#বৃষ্টিস্নাত_ভোর
#পর্ব_০৭
#লেখনীতে_নুসরাত_তাবাস্সুম_মিথিলা
নাস্তার টেবিলে বসতেই নেহালের জরুরি কল আসে। ফলশ্রুতিতে আধ খাওয়া পরোটা আর তরকারির বাটি রেখেই এক প্রকার তাড়া দেখিয়ে বেরিয়ে পড়ে নেহাল। মিসেস রহমান এর ফলে অত্যন্ত মনোঃক্ষুণ্ন হন। তিনি রাগ করে খাবার না খেয়েই উঠে পড়েন। তার মতে,
‘ চাকরি করবি ভালো কথা তা খাবার খেতে সমস্যা কোথায়? আর কেউ বুঝি চাকরি করে না। সামান্য এটুকু খেতে কতটা সময়েরই বা প্রয়োজন হতো! ‘
নিশি আর মেহুল দর্শক হিসেবে রয়ে গেল টেবিলে। নিশি নিজের খাবার শেষ করে মেহুলকে তাড়া দিতে লাগল। মেহুল খাবার পরে খাবে বলে নিজের ঘরে চলে এল।
নেহালের অসম্পূর্ণ কথাটা কী হতে পারে? এই নিয়ে নানান ভাবনা ইতোমধ্যে ভাবা শেষ তার। তার ধারণা তার বাবা আর নেহাল সবটা জানে এবং তা কোনো এক অজানা আতঙ্কে আড়াল করে চলেছে। মিহিরকে খুব মনে পড়ছে তার। তাই সিদ্ধান্ত নিল মিহিরকে একটা কল করবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। মিহিরের ফোনে ট্রাই করল মেহুল। দু’বার রিং হতেই কল রিসিভ হলো,
‘ এতক্ষণে আমায় মনে পরল তোর আপাই? ‘ অভিমানভরা কণ্ঠে মিহির।
‘ তোর কী আমার কথা মনে পরেনি একবারও? একটা কল না দিলি মিসড কল তো দিতে পারতি বা মেসেজ। আবার কল দিলাম বলে আমাকেই কথা শুনাচ্ছিস? ‘ মিহিরের প্রশ্নের প্রতিত্তরে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে নিজের দায় সাড়লো মেহুল। যদিও তার কণ্ঠেও অভিমানের উপস্থিতি ছিল প্রখরভাবে।
‘ হুম হয়েছে। মান অভিমানের পালা থামিয়ে বল কেমন আছিস? ‘
‘ আমি থামাবো কেন? আমি শুরু করেছিলাম? ‘ রাগান্বিত কণ্ঠে মেহুল।
‘ স্যরি আপাই। ভুল আমার হয়েছে। ‘
‘ দ্যাটস লাইক অ্যা গুড গার্ল। ‘ মুখে বিজয়ী হাসি ফুটিয়ে মেহুল।
‘ এখন বল কেমন আছিস? ‘ মৃদু হেসে বলল মিহির।
‘ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি, তুই? ‘
‘ আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু তোর জন্য আর বাবা – মায়ের জন্য খালি মনটা যেন কেমন কেমন করছে। ‘
‘ আমারও একই অবস্থা। আচ্ছা মিহির রায়হান মানুষ হিসেবে কেমন? আমার তো ওনার সাথে তেমন একটা কথা হয়নি বা পরিচয়ও নেই। ‘ জিজ্ঞাসু ভঙ্গিমায় বলল মেহুল।
‘ আপাই বিশ্বাস কর, ওনার মত মানুষ দুটো হয় না। কাল সারারাত ওনার সাথে আমি গল্প করে কাটিয়েছি। একবারের জন্যেও ওনাকে বাইরের কেউ বলে মনেই হয়নি। যেন উনি আমার কত বছরের চেনা! আমার আপনজন। এমন টাইপ একটা ফিলিং। আচ্ছা আমি তো রায়হানকে নিয়ে অনেক কিছু বললাম। এবার নেহাল ভাইকে নিয়ে কিছু বল। যদিও উনি অনেক ভালো। ‘ মিহির আগ্রহদীপ্ত হয়ে বলল।
‘ ওহ্ আচ্ছা। আমি কিছু জানি না ওনার সম্পর্কে। ‘ লাজুক ভঙ্গিতে বলল মেহুল।
‘ এই আপাই এটা কিন্তু চিটিং। আমি ছোট হয়েও তোর সাথে আমার হাজব্যান্ডকে নিয়ে আমার মনোভাব প্রকাশ করলাম। আর তুই! লজ্জায় লাল, নীল, বেগুনি হয়ে যাচ্ছিস। লজ্জা তো আমার পাওয়ার কথা ছিল। ‘ উচ্চস্বরেই কথাগুলো বলল মিহির।
‘ আমি না জানলে কী বলব বল তো? আচ্ছা তোর শ্বশুরবাড়িতে কে কে আছেন? ‘
‘ টপিক পাল্টে দিলি কিন্তু! রায়হানের বাবা আর ওনার বড় ভাইয়ের পরিবার। মা আজ থেকে প্রায় বছরখানেক আগে করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। জানিস আপাই কালকে উনি ওনার মায়ের কথা স্মরণ করে অনেকক্ষণ কেঁদেছেন। আমার খুব কষ্ট হয়েছে। ‘ মন খারাপের সুরে বলল মিহির।
‘ ওও। মন খারাপ করিস না। হায়াত তো আর মানুষের হাতে না। তুই ওনার জন্য দোয়া করিস পারলে। আর ওই বাড়ির ছোট কর্তৃ তুই। সবসময় বড় জা’য়ের কথা মেনে চলবি। আমার জায়গাটা ওনাকে দিবি। অর্থাৎ তোকে ওই পরিবারের সাথে মানিয়ে নিতে হবে। কাল ইনশাআল্লাহ দেখা হচ্ছে। তোকে আরও অনেক কিছু বলার আছে। আমি রাখছি। আম্মুকে কল দেব। তুইও সময় করে কথা বলে নিস। ‘
‘ আচ্ছা আপাই। আল্লাহ হাফেজ। ‘
মিহিরের সাথে দীর্ঘ আলাপন শেষে মেহুল তার মাকে ফোন দিয়ে কুশল বিনিময় করে নিল। ইতস্তত বোধের কারণে বাবার কথা আর জিজ্ঞাসা করে ওঠা হয়নি। তবে মনে মনে মেহুলের বড্ড অভিমান হলো।
‘ মেয়ে হয়ে বাবাকে ভুল বুঝে সে না হয় একটা অন্যায় করেই ফেলেছে তাই বলে বাবা হয়ে মেয়ের সাথে একটা বাক্য বিনিময় করা যেত না! একটা কথা বাবা বললে মেয়ের কী আর কোনো অভিমান থাকতে পারে? ‘ মনে মনে এই কথাগুলো ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মেহুল। যেই বাবার সাথে একবেলা কথা না বলে মেহুল থাকতে পারত না অথচ সেই বাবার সাথেই তুচ্ছ এক ভুল বোঝাবুঝির জেরে দু’দিন যাবৎ কোনো কথা নেই! ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! মেহুলের চোখের কোণা গড়িয়ে মনের অজান্তেই অঝোর ধারায় অশ্রু বর্ষণ শুরু হলো। খানিকটা সময় গুণগুণিয়ে কাঁদার পর মেহুল হাতের উল্টো পিঠের দ্বারা চোখ মুছে নিয়ে নিজের কান্ডে নিজেই বিরক্ত হলো। এত কাঁদার কী আছে? এত দুর্বলচিত্ত নিয়ে কী নিষ্ঠুর পৃথিবীতে টিকে থাকা যাবে? বাবারা কখনোই সন্তানকে দূরে ঠেলে দিতে পারে না। সাময়িক এই ভুল বোঝাবুঝির অবসান দ্রুতই ঘটবে বলে আশা করা যায়।
– “দয়াময় আল্লাহর কাছে মন থেকে কিছু চাইলে তিনি কখনোই তা ফিরিয়ে দেননা।” এই শক্তিশালী মন্ত্রকে স্মরণ করে মেহুল নতুন উদ্যমে শক্তি সঞ্চার করল। তার বিশ্বাস খুব শীঘ্রই তার বাবার সাথে সব ঝামেলার মিটমাট হবে। তাই মেহুল নিজের দ্বিতীয় মা তথা শাশুড়ির কক্ষের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। নতুন বউ হয়ে যদি সারাদিন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে ব্যপারটা বড়ই দৃষ্টিকটু। তার উপরে নেহালের ওপর অভিমান করে তিনি না খেয়ে আছেন। নেহালের যোগ্য স্ত্রী হিসেবে তার মায়ের মান ভাঙানো মেহুলের একান্ত কর্তব্যের মাঝেই পড়ে। মেহুল এক কাপ চা আর সকালে তৈরি করা নাস্তা পুনরায় গরম করে ট্রে সাজিয়ে মিসেস রহমানের ঘরে গেল। ইতোমধ্যে নিশি কলেজে চলে গেছে। নিশি মিহিরের সমবয়সী। ঘরে উঁকি দিয়ে মেহুল প্রত্যক্ষ করল, মিসেস রহমান জানালার ধারে বসে অন্যমনস্ক হয়ে রয়েছেন। মেহুল মিসেস রহমানের দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে গলা ঝেড়ে নিল। মিসেস রহমান দৃষ্টি ফিরিয়ে দরজায় তাকিয়ে মেহুলকে দেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন,
‘ কী হয়েছে আম্মু? বাইরে দাঁড়িয়ে কেন ভেতরে এসো। ‘
‘ জি আম্মু আসছি। আসলে…’ কথা শেষ করতে পারল না মেহুল তার পূর্বেই মিসেস রহমান বললেন,
‘ বাসার কথা মনে পড়ছে বুঝি? ‘
‘ তা তো একটু পড়ছিল তবে আপনার সাথে সময় কাটালে বাসার কথা মনে আসে না অতটা। তাই তো চলে এসেছি। আম্মু আমার না একটা রিকুয়েস্ট আছে আপনি কিন্তু কিছুতেই না করতে পারবেন না। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ। ‘
‘ আরে হয়েছে তো। আচ্ছা না করব না। বলো কী রিকুয়েস্ট? ‘
‘ এগুলো আপনাকে শেষ করতে হবে। না হলে আমি কিন্তু আপনার সাথে কথা বলব না। আর চা খেয়ে বলেন তো কেমন হয়েছে? ‘ চোখে মুখে খুশির ঝলক মেহুলের।
‘ আচ্ছা। তবে আমার একটা শর্ত আছে। আমাকে তুমি করে বলতে হবে আর আমি তোকে তুই করে ডাকব। রাজি হলে বল তাহলে আমি খাব নয়তো না। ‘
‘ আরে এটা কোনো শর্ত হলো! আম্মু আমি রাজি। তুমি প্রথমে খেয়ে নাও। আর চায়ের রিভিউ দেবে কিন্তু। কোনো সমস্যা থাকলে ঠিক করে নেব। ‘
এভাবে কথায় কথায় বৌমা আর শাশুড়ির খুনসুটি চলতেই থাকে। ফলে তাদের মাঝের জড়তা অনেকটাই কমে যায়। মেহুলের মন খারাপ একদম নিঃশেষ হয়ে যায় মাতৃতুল্য এই মানুষটার ভালোবাসায়। মেহুল আর মিসেস রহমান মিলে দুপুরের রান্না সেরে ফেলেন। আর নিশি কলেজ থেকে ফিরে ভাবি আর মায়ের এই মিষ্টি সম্পর্ক দেখে খুশিতে লাফিয়ে ওঠে। সে সবসময় এমন একটা পরিবারের স্বপ্ন দেখেছে। যেখানে কোনো দুঃসম্পর্কের ছাপ থাকবে নাহ্।
__________
#চলবে_ইনশাআল্লাহ…
#NUSRAT_TABASSUM_METHILA
[ রিচেক হয়নি। ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]