বইছে আবার চৈতি হাওয়া ৩১.

0
219

বইছে আবার চৈতি হাওয়া
৩১.

প্রচন্ড জোরে দরজা ধাক্কানোর শব্দে মীরার ঘুম ভাঙলো। চোখ মেলে কিছুই বুঝতে পারল না ও । ঘাড় টনটন করছে, যতক্ষণে সম্বিত ফিরে পেল, তাকিয়ে দেখলো পাশের ঘর থেকে আশিক দৌড়ে এসে দরজা খুলছে।

সকাল সাড়ে ছটা বাজে। আশিক একটু অবাক হলো এই ভেবে যে, বাবা এত তাড়াতাড়ি লোক পাঠিয়ে দিয়েছে। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই হুড়মুড় করে কতগুলো লোক ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লো। মীরা ততক্ষণে ধাতস্থ হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে।
লোকগুলো ভেতরে ঢুকে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তারপর সামনের একজন মীরার দিকে আঙ্গুল তুলে বলল,
– এই যে দেখছেন, কইছিলাম না?
আশিক প্রথমে ভেবেছিল ওর বাড়ি থেকে কেউ এসেছে, দরজা খোলার জন্য। এতগুলো লোক একসঙ্গে দেখে ও একটু হকচকিয়ে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
-আপনারা কারা আর এখানে কি চান?
– মাইয়া লইয়া অফিসের নামে ফুর্তি করেন, আবার বড় বড় কথা কন?
– মানে?
সামনের নেতাগোছের লোকটা এবার বাকিদের উদ্দেশে বলল,
– দেখেন, আপনারা দেখেন কি হইতাছে। কিসের অফিস খুলছে বুঝতাছেন?
– এসব কি বলছেন আপনারা? আর আপনারা কারা?
লোকটা আশিকের কথাকে পাত্তা দিল না। পেছন ফিরে অন্যান্য লোকদের উদ্দেশ্যে বলল
-ভাই আপনারাই বলেন এটা ভদ্রলোকের পাড়া, এইখানে এইসব মা/গীবাজী আপনারা সহ্য করবেন?
– মুখ সামলে কথা বলেন। বেরিয়ে যান আমার অফিস থেকে।
-আরে রাখেন মিয়া। অফিসের নাম কইরা মাইয়া লইয়া ফুর্তি করেন, আবার বড় বড় কথা। ওই তোরা জিনিসপত্র ভাঙ্গা শুরু কর।

লোকগুলো মীরার দিকে এগুতে নিলে আশিক ওদের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো। এতক্ষণে ও নিজেকে সামলে নিয়েছে। এরকম একটা ঝামেলা হতে পারে এমন একটা আভাস আরিফ সাহেব দিয়েছিলেন। এই কারণেই আশিক মানা করা সত্ত্বেও উনি অফিসে সিসিটিভি ক্যামেরা বসিয়েছেন। ওনার ধারণা হয়েছিল আপাতত কোন ঝামেলা না হলেও আশিকের উপর ওরা শোধ তোলার চেষ্টা করবে।

মীরা প্রথমটাই কিছুই বুঝতে পারেনি, যখন বুঝতে পারল তখন লজ্জা ঘৃণার চাইতে ওর ভীষণ ভয় করতে লাগলো। নিজের চাইতেও বেশি ভয় করতে লাগলো আশিকের জন্য। ও জানে যতক্ষণ আশিক সামনে আছে, ওর কিছুই হবে না; কিন্তু এতগুলো লোক। ওরা যদি আশিককে কিছু করে ফেলে?

আশিক নিজেকে সামলে নিয়েছে। এই লোকগুলো নিশ্চয়ই প্ল্যান করেই এসেছে। এত সকালে ওদের এসব জানার কথা নয়। এই মুহূর্তে ওদের সঙ্গে লাগতে যাওয়াটা নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছু নয। তাছাড়া ও একা আর ওরা প্রায় আর আট দশজন। এখন কোন ঝামেলা হলে ও সামলাতে পারবে না। কাজেই মাথা ঠাণ্ডা রাখাটাই সমিচীন। আশিক ঠান্ডা গলায় বলল,
– দাঁড়ান। নিশ্চয়ই কোথাও কোন ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে।
-কিসের ভুল বোঝাবুঝি? ওই তরা শুরু কর।

আশিক পকেট থেকে ফোন বের করে ওর বাবাকে ফোন করল।
-এক মিনিট দাঁড়ান।
আরিফ সাহেব ফোন ধরে বললেন,
আশিক মোজাম্মেল রওনা হয়ে গেছে; কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাওয়ার কথা।
– বাবা এখানে একটা ঝামেলা হয়েছে। কিছু লোক এখানে এসে ঝামেলা করছে।
– তাই নাকি? দাড়াও আমি ল্যান্ড লাইন থেকে ফোন করছি। হাসান সাহেব ফোন কেটে দিলেন।
একটা চ্যাংড়া গোছের ছেলে ততক্ষণে সামনের কম্পিউটারটা তুলে আছাড় মারার জন্য হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে আরিফ সাহেবের ফোন এলো। আশিক ফোন ধরতেই তিনি বললেন,
– ফোনটা লাউড স্পিকারে দাও।
আশিক ফোন লাউড স্পিকারে দিল। আরিফ সাহেব বললেন,
-তোমরা দুজন ঠিক আছো?
– জি বাবা, কিন্তু মনে হচ্ছে এরা ঝামেলা করবে।
– সমস্যা নেই আমি ওদের দেখতে পাচ্ছি। মেক সিওর তোমরা যেন সেফ থাকো।
লোকগুলো একটু থমকালো, তবে তাদের বিশেষ একটা চিন্তিত মনে হল না। নেতাগোছের লোকটা বলল,
– কি হইল তোরা থাইমা গেলি কেন?
এবার আরিফ সাহেবের গুরু গম্ভীর গলা শোনা গেল। উনি বললেন,
– ওরা কি তোমাদের গায়ে হাত দিয়েছে?
– না এখনো দেয়নি।
– কোন প্রপার্টি ড্যামেজ করার চেষ্টা করছে?
– হ্যাঁ চেষ্টা করছে।
– ওদের বাধা দিও না। আমি কমিশনারকে ফোন করেছি। ইকবাল নামের একজন ইন্সপেক্টরকে আসতে বলা হয়েছে ;সঙ্গে ছ জন কনস্টেবল থাকবে। লাল শার্ট পরা যে ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে, ওর তো ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে। ভালোই হয়েছে, সেক্ষেত্রে কেস আরও মজবুত হবে। ওদেরকে তুলে নিয়ে একটু ডলা দিলেই সব বেরিয়ে আসবে।
– বাবা ওরাই অ্যালিগেশন আনছে যে..
– এখানে আলিগেশন আনার কিছু নেই, বরং ওরা অনধিকার প্রবেশ করেছে, কাজেই ওদের বিরুদ্ধে কেস হবে। ওরা কোন ড্যামেজ করতে চাইলে ওদেরকে বাধা দিও না। ভাঙচুর হলে কেস আরো মজবুত হবে। শুধু খেয়াল রাখো যেন তোমরা সেফ থাকো, তোমাদের কোন ক্ষতি না হয়।
চ্যাংড়া ছেলেটা হাত থেকে কম্পিউটার নামিয়ে রেখেছে। বাকি ছেলেগুলো মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। আরিফ সাহেব বললেন,

– পুলিশ কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাবে, ততক্ষণ এরা থাকলে ভালো, না থাকলেও সমস্যা নেই। ক্যামেরাতে সব রেকর্ড করা আছে, তবে ওরা যদি এখন ক্ষমা চেয়ে চলে যেতে চায় তাহলে আমরা কোন কেস করবো না। বাকিটা ওদের ইচ্ছা।

নেতাগুছের ছেলেটা পিছু হটে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো, তারপর মোবাইলে ফোনে গলা নামিয়ে বলল,
বস এইখানে তো গ্যান্জাম লেগে গেছে। জি? জি, জি আচ্ছা আমরা বাইর হইতাছি।
লোকটা ফিরে এসে বাকিদের উদ্দেশে বলল,
-ওই চল। অগো অফিসে এরা যা মন লয় তা করুক।

লোক গুলো বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় কিছু বলে গেল না। আশিক আস্তে আস্তে বলল,
-বাবা ওরা চলে গেছে।
-আমি দেখতে পাচ্ছি। আশিক আমি উবার পাঠাচ্ছি, তুমি মেয়েটাকে পৌঁছে দিয়ে এসো।

আশিকের ফোন বাজছে। সম্ভবত নিচ থেকে উবার ড্রাইভার ফোন দিচ্ছে। ও খুব নরম গলায় বলল,
-মীরা চলো।
মীরা আর কিছু বলল না, ব্যাগটা তুলে মাথা নিচু করে এগিয়ে গেল। পথে আর কোন কথা হলো না। আশিক শুধু একবার জিজ্ঞেস করেছিল,
-তুমি কোথায় যাবে?
-হলে।
পথে আশিক আর কোন কথা বলল না। লজ্জায়, অপমানে ওর মাথা হেট হয়ে আছে। ওর কারনে আজ মীরাকে এতটা অসম্মানিত হতে হয়েছে। হলের গেটে এসে আশিক শুধু আস্তে আস্তে বলল,
-এসে গেছে মীরা। তুমি নামতে পারো।

মীরা ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে গেল। ঘরে ঢুকে টের পেল ওর গায়ে এখনো আশিকের গেরুয়া চাদরটা জড়ানো। ফেরত দিতে ভুলে গেছে।

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here