা দেখা যাচ্ছে না। হেঁটে বের হলে একেবারেই ভিজে যাবে।
ঝড় থামতে থামতে রাত সাড়ে দশটা বেজে গেল। রাসেল দোকান থেকে বের হয়ে একটা রিক্সা নিয়েছে। মেজাজ খারাপ লাগছে। রিক্সার প্লাস্টিকের পর্দায় ফুটা। ভিজে একসা হয়ে যাচ্ছে। রিক্সাওয়ালা কিছুতেই ৩২ নাম্বার যেতে চাইছে না। মোহাম্মদপুর যাওয়ার জন্য অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছে, এখন যদি আবার তাকে বলতে হয় শ্যামলী যেতে হবে এই ব্যাটা না আবার বেঁকে বসে। তবে মিরাকে হাতের নাগালে পাওয়া যাবে এটা বেশ হয়েছে। এত দেমাগ আজকে কোথায় যায় দেখবে। রিক্সা দাঁড় করিয়ে রেখে যখন সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠল ততক্ষণে সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ওর মনে হল আশিক নিজেও তো দিয়ে আসতে পারতো, ওকে এখানে আনবার কি দরকার ছিল? আশিক সব সময় ওর সঙ্গে এরকম করে। ওকে কি ভাবে? নিজের চামচা? শালার কপাল সবসময়ই ওর সঙ্গে থাকে। দুজনে একসঙ্গে পড়াশোনা করে তারপরেও শালার ফাস্ট ক্লাস ওই পায়, আর রাসেল কোনোমতে পাস করে যায়। শুধু তাই নয় সেকেন্ড ইয়ারে থাকতে টুম্পা নামের একটা মেয়েকে খুব মনে ধরেছিল। কেমন ছটফটে শালিক পাখির মতন। চোখে মুখে কথা বলে। রেশমাকে বলেছিল একটু সেট করে দিতে কিন্তু রেশমা এসে জানিয়েছে ওই মেয়ে নাকি আশিকের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। শালার আশিক ওই মেয়ের সঙ্গেও প্রেম করলো না। মাঝখান থেকে ওর জিনিসটা ঘেটে গেল। শুধু কি তাই? সেদিন তো কলারো চেপে ধরেছিল, ওই শালী মীরার জন্য। আজ শিক্ষা দেওয়ার একটা মোক্ষম সুযোগ পাওয়া গেছে। রাসেল দরজার হাতল ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, তারপর দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে নিচে নেমে রিক্সা করে বাড়ি চলে গেল। রিক্সায় উঠে ফোনটাও সুইচ অফ করে দিল।
মনে মনে বলল আমার কলারে হাত দিছিলি না, কালকে সকাল হইলে টের পাবি।
চলবে…….
“তোমাকে” যারা এখনো প্রি- অর্ডার করেননি, তারা ঝটপট করে ফেলুন।প্রি-অর্ডারের জন্য Bibliophile এ মেসেজ করুন।
এছাড়াও প্রি- অর্ডার করতে পারেন বইপরী-Book Angel এবং ক্ষণিকাতে