বইছে আবার চৈতি হাওয়া ৩০.

0
226

বইছে আবার চৈতি হাওয়া
৩০.

-তোমার কি ভয় করছে মীরা?

-ভয়? না ভয় করছে না। একা থাকলে হয়তো ভয় লাগতো।
আশিক একটু অবাক হলো। মেয়েটা কি বোকা, নাকি ওকে অতিরিক্ত বিশ্বাস করে?

রাত প্রায় এগারোটার উপর বাজে। রাসেলের সঙ্গে অনেকক্ষণ আগেই কথা হয়েছে, এতক্ষণে ওর চলে আসা উচিত ছিল। কি জানি কি হয়েছে? মীরা আরেকপ্রস্থ চা বানিয়ে এনেছে। টেবিলে রাখতে রাখতে বলল,
– আমি বোধহয় আপনাকে ঝামেলায় ফেলে দিলাম।
আশিক চায়ের কাপ টেনে নিল, তারপর আয়েশ করে চুমুক দিয়ে বলল,
– ঝামেলা তো আমার হযনি মীরা, ঝামেলায় তো তুমি পড়লে। আমি তো মজা করে চা খাচ্ছি।
– আপনি বাড়ি ফিরবেন না?
– না। মাঝে মাঝে বেশি রাত হয়ে গেলে আমি এখানেই থেকে যাই।
– এখানে?
– হ্যাঁ। ভেতরের রুমে একটা সোফা কাম বেড আছে। কদিন আগেই এনেছি। এখানে…

আশিক কথা শেষ করতে পারল না, তার আগেই বিকট শব্দ করে জেনারেটর বার্স্ট করে পুরো এলাকা অন্ধকারে ডুবে গেল। অন্ধকারের ঘনত্ব দেখে মনে হচ্ছে শুধু এই এলাকা না, আশেপাশের কোথায়ও আলোর কোন চিহ্ন নেই। মাঝে মাঝে শুধু বিদ্যুৎ চমকের ঝলকানিতে ঘরের মধ্যে এক চিলতে আরো ঝলকে উঠছে। গাঢ় অন্ধকারে মীরার অস্পষ্ট অবয়ব চোখে পড়ছে। এই রূপে মীরাকে দেখলে কেন যেন ভীষণ কাছের, ভীষণ আপন মনে হয়। এমনভাবেই ওকে প্রথমবার দেখেছিল আশিক। সেই থেকে মনের মধ্যে কেমন একটা অদ্ভুত যোগাযোগ তৈরি হয়ে গেছে ওর সঙ্গে। হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুতের ঝলকানির নীল আলো এসে পড়ছে ওর চুলের উপর। একবার ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করছে। আচ্ছা, মীরা যদি এখন ওর মনের কথা টের পেত, তাহলে নিশ্চয়ই ওর ভয় করতো। এরকম অন্ধকারে ওর সঙ্গে বসে থাকতে পারতো না।

মীরার জবাব শুনে আশিক অবাক হলো। মেয়েটা বোকা না ওকে অতিরিক্ত বিশ্বাস করে বোঝা যাচ্ছে না; তবে আশিক নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। ও একবার মনে মনে বলল আমাকে এত বিশ্বাস করোনা মীরা; আমি একটা রক্ত মাংসের মানুষ। আমার মধ্যেও অনেক কামনা বাসনা আছে। হয়তো আমার ভেতরেও কোথাও একটা পশু লুকিয়ে আছে।

আশিক আচমকা উঠে দাঁড়ালো। তারপর বলল,
– রাসেল মনে হয় আর আসতে পারবেনা। বৃষ্টি থেমে গেছে। চলো আমি তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
মীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এতক্ষণ ধরে ও মিথ্যা করেই বলছিল যে ওর ভয় করছে না। আসলে ওর ভীষণ ভয় করছিল। এখানে এইরকম অন্ধকারে আশিকের সঙ্গে বসে আছে এই জন্য নয়, বরং এই বৃষ্টি বাদলার মধ্যে ওকে রাসেলের সঙ্গে এতটা পথ যেতে হবে এই কথা ভেবে।

আশিক ভেতরের রুম থেকে টর্চ নিয়ে এলো। মীরা ঝটপট ওর জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল। দরজার লক খুলে আশিক হতভম্ব হয়ে গেল। দরজা আটকে গেছে, কিছুতেই খোলা যাচ্ছে না। এর আগে যখন দরজা খুলেছিল, প্রচন্ড হাওয়ায় দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে সময় হয়তো আটকে গেছে। পুরনো দিনের দরজা। এটা এখন কি করে খুলবে বুঝতে পারছে না। কয়েকবার হ্যাচকা টান মারলো, লাভ হলো না। এরকম হলে তো খুব ভয়ঙ্কর কাণ্ড হয়ে যাবে। মীরাকে পৌঁছে দেয়াটা জরুরী। আশিক রাসেলকে এর মধ্যে চার বার ফোন দিয়েছে। প্রথমবার ধরেনি, এরপর থেকে সুইচ অফ দেখাচ্ছে; হয়তো চার্জ শেষ হয়ে গেছে। রাত প্রায় পৌনে বারোটা বাজে। এর চেয়ে দেরি করাটা আর সমিচীন হবে না। মীরা এগিয়ে এসে বলল,
-কি হয়েছে?
আশিককে খুবই চিন্তিত দেখাচ্ছে। ও জবাব দিল না। আবার দরজা ধরে হ্যাচকা টান মারলো।
– দরজা আটকে গেছে আশিক ভাই?
– তাই তো মনে হচ্ছে। তুমি একবার চেষ্টা করে দেখো।
মীরার চেষ্টা করার খুব একটা আগ্রহ ছিলনা; আশিক যদি পারছে না তাহলে ও আর কি করবে। তবুও মীরা একবার দরজা ধরে টানলো। বোঝা যাচ্ছে খুব শক্ত হয়ে আটকে গেছে। আশিক চিন্তিত মুখে বলল,
– এটা তো ভালো হলো না।
পাশে তাকিয়ে মীরাকে আর দেখতে পেল না। মীরা আবার আগের চেয়ারে গিয়ে বসেছে। আশিক বাড়িতে ফোন করে ওর বাবাকে জানালো। আরিফ সাহেব জানালেন, হয়তো পুরনো দিনের দরজা বলে আটকে গেছে। চিন্তা না করতে। সকাল হলে দারোয়ানকে পাঠিয়ে দেবেন। বাইরে থেকে চেষ্টা করলেই খুলে যাবে। আশিক নিশ্চিন্ত হতে পারল না। চেষ্টা চালিয়েই যেতে লাগলো। আরো অনেকক্ষণ টানাটানি করে হতাশ হয়ে একবার মীরার দিকে তাকাল। মীরা বলল,
– বাদ দেন আশিক ভাই। আর তো কয়েক ঘন্টা। আপনি বসেন। আপনার চা তো ঠান্ডা হয়ে গেল। এখন আর গরম করাও যাবে না।

আশিক বসলো না, বিরস মুখে ভেতরের ঘরে চলে গেল। তারপর মোমবাতি এনে জ্বালিয়ে টেবিলে রাখল। চেয়ারে বসে একটা বই খুলল। যে ক ঘন্টা আছে, নিজের মনোযোগ একটু সরিয়ে রাখতে হবে।
মীরাকে বিশেষ একটা চিন্তিত দেখাচ্ছে না। কিছুক্ষণ আগে ভাঙা জানালা দিয়ে ঝড়ো বাতাস আসছিল বলে ওর শীত করছিল। বুঝতে পেরেই কিনা ও জানে না, আশিক ওকে একটা চাদর এনে দিয়েছে। এখন ও সেই চাদর গায়ে জড়িয়ে, আরাম করে পা তুলে চেয়ারে বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। যদিও চা ঠান্ডা হয়ে গেছে; একবার গরম করতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু এই অন্ধকারে চা গরম করা সম্ভব না। বিরক্ত লাগছে। সময় কাটছে না। সামনে তাকিয়ে দেখল আশিক বই পড়ছে। মীরা একটু আগ্রহ নিয়ে বলল,

-কি পড়ছেন আশিক ভাই?
– কবিতা।
– একটু জোরে পড়েন আমিও শুনি, তাহলে একটু সময় কাটবে।
আশিক আর উচ্চবাচ্য করল না। পড়া শুরু করল
প্রিয় আকাশি,
গতকাল ঠিক দুপুরে তোমার চিঠি পয়েছি। খামের উপর নাম ঠিকানা পড়েই চিনতে পেরেছি তোমার হাতের লেখা;
ঠিকানা পেলে কিভাবে লেখনি; কতদিন পর ঢাকার চিঠি;
তাও তোমার লেখা, ভাবতে পারো আমার অবস্থা??

গতকাল প্যারিসে ঝরেছিলো এ বছরের রেকর্ড ভাঙ্গা তুষারপাত।
তামাক ফুরিয়ে গেছে আনতে পারিনি; এই প্রথম আমি অনেকটা সময় নিয়ে ভুলেছিলাম তামাকের গন্ধ। তোমার চিঠিতে পরিবর্তন আর বদলে যাওয়ার সংবাদ; তুমি কষ্ট পেয়ে লিখেছো – রাত্রির ঢাকা এখন নিয়নের স্নিগধতা ছেড়ে নিয়েছে উতকট সোডিয়ামের সজ্জা,
আমাদের প্রিয় রমনা রেস্তোরা এখন কালের সাক্ষী,
শীতের বইমেলা পরিণত হয়েছে মিনাবাজারে,
টি এস সি’র চত্বরে যেন উপ্তপ্ত বৈরুত।
বদলে যাওয়া কষ্টের অপর নাম স্বৃতি এখন তাই নিয়ে বুঝি মেতে আছো;
এই পরবাসে আমার চোখের সামনেও
বদলে যেতে দেখলাম কত সুদুর ইতিহাস-
বালির বাধের মতন ভেসে গেল বার্লিন প্রাচীর …
ইংলিস চ্যানেলের তল দিয়ে হুইসেল বাজিয়ে চলছে ট্রেন;
ইউরোপের মানচিত্র এখন রুটি হয়ে গেছে,
ক্ষিদে পেলেই ছিড়ে ছিড়ে খাও,
স্বাধীনতা মানেই যেন উদর পুর্তি …
তুমি লিখেছ – “তোমাকে ভুলে গেছি কিনা?”
প্রিয় আকাশি,
আমি জেনে গেছি-
পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ ভুলে থাকা

আশিক একটু থামলো, তারপর মনে মনে বলল আসলেই সবচেয়ে কঠিন কাজ ভুলে থাকা। বিশেষত যাকে ভুলে থাকতে চায়, সে যদি এই ভাবে চোখের সামনে বসে থাকে। ও চোখ তুলে তাকালো এবং হেসে ফেলল। হাতের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে মীরা। কপাল বেয়ে চূর্ণ চূর্ণ চুলগুলো ঝুলে পড়েছে মুখের উপর। কি অদ্ভুত মায়াবী লাগছে ওকে। আশিক আনমনে বলল,

“তোমার শরীরে তুমি গেঁথে রাখো গান
রাত্রিকে করেছো তাই ঝঙ্কারমুখর
তোমার ও সান্নিধ্যের অপরূপ ঘ্রাণ
অজান্তে জীবনে রাখো জয়ের সাক্ষর।”

চলবে………

আজকে দুটি কবিতা ব্যবহার করা হয়েছে প্রথমটা “প্যারিসের চিঠি” লিখেছেন লতিফুল ইসলাম শিবলী
আর দ্বিতীয়টা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের “তুমি”।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here