#বৃষ্টিস্নাত_ভোর
#পর্ব_০৮
#লেখনীতে_নুসরাত_তাবাস্সুম_মিথিলা
‘ তোমার আব্বু জুয়ার নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন। ‘ নেহাল শান্ত ভঙ্গিমায় এই ভয়ানক কথাটি বলল।
‘ মানে? ‘ উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল মেহুল।
‘ তুমি সবটা শান্ত হয়ে শুনবে বলেছিলে। কিন্তু এভাবে উত্তেজিত হয়ে পড়লে আমি কিছুই বলতে পারব না। ‘ রাগান্বিত হয়ে বলল নেহাল।
‘ আচ্ছা আমি শান্ত থাকব। প্লিজ আপনি রাগ করবেন না। ‘ অনুরোধের স্বরে আকুতি করল মেহুল।
এরপর নেহাল বলতে শুরু করল জিয়া সাহেবের ভয়ানক অতীত সম্পর্কে। যা যেকোন মানুষের হৃদয়কে শিহরিত করতে সমর্থ। মেহুল পূর্ণ মনোযোগের সাথে নেহালের প্রতিটি কথা শুনতে শুরু করলো। উত্তেজনায় তার হৃদকম্পন শতগুণে বেড়ে গেল।
___________
দেড় বছর পূর্বে,
যখন পরিবারের ব্যয়ভার বহন করতে জিয়া সাহেব হিমশিম খাচ্ছিলেন ঠিক তখনই এলাকার এক ভাইয়ের মাধ্যমে তার পরিচয় ঘটে সাহেদ মিয়ার সাথে। যার কারবার হচ্ছে সুদ ও জুয়ার ব্যবসা। তার সাথে আলাপচারিতার মাধ্যমে মেহুলের ভর্তি খরচবাবদ প্রথম দফায় ৩৫হাজার টাকা চড়া সুদে ঋণ নেন জিয়া সাহেব। সেই থেকেই তার জীবনে অন্ধকারের সূচনা। সেইদিন সাহেদ মিয়া জিয়া সাহেবের নিকট এক লোভনীয় প্রস্তাব পেশ করেন। কথোপকথন ছিল এমন যে,
‘ আইজকা আমার মনডা বহুত ভালা আছে। আপনারে একখান প্ররসতাব দেই কী কন? ‘ বিদঘুটে হাসি হেসে বললেন সাহেদ মিয়া।
‘ কী প্রস্তাব? ‘ কিঞ্চিৎ সাহস সঞ্চার করে বললেন জিয়া সাহেব। কেননা এ যে ভুতের মুখে রাম রাম জাতীয় কথা।
‘ আপনে আহেন আমার লগে। আপনেরে দেহায়া আনি। ‘ হাসির পুনরাবৃত্তি।
জিয়া সাহেব সরল মনেই সাহেদ মিয়ার দেখানো পথ অনুসরণ করতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার পূর্বেই হাবিব সাহেব জিয়া সাহেবের হাত আঁকড়ে ধরলেন। ফিসফিসিয়ে বললেন,
‘ ভাই এখানে থাকার আর দরকার নাই আপনি ফিরে চলেন। ‘
কথাটা খুব ক্ষীণ আওয়াজে বললেও সাহেদ মিয়ার কর্ণগোচর হয়ে যায়। জিয়া সাহেব প্রতিত্তর করার পূর্বেই রাগত স্বরে বললেন,
‘ আহা মিয়া উনি যহন যাইবার চাইতাছে তহন আপনি বাধা দিতাছেন কিল্লাইগা? আমার কামে বাধা দিলে তার জীবন কইলাম আমি ছাড়খাড় কইরা দেই। ‘
হাবিব সাহেব ভয়ে চুপসে গেলেন। টু শব্দ করার সাহস অবধি হলো না তার। জিয়া সাহেব হতভম্বের মত একবার সাহেদ মিয়ার মুখপানে তো আরেকবার হাবিব মিয়ার মুখপানে চাইতে লাগলেন। তার কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না সাহেদ মিয়ার এহেন রেগে যাওয়ার কারণ কী? হাবিব সাহেব কী এমন অপরাধ করে ফেলেছেন যে মারাত্মক হুমকি প্রদান করা হলো তাকে? সে যাই হোক না কেন এখানে এত কথা বলা বা ভাবা যাবে নতুবা…
আর কিছু ভাববার ফুরসত পেলেন না জিয়া সাহেব। তার পূর্বেই সাহেদ মিয়া তাড়া দেখিয়ে ডাক লাগালেন,
‘ আরে মিয়া এত কী ভাবতাছেন? আহেন আমার লগে। ‘
‘ জি চলুন। ‘ মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন জিয়া সাহেব।
তারপর সাহেদ মিয়ার দেখানো পথ অনুসরণ করে একটি বিশাল কক্ষে উপস্থিত হলেন হাবিব সাহেব ও জিয়া সাহেব। যেখানে সবাই জুয়ার নেশায় বুদ হয়ে আছে। কক্ষজুড়ে বেঞ্চ সাজিয়ে রাখা। সেই বেঞ্চে নানা বয়সী লোকের সমারোহ। যারা তাসের রাজত্বে রাজা। চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল জিয়া সাহেব। তার এই পরিবেশটা বেশ পছন্দ হয়েছে কেননা একসময় তিনি ছিলেন পাক্কা জুয়ারী। কিন্তু কালের পরিক্রমায় মেহুলের জন্মের পরে এই নেশা থেকে সে বেরিয়ে আসে। বহু বছর পর সেই পুরনো আমেজকে দেখে অতীতের স্মৃতিরা এসে হাতছানি দিল জিয়া সাহেবকে। জিয়া সাহেবের চোখ দেখেই যা বোঝার বুঝে নিলেন সাহেদ মিয়া। চট করে তিনি বলে বসলেন,
‘ এই হইতাছে গিয়া আমার রাজ্য। এইহানে আপনারে স্বাগতম। এহন আমার প্ররসতাব হইলো গিয়া আজকের লাইগা আপনেরে ফ্রি তাস খেলবার দিমু। আইজকা হারলেও আপনের লাইগা মাফ আর জিতলে সব আপনার। এমন সুযোগ কিন্তু জীবনে একবারই আসে। ‘
‘ আমি শুধু একবার খেলতে চাই। আর খেলব না। শুধু আজকের জন্য খেলতে পারব? ‘ এহেন লোভনীয় প্রস্তাবকে নাকচ করার সাধ্য জিয়া সাহেবের হলো না। তার ওপর আবার এত বছর পূর্বের ভালোবাসার সন্ধানে নিষিদ্ধ কার্যকলাপে অনায়াসে মনের সায় পেয়ে গেলেন।
‘ অবশ্যই। তবে আপনেরে দেইখা আমার মনে হইতেছে আপনি ভাই শেয়ান মাল। আপনার জন্মই হইছে জেতার লাইগা। আপনে কখনো হারতেই পারেন না। তাইলে ওইখানে বইসা পড়েন। এই যে মিয়ারা এই হলেন আমাগো নিউ মেম্বার। আজকে প্রথম খেলবার আইছে। সব নিয়মকানুন বুঝায় দিয়া খেলতে শুরু কইরা দেন। ‘ চোখে মুখে খুশির ঝলক যেন উপচে পরছে তার। কাঙ্ক্ষিত শিকার যেন নিজে থেকে এসে জালে ধরা দিয়েছে।
সেই থেকে জিয়া সাহেবের জুয়ার জগতে পুনরায় প্রবেশ। প্রথম ছ’মাস কোনো ভাবেই খেলাতে তার পরাজয় হয়নি। যেহেতু তার পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে এই খেলা সম্পর্কে সেহেতু তার ছিল প্রবল আত্মবিশ্বাস। কিন্তু এসবই ছিল সাহেদ মিয়া ও তার চক্রের সুকৌশল। জিয়া সাহেবকে ইচ্ছাকৃত ভাবে জিতিয়ে দেয়ার মাধ্যমে জুয়ার জগতে তাকে সম্পূর্ণরূপে বুদ করার একটি কৌশল মাত্র। ছ’মাসের মধ্যেই জিয়া সাহেব আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যান। ছোটখাট বিত্তশালীদের কাতারে তার নামটি ফেলার মতো অর্থ তিনি আয় করেন জুয়া খেলে। তা কম করে হলেও দশ থেকে বারো লক্ষ টাকা। আসলে অর্থের নেশা এমন এক নেশা যা মানুষকে অপরাধী হয়ে উঠতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উপায়ে সহায়তা করে। জিয়া সাহেবের ক্ষেত্রেও ঘটল তাই তবে তার উপার্জিত টাকার বেশিরভাগ অংশই তার জুয়ার পেছনে খরচ করার কাজে বরাদ্দ ছিল। এরপর হঠাৎ ছ’মাস পেরোনোর পর জিয়া সাহেব ক্রমগত হেরে যাওয়া শুরু করলেন। হোক তা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত উপায়ে। শেষে এমন পরিণতি ঘটল যে- দীর্ঘ ছ’মাসে উপার্জিত অর্থ এক সপ্তাহের মাথায় খুঁইয়ে বসলেন তিনি। তাই সাহেদ মিয়ার সরণাপন্ন হতে হলো তাকে। সাড়ে চারলাখ টাকা চড়া সুদে ঋণ করে ফেললেন তিনি। কিন্তু একসময় নিজের ভুল বুঝতে সমর্থ হলেন তিনি যখন আর ফিরে আসার কোনো পথ খোলা ছিল না। সবশেষে জিয়া সাহেব দেউলিয়া হয়ে যান। তার উপর সুদের টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য অব্যাহত চাপ সবটা মিলিয়ে তিনি আত্মহননের পথ বেছে নেন। তবে ভাগ্যের জোরে সে যাত্রায় তিনি ব্যর্থ হন। আর সেই জুয়ারী টাকার পরিবর্তে মেহুলকে একরাতের জন্য উপভোগ করতে চেয়েছিল। সেই কারণেই অগত্যা তাকে নেহালের দারস্থ হতে হয়। অপরদিকে নেহালেরও মেহুলকে জীবনসঙ্গিনী রূপে চাওয়ার ছিল। তাই এমন একটা সুযোগ লুফে নিতে পিছপা হয়নি নেহাল। সেই সাথে মিহিরকে ওই বাড়িতে একা রাখাটা অনিরাপদ মনে করায় নিজের বন্ধুর সাথে তার বিয়ের ব্যবস্থা করে দেয় নেহাল। এই হচ্ছে জোড়া বিয়ের রহস্য। মিহির হয়ত টুকটাক জানত তবে মেহুল বড্ড জেদী হওয়ায় কেউ তাকে জানানোর সাহস পায়নি।
__________
সবটা শুনে মেহুল স্তব্ধ হয়ে গেল। তার মুখ থেকে কেবল একটি বাক্য নির্গত হলো,
‘ নেহাল আপনি কী আমাকে দয়া দেখাতে বিয়ে করেছেন? ‘
নেহাল এক ঝটকায় মেহুলকে বুকে জরিয়ে নিয়ে বলল,
‘ আমার কথাগুলো কী মনোযোগ দিয়ে শুনেছিলেন পাগলি? আমি তোমার প্রেমে কোনো এক *বৃষ্টিস্নাত ভোরে* মাতাল হয়েছিলাম। সেইদিনের সিদ্ধান্তের প্রতিফলন স্বরূপ তুমি আমার সাহেবা। ‘
নেহালের কথাগুলো শুনে মেহুল তার বুকে মাথা ঠেকিয়ে অশ্রু বর্ষণ শুরু করে। নেহাল বাধা না দিয়ে তাকে হালকা হওয়ার সুযোগ করে দেয়।
__________
#চলবে_ইনশাআল্লাহ…
#NUSRAT_TABASSUM_METHILA
[ আমি প্রচণ্ড অসুস্থ সকলের নিকট দোয়াপ্রার্থী। জ্বর, ঠাণ্ডা, কাশি সবটা মিলিয়ে দুর্বিষহ অবস্থা আমার। অনেক কষ্ট করে আজকের পর্বটা লিখেছি। আশা করি বিবাহ পূর্ব রহস্যের সমাধান পেয়েছেন। ছোট্ট একটা মন্তব্য করে আপনাদের মনের অনুভূতিগুলো জানিয়ে যাবেন প্রত্যাশা করি। ]
[ রিচেক হয়নি। ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]