#বৃষ্টিস্নাত_ভোর
#পর্ব_০৬
#লেখনীতে_নুসরাত_তাবাস্সুম_মিথিলা
স্নিগ্ধ সকালের মিষ্টি রোদ এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে মেহুলের মুখমন্ডল। মেহুল চোখ মুখ কুঁচকে নিজের হাতের দ্বারা রোদ আটকানোর অহেতুক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নেহাল সবটা পর্যবেক্ষণ করে মিটিমিটি হাসছে। আসলে নেহালের ঘুম আরো ঘণ্টাখানেক আগে ভেঙেছে। উঠে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখল সে মেহুল এখনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তাই তার মাথায় একটু দুষ্টু বুদ্ধি চেপে যায়। মেহুলকে বিরক্ত করার লক্ষ্যে জানালার ধারে গিয়ে একবার পর্দা সরিয়ে দিচ্ছে আবার মেহুল নড়াচড়া করলেই পর্দা ঠিক করে রাখছে। মেহুলের ঘুমন্ত অঙ্গভঙ্গি দেখে নেহাল হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। হঠাৎ মেহুল চিৎকার করে বলল,
‘ আম্মু তোমার কী সমস্যা! আমি ঘুমাচ্ছি তো নাকি! যাও রান্না কর নাহলে মিহিরের ঘরে যাও। আমি একটু ঘুমাই…’ এই কথাটুকু বলেই আবারো ঘুমে তলিয়ে গেল সে।
নেহাল হতভম্ব হয়ে পুরো ঘটনা প্রত্যক্ষ করে সিদ্ধান্ত নিল এবার পানি এনে মেহুলের মুখে ছিটিয়ে দেবে। অতঃপর যা ভাবল তাই করে বসল নেহাল। মেহুল ধরফরিয়ে উঠে বসে কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই নেহাল তার ওষ্ঠযুগলের কোমল স্পর্শ মেহুলের কপালে বসিয়ে দিল। তারপর বলল,
‘ এই বউ তোমার ঘুমু ঘুমু কণ্ঠটা খুব মিষ্টি। মনে হচ্ছিল খেয়ে ফেলি। এখন এই অবস্থায় আমার সামনে বেশিক্ষণ থাকলে কিন্তু আমি কিছু একটা করে বসব। তাই তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নাও। সকাল ৭ টা বাজে। আম্মু আর নিশি তোমায় ডাকতে এসে পড়বে। নিশি কিন্তু ফাজিলের হাড্ডি। দেরি করলে কিন্তু বাড়িভর্তি মানুষের সামনে তোমায় লজ্জায় ফেলতে দু’বার ভাববে না। ‘
ঘুম থেকে উঠে মারাত্মক সব হাই ভোল্টেজের কথা, কাজ মেহুলের মস্তিষ্কে পৌঁছতে বেশ অনেকটা সময় নেয়। সে অবুঝ দৃষ্টিভঙ্গিমায় নেহালের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে নিজের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করছিল। তার বাসায় নেহাল কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তার স্মরণ হয় নেহাল তার স্বামী আর গতকাল তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। মেহুল দ্রুত কদমে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। তারপর নেহালের উদ্দেশ্যে রাগান্বিত স্বরে একটি বাক্য ছুড়ে দেয়,
‘ আপনি ভারী অসভ্য। আমায় চুমু খেলেন কেন? আর তুমি করে বলছেন কেন? ‘
‘ তোমার সাথে তো কিছুই করলাম না। তবুও অসভ্য বললে! চুমু খাওয়া আমার জন্মগত অধিকার। সেখানে তুমি আমার বিয়ে করা বউ। তাই তোমাকে আমি চুমু খেতেই পারি। আর তুমি করে না বললে আপনজন টাইপ ফিল আসে না তো। তাই আজ থেকে তুমি আমার শুধুই তুমি নো আপনি টাপনি। ‘ মুখে হাসির রেখা টেনে বলল নেহাল।
এসব উদ্ভট কথা শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল মেহুল। রাগে গজগজ করতে করতে ফ্রেশ হতে চলে গেল। আর নেহাল হাসতে হাসতে বিছানায় শুয়ে পড়ল। মেয়েটাকে রাগলে দারুণ লাগে! গাল টমেটোর মত রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। তবে অনেক হাসি-তামাশা, রসিকতা হয়েছে। এবার মিহিরের কেসটা নিয়ে কিছু স্টাডি করতে হবে। আর মেহুলকে নিজের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে জানাতে হবে। এই কেসটা এখন এক জটিল পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। দ্রুততম সময়ে একটা মারাত্মক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। তবে মিহিরকে নিয়ে নেহাল অনেকটা নিশ্চিন্ত হতে পেরেছে কারণ ওকে একজন যোগ্য জীবনসঙ্গী তথা রায়হানের হাতে তুলে দিতে পেরেছে। মেয়েটা হয়তো রায়হানের সংস্পর্শে তার যন্ত্রণাময়, কালো অতীতকে সাময়িক ভুলতে সমর্থ হবে। যদিও এ অতীত ভুলবার নয়! সারাজীবন কুড়ে খাবে, তাড়া করে বেড়াবে।
মেহুল গোসল সেরে ফ্রেশ হয়ে কিচেনে চলে গেল। সকাল সবে ৭.৩০টা। কিচেনে মিসেস রহমান ও নিশি রান্নাবান্না করছে। যেহেতু পরিবারের সদস্য সংখ্যা মাত্র চারজন তাই আয়োজনটাও মিসেস রহমান নিজেই করেছেন। নেহালের আদেশক্রমে খুব একটা আয়োজন করা হয়নি। খুবই ঘরোয়াভাবে সবটা সম্পন্ন হয়েছে। মেহুল নিজের উপস্থিতি জানান দিতে মিসেস রহমানের উদ্দেশ্যে, ” আসসালামুয়ালাইকুম ” বলল। মিসেস রহমান তড়িৎ গতিতে পেছন ফিরে মেহুলকে দেখে মুখে চওড়া হাসি ফুটিয়ে বললেন,
‘ ওয়ালাই কুমুস সালাম, আম্মু। কোনো দরকার মামণি? এত সকালে উঠেছো কেন? আর কিচেনেই বা কেন? নির্ঘাত নেহাল বদমাইশ পাঠিয়েছে! ‘
‘ আরে আম্মু একটা একটা করে বলেন। এতগুলো প্রশ্নের উত্তর দিতে তো সময় লাগবে। প্রথমত এখন মোটেও সকাল নেই। বেলা অনেকটা গড়িয়েছে। আর আমি থাকতে আপনি সবটা কেন একা হাতে করবেন? আর উনি আমায় কিছু বলেননি। আমি এমনিতেই কিচেনে এসেছি। ‘ একনাগাড়ে বলে থামল মেহুল।
‘ ওকে তাহলে এক কাজ কর আজকের চা তুমি করে ফেল। নেহালের মুখে তোমার হাতের চায়ের অনেক প্রশংসা শুনেছি। কি বলিস নিশি? ‘ মিসেস রহমান জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে নিশির দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করলেন।
‘ নাহ্ আম্মু। ভাবিপুর আজকে এ বাড়িতে প্রথম দিন। সব আমরাই করি আজ। ভাবিপু এই বাসার সাথে মানিয়ে গেলে না হয় টুকটাক কিছু করবে। তবে আজ নয়। ‘ আদেশের স্বরে মনোভাব ব্যক্ত করল নিশি।
‘ নিশির কথাই শেষ কথা। বুঝলে আম্মু। আজকে তুমি বিশ্রাম নাও। ‘ মিসেস রহমানের সরল উত্তর।
‘ আম্মু প্লিজ শুধু চা-টাই করি। প্লিজ। ‘ অসহায় মুখ ভঙ্গিমায় মেহুল।
‘ জি না ভাবিপু। সামনের রাস্তা খোলা আছে তুমি এখন আসতে পার। নাস্তা রেডি। খেয়ে রেস্ট করবে, বুঝলে? ‘ নিশি হাসতে হাসতে বলল।
‘ যথা আজ্ঞা ননদিনী। ‘ একরাশ হতাশা নিয়ে রান্নাঘর ছাড়ল মেহুল। মেহুল বের হতেই অট্টহাসিতে মেতে উঠে মিসেস রহমান ও নিশি। তারা তাদের লক্ষ্যে সফল বলে কথা! মেহুলকে তারা কোনো কাজ করতে দেয়নি। মেহুল তার মুখ গোমরা করে নিজের রুমে চলে যায়। নেহাল স্টাডি টেবিলে বসে কীসব যেন আঁকিবুঁকি করছে! ব্যপারটা বেশ রহস্যজনক ঠেকে মেহুলের কাছে। চুপিসারে গিয়ে সে নেহালের পেছনে দাঁড়ায়। নেহাল শব্দ করে বলে উঠল,
‘ উঁকি দিয়ে কী দেখছো গো? ‘
‘ কই উঁকি দিচ্ছি না তো? ‘ থতমত খেয়ে জবাব দেয় মেহুল।
‘ তোমার সতীন খুঁজছি গো। তুমি তো আর সময় দেবে না। তাই হিসেব কষছি কীভাবে কম সময়ে, সহজ উপায়ে দ্বিতীয় বিয়ে করা যায়। ‘ নেহাল মশকরা করে বললেও কথাটি সামান্য গাম্ভীর্যপূর্ণ ভাবে প্রকাশ করে।
‘ ওহ্ তাই! ‘ ক্ষীণ স্বরে বলল মেহুল। নেহালের মুখে আরেকটি বিয়ের কথা শুনে মেহুলের হৃদয়জুড়ে যেন দহন হচ্ছে। কেন এই অদ্ভূত অনুভূতির উৎপত্তি! শুধুই স্ত্রীর অধিকারবোধে নাকি অন্য কোনো কারণে। এসব ভাবতে ভাবতেই চোখের কোণা বেয়ে তপ্ত কয়েকফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল মেহুলের গালে। কিছুতেই বেহায়া চোখজোড়া যেন কান্না আটকাতে পারছে না। এই একটা কথায় কেমন বিষাক্ত তীর ছিল যে সরাসরি বুকের ভেতর গিয়ে ঝাঁঝড়া করে দিল। মেহুল চোখ লুকিয়ে দরজা খুলে বাইরে বের হতে যাবে তার পূর্বেই নেহালের হেঁচকা টানে তার বুকে গিয়ে আছড়ে পরল। নেহাল মেহুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই মেহুল অঝোর ধারায় অশ্রুবর্ষণ শুরু করে। নেহাল হেসে বলে,
‘ পাগলি আমার! আমি তো আমার প্রোজেক্ট রেডি করছিলাম। একটু দুষ্টুমি করে বলেছিলাম। তোমার কষ্ট হয়েছে বুঝি! স্যরি আর হবে না। ‘
‘ আপনি খুব পচা। আমাকে কতটা কষ্ট দিয়েছেন জানেন? ‘ অভিমানের স্বরে মেহুল।
‘ তা তোমার কেন কষ্ট হলো? মাত্র কিছুদিনের পরিচয়ে কোনো মানুষের কথায় এতটা কষ্ট পেলে? ‘ জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে নেহাল।
‘ জানিনা তবে অনেক কষ্ট হয়েছে। ‘ লাজুক হেসে মেহুল।
‘ প্রেম প্রেম গন্ধ পাচ্ছি! প্রেমে পরলে নাকি? ‘
‘ ধ্যাৎ। ‘ ধাক্কা দিয়ে নেহালের বুক থেকে সরে এলো মেহুল। সে নিজেও জানে না তার এই অদ্ভূত অনুভূতিপ্রবণতার কারণ। তবে নেহালের প্রতি যে সে বেশ দুর্বল তা হারে হারে বুঝতে পারছে সে। নেহালের সংস্পর্শে থাকতে বেশ লাগছে তার। মাত্র একদিনের মাঝেই এমন অনুভব! কী কাকতলীয় তাই না! নেহাল বলল,
‘ মেহুল তোমার সাথে মিহিরের কেসটার ব্যপারে কিছু কথা আছে। ‘
‘ বলুন। ‘ উদ্বিগ্ন স্বরে মেহুল।
‘ আসলে আসামিপক্ষ বেশ ক্ষমতাশালী। গতানুগতিক ধারায় আমরা হয়তো সঠিক বিচার পাব না। আমাদের কিছু কৌশল অবলম্বন করে সামনে পদক্ষেপ ফেলতে হবে। ‘
‘ আচ্ছা নেহাল সেদিন আপনি আমার সাথে কেন দেখা করলেন না! আমাদের তো এই বিষয়ে আলোচনার কথা ছিল। ‘
‘ সব বলব কিন্তু…..’ কথা শেষ করার পূর্বেই মিসেস রহমান মেহুল আর নেহালকে ডেকে পাঠালেন। অগত্যা কথা অপূর্ণ রেখেই তাদেরকে কক্ষ প্রস্থান করতে হলো।
__________
#চলবে_ইনশাআল্লাহ…
#NUSRAT_TABASSUM_METHILA
[ রিচেক হয়নি। ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]