বইছে আবার চৈতী হাওয়া ৬৪

0
309

বইছে আবার চৈতী হাওয়া
৬৪

আজ মীরার মনটা অসম্ভব ভালো। প্রথমত আজ আশিকের পরীক্ষা শেষ হচ্ছে তার উপর কাল রাতে ওরা সিলেট যাচ্ছে। কতদিন ধরে ওর স্বপ্ন ছিল। মীরা ওর ব্যগ বের করে গোছগাছ শুরু করে দিল। কোথাও যাওয়ার আগের প্রস্তুতি টুকুও বেড়ানোর আনন্দের একটা অংশ, অনেকেই সেটা বোঝে না।

যাবার আগে একটা কাজ শেষ করে যেতে হবে । শুভর চঠিটা টুম্পার কাছে পৌঁছে দিয়ে যেতে হবে। চিঠিটা শেষ করা হয়নি। আর লিখতে ইচ্ছা করছে না। যা হয়েছে তাই দিয়ে দেবে। এই ঝামেলা আর ভাল লাগছে না। কোথায় আশিকের সঙ্গে একটু মন খুলে কথা বলবে। সেটাই হচ্ছে না। ওর পরীক্ষার জন্য মীরা এতদিন অপেক্ষা করে ছিল। ডাক্তার বলেছে একটু রিস্ক আছে আপনি আপনার হাসবেন্ড এর সঙ্গে কথা বলুন। আমি দেশে ফিরলে দুজনে মিলে একসঙ্গে আসুন। এই ডাক্তার কে খুব ভাল লেগছে মীরার। বয়সে অনেক বড়, কিন্তু সবাইকে আপনি করে বলে। এমন কি বাচ্চাদেরকেও। তবে কথা বলে এক ধরনের নির্ভরতা জন্মায়। মীরা ঠিক করেছে আজ রাতেই আশিককে সব জানাবে।
আশিক ফিরল বিকেল নাগাদ। মীরা খাবার কথা জিজ্ঞেস করায় জানাল খাবে না। গোসল করে আবার বেরিয়ে গেল। মীরা জানতে চেয়েছিল কখন ফিরবে, জবাব দেয়নি অদ্ভুত ভাবে তাকিয়েছিল। মীরা সারা সন্ধ্যা অপেক্ষা করল। রাত বাড়তে লাগল কিন্তু আশিক ফিরল না।
বেশ রাত করে ফোনটা এল। মীরা নাম্বার বদলে ফেলেছে। এই নাম্বার সবাই জানেনা। এত রাতে কে ফোন করতে পারে? মীরা ফোন ধরার আগেই বন্ধ হয়ে গেল। চেক করে দেখল সুমনা। আবারো বাজছে। মীরা রিসিভ করে একটু অবাক হয়ে বলল
-কিরে কি হয়েছে?
-আপা, মায়ের শরীরটা ভাল নেই
মীরার বুকটা ধক করে উঠল। কদিন ধরে মার কথা খুব মনে পরছিল। ফোন করে কয়েকবার কথা ও বলেছে। রাতের দিকে বুকে ব্যথা হয়। মীরা বলেছিল ডাক্তার দেখাতে। মা আমলে নেয়নি, বলেছে আসিডিটি সেরে যাবে। আজ আবার কি হল। মীরা ভয়ে ভয়ে বলল
-কি হয়েছে রে?
-কদিন ধরে বুকের ব্যথাটা খুর বেড়েছে। একটু আগে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। জ্ঞান ফিরছিল না। আমরা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
-ডাক্তার দেখাস নি? আমাকে ফোন করলি না কেন?
-মা ই নিষেধ করেছিল অত রাতে ফোন করতে। আমি আর বড়চাচা ডাক্তারের কাছে নিতে চেয়েছিলাম, যেতে চায় না।
-মাকে ফোন দে তো আমি কথা বলি।
-এখন ঘুমাচ্ছে
-আচ্ছা আমি একটু পরে আবার ফোন দিচ্ছি।
মীরা ওর সবচাইতে ভরসার জায়গাটাতে গেল। আরিফ সাহেব জেগেই ছিলেন। সব শুনে গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন কাল সকালেই রওনা হয়ে যেতে। সিলেট কদিন পরে গেলেও ক্ষতি নেই। মীরার মনটা খচ খচ করছিল। ওর অস্বস্তি টের পেয়ে আরিফ সাহেব বললেন
-আশিক এখনো ফেরেনি?
-না বাবা
-ঠিক আছে আমি ওর সঙ্গে কথা বলব। কাল সকাল সকাল চলে যাও। এবার তুমি একাই ঘুরে এস। এখন আশিক গেলে তোমার বাড়ীতে সবাই মিছেমিছি ওকে নিয়ে ব্যস্ত হবে। আমি রফিককে বলে দিচ্ছি। গাড়ি দুদিন তোমার সাথেই রাখো। দরকার লাগতে পারে। যাও ঘুমিয়ে পড়। আমি আশিকের সঙ্গে ফোনে কথা বলছি।
আরিফ সাহেব ফোন করে ছেলেকে পেলেন না। ভাবলেন হয়ত পরীক্ষা শেষ তাই বন্ধুদের নিয়ে আছে।
আশিক ফিরল গভীর রাতে। ভেবেছিল মীরা নিশ্চই ঘুমিয়ে পরবে। মীরা বাতি নিভিয়ে শুয়ে ছিল। আশিক উল্টোদিকে মুখ করে শুয়ে পরল। মীরা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল। তবু ওর দিকে ফিরল না, একটা কথা ও বলল না। মীরার অস্থির লাগছে। ও এমন করছে কেন? ও কি চায় না মীরা এখন যায়? একবার সেটা বললেই পারে। ওর নিজের ও তো যেতে ইচ্ছা করছে না। শুধু মায়ের শরীর খারাপ বলেই না যাচ্ছে। চলেই তো আসবে কদিন পর। এইরকম করলে যেতে ইচ্ছা করে? ফেরার পর থেকে ঠিক মতো কথা ও বলছে না। এখনো অন্য দিকে ফিরে আছে। মীরা একটা হাত ওর পিঠে রেখে বলল
-আমার সঙ্গে কথা বলবেন না?
আশিক অন্য দিকে ফিরেই বলল
-কথা তো বলছি
-একবার আমার দিকে তাকাবেন ও না? আমি কাল চলে যাচ্ছি
আশিকের বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। মীরা এত স্বাভাবিক ভাবে বলছে কি করে? ওর কি একটু ও কষ্ট হচ্ছে না? মিরা এবার ওর কাধে হাত রাখল। তারপর বলল
-আমার দিকে ফিরুন।
আশিক অনিচ্ছা নিয়ে ফিরল। আবছা অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে মিরার চোখ চিকচিক করছে। মীরা ঠোট কামড়ে কোন মতে বলল
-আমি কি কোন ভুল করেছি?
-ভুল করবে কেন?
-আপনি কি চান না আমি যাই?
আশিক এবার একটু সহজ হল। মাথার হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল
-তুমি চাইছো তো, তাহলেই হবে
মীরার কান্না আরও বাড়লো। দুই হাতে ওকে আকড়ে ধরে বুকের মধ্যে মুখ গুজে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। আশিক খুব অসহায় বোধ করছে। মীরা কে সরিয়ে দিতে চাইছে, কিছুতেই পারছে না। মীরা কাদতে কাদতেই বলল
-আপনি না চাইলে আমি যাব না
আশিক নিজেকে শক্ত করলো। শেষ বেলায় এসে এভাবে দুর্বল হয়ে যাবার কোন মানে হয়েনা। বলল
-শান্ত হও মীরা।
-আপনি আসবেন তো আমার সঙ্গে দেখা করতে?
-আমি ?
আশিক ম্লান একটু হাসলো। জবাব দিল না। মীরা মুখ তুলে কিছুক্ষণ ওর মুখে জবাব খুজল তারপর এগিয়ে এসে ঠোটে ঠোট রাখল। গভীর চুমু খেল অনেকক্ষণ ধরে। আশিক চেষ্টা করেও শরীরের টান এড়িয়ে যেতে পারল না। মীরা কে কাছে টেনে নিল। ঠিক যখন মীরার মনে হতে শুরু করল আর ওদের মাঝে কোন আড়াল নেই আশিক কেমন যেন শীতল হয়ে গেল। ওর মনে হতে লাগল মীরা বোধ হয় ওকে করুণা করছে। শেষ বারের মতো দয়া দেখাচ্ছে। এক আকাশ বিস্ময় নিয়ে মীরা ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল
-কি হয়েছে?
ওর সেই টলটলে চোখ আর মায়াবী মুখের দিকে তাকিয়ে আশিক নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করল। মীরা ঘুমিয়ে পরার পরেও অনেক ক্ষণ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তার ও অনেক অনেক ক্ষণ পর যখন মীরা ঘুমে অচেতন, আশিক মুখ নামিয়ে ওর চুলের সুগন্ধ নিল। আজো সেইরকম আছে, সেই প্রথম দিনের মতই। ওর চুলের মধ্যে মুখ ডুবিয়েই আনমনে বলল
আমার চোখের মধ্যে যে রূপালি নিঝুম শহর আছে এক
তার অলৌকিক অলিগলি আর হৃদয়ের ধুলো ওড়া পথে
জেগে থাকে তার পদচিহ্ন প্রত্যাশার মতো, হয় না নিশ্চিহ্ন
ঝড় জলে। হাঁসময় সন্ধ্যার আকাশে কবিতার পঙক্তি দোলে,
না কি শাড়ি তার ওড়ে নক্ষত্রমালায়। প্রতীক্ষায় কখন যে
সন্ধ্যার আকাশ ফের ভোরের আকাশ হয়ে যায়, রিক্ত লাগে।

আজকের কবিতার নাম ভালো থেকো সুখে থেকো লিখেছেন শামসুর রহমান
চলবে…………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here