বইছে আবার চৈতি হাওয়া ৩২.

0
312

বইছে আবার চৈতি হাওয়া

৩২.
কোথাও একটা একটানা, একঘেয়ে শব্দ হচ্ছে। পিন্-পিন্, পিন্-পিন্। আশিক কানের উপর বালিশ চাপা দিয়ে শব্দটা এড়ানোর চেষ্টা করে বার কয়েক। লাভ হয় না। বাধ্য হয়েই ফোনটা তুলে, কানে ঠেকিয়ে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে,
-হ্যালো।
অন্য পাশ থেকে একটি উদ্বিগ্ন কণ্ঠ শোনা যায়,
-কোথায় তুই?
– বাসায়।
– বাসায় কি করিস?
– ঘুমাই।
– এই অবস্থায় ঘুম হচ্ছে তোর?
– কেন কি হয়েছে?
– তুই ফেসবুক দেখিস নাই?
– না।
– দেখ তাড়াতাড়ি। মীরার কি অবস্থা কে জানে?
আশিক তড়াক করে উঠে বসল বিছানায়। তারপর বলল,
– কি হয়েছে মীরার?
– তুই আগে দেখ, তারপর ফোন দে।
মারুফ ফোন রেখে দিল। এক মুহূর্তে আশিকের সব ঘুম উবে গেছে। আশিক ফেসবুক খুলে হতভম্ব হয়ে গেল। সমস্ত ফেইসবুক, ইনস্টাগ্রাম, মেসেঞ্জার জুড়ে একই, সেই একই ঘটনা। বারংবার সবাই জানতে চাইছে, প্রশ্ন করছে, কৌতুক করছে। ভাষা ভিন্ন, শব্দচয়ন আলাদা, কিন্তু সারমর্ম একই। অল্প কথায় বললে তার মর্মার্থ হলো, মিরা দ্বিচারিণী। একজনের সঙ্গে ভালোবাসার অভিনয় করে অন্যজনের সঙ্গে রাত্রি যাপন করছে।

আশিক ভেবে কুল পাচ্ছে না। ওরই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে মীরাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় কতখানি হেনস্থা হতে হচ্ছে।

সেই ঘটনার পর দুদিন কেটে গেছে। সেদিন মীরাকে হলে পৌঁছে দিয়ে, ক্লান্ত ও বিদ্ধস্ত আশিক বাড়ি ফিরে এসেছিল। ভেবেছিল সারাদিন নিজেকে ঘরবন্দী করে রাখবে, কোথাও যাবে না কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। ফেরার পর আরিফ সাহেব জানিয়েছেন, পুলিশ ওর অফিস থেকে ঘুরে এসেছে, সেখান থেকে সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়ে গেছে। এখন ওদের সঙ্গে বসতে হবে। ও যেন ফ্রেশ হয়ে দ্রুত চেম্বারে চলে আসে। আশিক স্নান সেরে দ্রুত চেম্বারে চলে এলো। আরিফ সাহেব ছাড়াও সেখানে উপস্থিত ছিল ইন্সপেক্টর ইকবাল, কমিশনার রায়হান চৌধুরী। সমস্ত তথ্য সংগ্রহের পর ভিডিওগুলি বারংবার দেখা হল। কাজ গুছিয়ে ছাড়া পেতে পেতে দুপুর হয়ে গেল। সন্ধ্যাবেলায় তারা আবার এলেন, অনেকগুলো ছবি নিয়ে। আবারো মিটিংয়ে বসতে হলো। ভিডিওর সঙ্গে ছবিগুলো মিলিয়ে দেখা হল। গভীর রাত পর্যন্ত কাজ চলল। আশিক ঘরে ফিরতে পারল অনেক রাতে। মোবাইলে বন্ধুদের অজস্র মেসেজ পেল। দেখার সময় মিলল না। চোখ বন্ধ হয়ে এলো ঘুমে। শুধু রাসেলের মেসেজটাই যা একটু দেখতে পারলো। ও লিখেছে, ওর রিক্সা গর্তে পড়ে গেছিল। হাতে ব্যথা পেয়েছে। বাড়ি ফিরে যেতে হয়েছে বাধ্য হয়ে। মোবাইল ভেঙে গিয়েছিল সেজন্য কোন যোগাযোগ করতে পারেনি। ক্ষমা চেয়েছে বার বার। মারুফের একটা মিসকল দেখা গেল, কিন্তু রাত হয়ে গেছে ভেবে আর কল ব্যাক করল না আশিক। পরদিন ভোর হতে না হতেই ছুটতে হলো পুলিশ স্টেশনে। কতগুলো ছেলেকে তুলে আনা হয়েছে। তাদের আইডেন্টিফিকেশনের জন্য আশিককে দরকার। মারুফকে ফোন করে আনানো হলো। টিএসসির সেই ছেলেগুলোই ছিল কিনা সেটা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। মারুফ কিছু বলতে চেয়েছিল বারবার, কিন্তু সেখানে সেই মুহূর্তে সেটা সম্ভব ছিল না। সেদিনও ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গিয়েছিল। মারুফ বলে গিয়েছিল যে জরুরি কথা আছে ফোন করতে। সময় করে উঠতে পারেনি। আশিক ফেসবুকে ঢুকে মনে হল মারুফের কথাগুলো শোনা উচিত ছিল। একটার পর একটা ভুল হচ্ছে আর সেই সব ভুলের মাশুল দিতে হচ্ছে মীরাকে।

আশিক মারুফকে ফোন দিল। ধরল না ও। হয়তো ব্যস্ত আছে কিংবা ফোনের ধারে কাছে নেই; অথবা পথে আছে এমনও হতে পারে। মারুফ আর মীরা একই এলাকার। এটা আগে থেকেই জানত আশিক; যদিও ওরা পূর্বপরিচিত নয়, ডিপার্টমেন্টে এসেই পরিচয় হয়েছে। তবে দেখা গেছে মারুফ মীরার পরিবারকে বেশ ভালই চেনে। চেনাটা অবশ্য অস্বাভাবিক নয়; মীরার বড় চাচা এজাজুল ইসলাম মার্কেটে এক নামে পরিচিত। মার্কেটে ওদের তিনটা শাড়ির দোকান। একটা ভাড়ায় চলছে আর বাকি দুটোতে বাবা-ছেলে দুজন বসেন। সৎ ব্যবসায়ী হিসেবে এজাজ সাহেবের সুনাম আছে বাজারে। এ ছাড়াও উনি ভীষণ ধর্ম-প্রাণ মানুষ। ধর্ম সংক্রান্ত জ্ঞান তার অগাধ। পাড়ায় ধর্ম বিষয়ক কোন পরামর্শের প্রয়োজন পড়লে সকলেই তার শরণাপন্ন হয়। পাড়ায় সবাই তাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করে। এই সমস্ত খবর মারুফের কাছ থেকে জেনেছে আশিক। এখন এইরকম পরিস্থিতিতে সোশ্যাল মিডিয়ার এই খবরগুলো যদি উনার কানে পৌঁছায়, তাহলে তার ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য তা যথেষ্ট। সেটা হতে দেওয়া উচিত হবে না। এমনটা যেন না হয়, সেই চেষ্টা করতে হবে।

আশিকের মাথা কাজ করছে না। মারুফ ফোন ধরছে না। রাসেলের ফোন বন্ধ, সুমন ঢাকার বাইরে গেছে, রিপন অসুস্থ হয়ে কদিন ধরে পড়ে আছে। আর কার কাছ থেকে খবর জানতে পারবে? আশিক মীরাকে একবার ফোন দিল। ওর ফোনও বন্ধ দেখাচ্ছে। কি অবস্থায় আছে এখন কে জানে? সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে উঠে গেল আশিক। মাথা কাজ করছে না। কড়া করে এক কাপ কফি খেতে হবে, সেটাও করতে ইচ্ছা করছে না। আশিক হাত মুখ ধুয়ে নিচে গিয়ে রোজিনার কাছে কফি চাইল। ব্রেকফাস্ট টেবিলে দেয়া ছিল। খেতে ইচ্ছা করছে না। আশিক একটা স্যান্ডউইচ আর কফি নিয়ে উপরে চলে গেল। ফোন বাজছে, সম্ভবত মারুফ ফোন করেছে। আশিক ফোন ধরতেই চিন্তিত গলায় জানতে চাইল,
– ফেসবুকে দেখেছিস?
– হ্যাঁ দেখেছি। মীরার অবস্থা কি?
– তুই জানিস না কিছু?
– না।
– কাল ক্যাম্পাসে এসেছিল। ওকে বেশ হ্যারাসমেন্টের শিকার হতে হয়েছে।
– এখন কোথায় ও? ওর ফোন বন্ধ কেন? জানিস কিছু?
– ও চলে গেছে।
– কোথায় চলে গেছে? আশিক আৎকে উঠলো।
– বাড়ি চলে গেছে। ওকে নাকি বাড়ি থেকে জরুরী ভিত্তিতে ডাকা হয়েছে।
– কেন? জানিস কিছু?
মারুফ একটু ইতস্তত করে বলল জানি
-কি ব্যাপার বলতো?
– কালকে ওর বিয়ে।
-হোয়াট! কার সঙ্গে বিয়ে?
-ওর চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে।
-চাচাতো ভাই কোথা থেকে এলো? শুভ কি করছে? আর তাছাড়া তুই এতসব কি করে জানিস?
– ওর চাচাতো ভাই সৌরভকে আমি চিনি। জুনিয়র স্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়েছি। এরপরে বহু বছর যোগাযোগ ছিল না। গেল বছর বাড়ি যাবার পর আবার দেখা হয়েছে। আমার কাজিন রত্নার সঙ্গে ওর একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। যতদূর শুনেছিলাম ওদের বিয়ে হবে। এখন হঠাৎ করে এসব কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না।
– তুই কি শুভর সঙ্গে কথা বলেছিস?
– না আমি বলিনি তবে শুনেছি রাসেল বলেছে।
– কি বলেছে শুভ?
– এসব শোনার পর নাকি মীরার সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখতে চাইছে না।
– কি? হোয়াট ননসেন্স! আমি এখনই শুভর সঙ্গে কথা বলছি।
-কথা বলে মনে হয় লাভ হবে না।
– বলতে হবে মারুফ। সমস্যাগুলো হয়েছে আমার কারনে, কাজেই আমাকেই ফিক্স করতে হবে।

আশিক ভেবেছিল শুভর সঙ্গে কথা বলে অবাক হবে কিংবা হতাশ হবে, কিন্তু রীতিমতো ধাক্কা খেলো ও। ফোন ধরেই শুভ বাঁকা গলায় বলল
– এখন কি আবার তোকে দিয়ে ফোন করালো নাকি, ওকালতি করার জন্য।
– কেউ আমাকে দিয়ে ফোন করায়নি, আমি নিজে থেকেই ফোন করেছি। শুভ তোর সত্যটা জানা উচিত। যেটা হয়েছে, সেটা একটা এক্সিডেন্ট মাত্র। দুর্ঘটনাক্রমে মীরা আটকে গিয়েছিল আমার ওখানে। এর বেশি কিছুই না।
– তাই নাকি? তা দুদিন পর পর তোর ওখানে গেলে তো একনা একদিন আটকা পড়বেই। আমি ওকে মানা করেছিলাম যেতে। আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল, ও কি টাইপের মেয়ে।
– কি টাইপের মেয়ে মানে?
– এ ধরনের সস্তা টাইপের মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে যাওয়াই আমার উচিত হয়নি।আশিকের মাথাটা হুট করে গরম হয়ে গেল। শুভ হাতের কাছে থাকলে ওর টুটি চেপে ধরতো; কিন্তু সমস্যাটা ওর দিক থেকে হয়েছে, তাই মাথা ঠান্ডা রাখা ছাড়া কোন উপায় নেই। আশিক ঠান্ডা গলায় বলল,
– আমার সম্বন্ধে যা ইচ্ছা ভাব, ওকে অন্তত ভুল বুঝিস না। তুই তো ওকে ভালবাসিস।
– হ্যাঁ, আমি স্টুপিড, তাই ওকে ভালবাসতাম এখন আর বাসি না।
– এখন তুই রাগের মাথায় আছিস, তাই হয়তো এমন মনে হচ্ছে। এটা আমেরিকা না, একবার ওর বিয়ে হয়ে গেলে আর কিছু করতে পারবি না।
– ও বিয়ের খবরও তুই জেনে গেছিস দেখছি।
– শুভ, এখনো সময় আছে। তুই চাইলে বিয়েটা আটকাতে পারিস।
– কেন? আমি কেন বিয়ে আটকাতে যাব?
– তুই তো এমনি ওকে বিয়ে করতে চাইছিলি। এখন কি এমন হয়ে গেল? তুই চাইলে আমি তোকে সাহায্য করতে পারি।
– বাহ ফুর্তি করবি তুই, আর বিয়ে করে উদ্ধার করতে হবে আমাকে?
– শুভ, ভদ্রভাবে কথা বল। আমি তোকে আগেও বলেছি, এমন কিছুই হয়নি। তাছাড়া তুই তো ওর প্রতি কমিটেড ছিলি। আগেও ওকে বিয়ের কথা বলেছিলি।
– হ্যাঁ বলেছিলাম। তখন ও না করেছে। তখন তো আমি বুঝিনি যে এই কারণে না করছে।
এখন বুঝুক।
-দেখ আমি তোকে বলছি, যেটা হয়েছে সেটা একটা দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছু নয়। আমাদের মধ্যে কোন কিছুই নেই। এখন শুধু মাত্র একটা ভুল বোঝাবুঝির কারণে তুই ওকে বিয়ে করবি না? ওর লাইফটা নষ্ট হতে দিবি?
– তোর এত দরদ থাকলে তুই বিয়ে কর। নাকি তুই শুধু অন্যের প্রেমিকা নিয়ে ফুর্তি করতে পারিস, বিয়ের সময় আসলেই পিছিয়ে যাস।
– কি বলছিস ভেবে বলছিস?
– দেখ আশিক, তোদেরকে নিয়ে ভাবার মত সময় আমার নেই। তোরা যা ইচ্ছা তাই কর । তবে মীরার কোন কিছুতে আমি আর নেই। ওর মতো বাজে, সস্তা মেয়ের সঙ্গে আমি কোন সম্পর্ক রাখতে চাই না।

শুভ ঘটাং করে ফোনটা কেটে দিলো। আশিক ফোন হাতে কিছুক্ষণ ওই ভাবেই বসে রইল। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল।

আরিফ সাহেবের চেম্বারের দরজা বন্ধ, যার অর্থ ভিতরে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলছে। বাইরে একটা ছোট অফিস ঘরের মতন আছে। রফিক চাচা সেখানে বসেন। রফিক বিবিধ দায়িত্ব পালন করলেও কাগজে-কলমে সে আরিফ সাহেবের ম্যানেজার। আশিক কাছে এসে বলল,
-আমার একটু বাবার সঙ্গে কথা আছে।
– স্যারের মিটিং চলতেছে। ঘন্টা খানেক লাগবে আরো।
– আমার এখনই কথা বলতে হবে। আমি ভিতরে ঢুকছি।
রফিক বাধা দেয়ার সুযোগ পেল না, তার আগেই আশিক ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল। দরজার উল্টোদিকেই আরিফ সাহেব বসে আছেন, তার সামনে আরো চারজনকে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। আশিক তাদের মুখ দেখতে পাচ্ছেনা, তবে আরিফ সাহেবকে দেখে বোঝা যাচ্ছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চলছিল।
– আপনার সঙ্গে একটু জরুরী কথা আছে।
– আমি মিটিং শেষ করে তোমার সঙ্গে কথা বলছি।
– আমাকে এখনই বলতে হবে।
আরিফ সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, বলো।
– একটু বাইরে আসলে ভালো হয়।
এবার উনি যথেষ্টই বিরক্ত হলেন।
– যা বলার এখানেই বল।
– আমি বিয়ে করতে চাই।
ঘরে মৃদু হাসির গুঞ্জন শোনা গেল। আরিফ সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে বললেন।
– এক্সকিউজ মি জেন্টলম্যান, আমি এখনই আসছি।
বাইরে বেরিয়ে এসে উনি রুষ্ট গলায় বললেন,
– তুমি তো এমন ভাব করছো যেন বিয়ের লগ্ন পেরিয়ে যাচ্ছে। এই কথাটা মিটিং শেষ হওয়ার পরেও বলতে পারতে না?
– খানিকটা সেইরকমই। আমাদের এখনই রওনা দিতে হবে, তা নাহলে ওর অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে যাবে।
-কার?
– মীরার।
– মীরা মানে ওই মেয়েটা?
– জি।
– কিন্তু তুমি তো বলেছিলে………
– বাকি কথা যেতে যেতে বলি?
আরিফ সাহেব জবাব দিলেন না, বিরক্ত মুখে চেম্বারে ঢুকে গেলেন। মিনিট খানেকের মধ্যেই বেরিয়ে এসে বললেন,
– রফিক গাড়ির ব্যবস্থা কর। আমরা আধা ঘন্টার মধ্যেই বের হব।
চলবে………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here