#বৃষ্টিস্নাত_ভোর
#পর্ব_০৩
#লেখনীতে_নুসরাত_তাবাস্সুম_মিথিলা
_________
মাথাটা ঝিম ধরে রয়েছে। চোখের পাতা প্রচণ্ড ভারী অনুভূত হচ্ছে। আস্তে করে চোখটা খোলার চেষ্টা করলাম। চোখ খুলতে বেশ খানিকটা বেগ পেতে হলো। সামনের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই আব্বুর শুকনো মুখ, আম্মুর অশ্রুসিক্ত চোখ আর নেহালের চিন্তিত মুখাবয়ব ভেসে উঠলো। আমি শোয়া থেকে উঠে বসার ব্যর্থ চেষ্টা চালাতে লাগলাম। কিন্তু দুঃখজনক বিষয়টি হলো আমার শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি অবশিষ্ট নেই। আমাকে অস্থির হতে দেখে নেহাল বলে উঠলেন,
‘ মেহুল অস্থির হবেন না, প্লিজ। ‘
‘ আমি উঠতে পারছি না কেন? ‘ চিন্তিত স্বরে বললাম।
‘ আসলে আপনার প্রেসার লো হয়ে গিয়েছিল। তাই আপনি সেন্সলেস হয়ে পড়েছিলেন। এখন আপনার শরীর দুর্বল, একারণে আপনি শরীরে শক্তি পাচ্ছেন না। অতিরিক্ত ভয় পাওয়ার কারণে এমনটা হয়েছে। ‘ একনাগাড়ে সবটা বলে থামলেন নেহাল।
‘ ওহ্ আচ্ছা। ‘ আর কথা বলার শক্তি পেলাম না। আস্তে আস্তে চোখজোড়া বুজে ঘুমের সাগরে ডুবে গেলাম। এই মুহূর্তে চোখ ভেঙে ঘুম আসছে।
________
হঠাৎ চিৎকার-চেচামেচিতে ধরফরিয়ে উঠে বসলাম। আশেপাশের পরিস্থিতি ঠাওর করার চেষ্টা করছি। জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টিপাত করলাম। আকাশ লাল আভায় ছেয়ে গেছে। একটু পরই মাগরিবের আযান দেবে। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। চিৎকার, চেচামেচি আব্বু-আম্মুর রুম থেকে ভেসে আসছে। তাই আর তাদের ঘরে অগ্রসর হলাম না। তাদের মাঝে মনমালিন্য হলে এরকমটা করেন। আবার খানিকক্ষণ পরেই সবটা স্বাভাবিক হয়ে যায়। আমি ওয়াশরুমে গেলাম ফ্রেশ হয়ে ওযু করে আসার জন্যে। আজকে যোহরের, আসরের নামাজ মিস হয়ে গিয়েছে। মাগরিব কোনো মতেই মিস করা যাবে না। যেই ভাবা সেই কাজ। সালাত আদায় করে মিহিরের রুমে গেলাম। মেয়েটা একদৃষ্টে জানালার বাইরে তাকিয়ে রয়েছে। কী যে ভাবতে থাকে সবসময়! ওর পাশে গিয়ে বসলাম, তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। ও জানালা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আমায় খানিকটা সময় দেখল। তারপর বলল,
‘ আপাই তোর কোলে একটু মাথা রাখি? ‘
কী আকুল আবেদন? যেন জীবনের শেষ কিছু চাইছে। আমি এসব কী আবোলতাবোল ভাবছি! কিছু হবে মিহিরের। মানুষের জীবনে কত প্রতিবন্ধকতা আসে, সবটাকে হার মানিয়ে সাহসীরা ঠিকই ঘুরে দাঁড়ায়। আবার বিশ্বাস মিহির অদম্য সাহসীকতার পরিচয় দেখাবে। ধ্যান ভঙ্গ হলো মিহিরের দ্বিতীয় প্রশ্নে।
‘ আপাই কী ভাবছো? ‘
‘ ভাবছি তোর জন্য তোর প্রিয় কিছু রান্না করব। ‘ মুখে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে বললাম।
‘ সত্যিই আপাই! ‘ মিহিরের চোখে, মুখে খুশির ঝলক।
‘ হুম। সত্যি বলছি মিহির। আচ্ছা আপু একটা কথা বলোতো? ‘
‘ কী বলব আপাই? ‘
‘ তুমি আগের মতো কথা বলছো না কেন? এত চুপচাপ থাকা তোমায় মানায় না ডিয়ার। ‘ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললাম আমি।
‘ আপাই আমি তো কথা বলতেই চাই। কিন্তু আমার ভালো লাগে না। সবসময় ওই নরপিশাচগুলোর হিংস্রতা মনে পড়ে যায়। আপাই আমাকে ওরা অনেক মেরেছে জানিস? আমার হাত-পা বেঁধে রেখে যা খুশি তাই করেছে। আমি ওই শিহাবকে কতবার বলেছি, ভাইয়া প্লিজ এমন করো না। কিন্তু ওরা আমার কোনো কথাই শোনেনি। আপাই আমার কত কষ্ট হয়েছে জানিস! যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলাম, মনে হয়েছিল এই বুঝি মরে যাচ্ছি। ‘ কাঁদতে কাঁদতে মিহির আমায় জড়িয়ে ধরলো। যেই বোনের সামান্য কষ্টে আমার হৃদয়ে অসহনীয় যন্ত্রণা অনুভূত হতো। সেই বোনের এমন হৃদয় বিদারক কান্না আমি থামাতে পারছি না, তার যন্ত্রণা আমি লাঘব করতে পারছি না। এই তীব্র ব্যর্থতা আমি কী করে শোধরাবো? মিহিরের কান্না দেখে অজান্তেই আমার চোখ বেয়ে অশ্রুধারা বর্ষণ শুরু হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ মনে হলো আমি ভেঙে পড়লে ওকে সান্ত্বনা দেবে কে? আমাকে শক্ত হতে হবে। সাথে ওর দুর্বিষহ অতীতের কালো জগৎ থেকে বর্তমানের আলোকিত সময়ে ফিরিয়ে আনতে হবে। ওই মানুষরূপি পশুগুলোকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। তাই আমি নিজের চোখের নোনাজল মুছে মিহিরের মুখ তুলে ধরলাম। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘ আমার মিহির পাখিকে কাঁদলে বেমানান লাগে। যতই দুঃখ পাও না কেন, কখনো কাঁদবে না। কাঁদলে তোমার সত্ত্বা দুর্বল হয়ে পড়বে। মনে সাহস সঞ্চার করো। নিজের প্রতি হওয়া প্রতিটি অন্যায়ের হিসেব কষে রাখো। সময়মতো এই অন্যায়ের প্রতিশোধ তুলতে হবে তো! এর জন্য তোমায় শক্ত হতে হবে। ভেঙে পড়া চলবে না। যেন তোমায় দেখে প্রতিটি নিপীড়িত প্রাণ সাহসী হয়ে উঠতে পারে। তোমাকে সেই সকল নিপীড়নের শিকার হওয়া ব্যক্তির জন্য লড়াই করতে হবে। ‘
আমার প্রতিটি কথা, বাচনভঙ্গি অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে প্রত্যক্ষ করল মিহির। তারপর নিজের চোখ মুছে আমায় বলল,
‘ ঠিক বলেছো আপাই। আমি আর কাঁদব না। এবার কাঁদবে ওরা, যারা আমার প্রতি অন্যায় করেছে। আমার সাথে করা প্রতিটা অন্যায়ের শাস্তি ওদেরকে পেতে হবে। ‘ ওর চোখে মুখে প্রতিশোধ প্রবণতা পরিলক্ষিত হলো। এটাই তো আমি চাইছিলাম।
অনেকেই বলে থাকেন পোশাক-পরিচ্ছদ নির্বাচনে মেয়েদের অশালীন আচরণ মূলত অধিকাংশ রেপের কারণ। আমার মতেও কথাটি যথেষ্ট যুক্তি সংগত। মেয়েদের পর্দানশীল হওয়া প্রয়োজন নিজেকে হেফাজত করার জন্য। কিন্তু আমার বোনের দোষ কোথায়? ও তো কখনো বেহায়াপনা প্রদর্শন করেনি। সবসময় নিজেকে আবৃত রেখেছে, পর্দা বজায় রেখে চলাফেরা করেছে। উশৃঙ্খল জীবন পদ্ধতি পরিহার করে চলেছে। তবে ওর জীবনে কেন এমন জঘণ্য ঘটনা ঘটল? কেউ কী দিতে পারবে এর উত্তর? প্রশ্নসমূহ মনের মাঝেই জমিয়ে রাখলাম। ফোনের ভাইব্রেশনে চিন্তার জগৎ থেকে বাস্তবে প্রবেশ করলাম। নেহাল হাসনাত কল করেছেন। আমি ব্যস্ত হয়ে কল রিসিভ করলাম। ওপাশ থেকে নেহাল বলে উঠলেন,
‘ মেহুল নিউজ চ্যানেলগুলোকে আফসার মির্জা বিশাল পরিমাণ অর্থ দিয়ে চুপ করিয়ে রাখতে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এমনকি আমি যেই নিউজ চ্যানেলের ক্রাইম রিপোর্টার তারাও হয়তো নিজের মনুষ্যত্বকে বিক্রি করে দেবে বলে মনে হচ্ছে। পরিস্থিতি আমার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এমন সিচুয়েশন কখনো ফেস করিনি। আমার ছ’বছরের ক্যারিয়ারে। ‘
এতগুলো দুঃসংবাদ শুনে চরম হতাশায় নিমজ্জিত হলাম। এ থেকে কী উপায়ে উত্তরণ হতে পারি? আমি নেহালকে বললাম,
‘ আপনি কী আমাদের বাসায় আসতে পারবেন? ফোনে এ সংক্রান্ত কথা বলা অনিরাপদ মনে করছি। বলা যায় না প্রভাববিস্তার করে কেউ কল ট্র্যাক করতে পারে। আপনার আপত্তি না থাকলে বাসায় এ নিয়ে আলোচনা করাটাই নিরাপদ বোধ করছি। ‘
‘ ঠিক আছে আমি আসছি মেহুল। ‘
‘ আর একটা কথা আইনজীবী ঠিক করার দায়িত্বটা আপনাকে দিতে চাই। কারণ এ সম্পর্কে আমার বা আমার পরিবারের বিন্দু পরিমাণ ধারণা নেই। ‘
‘ আমি দেখছি কী করা যায়? ‘
‘ হুম। ‘
ফোন কেঁটে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এত হতাশা কেন আমাদের জীবনে? যদি বিরাট সম্পদশালী ব্যক্তি হতাম তবে খুব সহজেই ন্যায় বিচার হয়তো পেতাম। কিন্তু আজ মধ্যবিত্ত বলে সবক্ষেত্রেই বঞ্চনার শিকার হতে হবে? নাহ্ এই অপসংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। আমাকে চিন্তিত দেখে মিহির বলে উঠল,
‘ আপাই হাল ছেড়ে দিচ্ছ? ‘
বুকের মধ্যিখানে বিষাক্ত তীরের ন্যায় কথাটি বিঁধল।তবে কি আমি মিহিরের আস্থা ভঙ্গের কারণ হয়ে যাচ্ছি? নাহ্ হতাশ হলে চলবে না। সত্যের পথে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। বিজয় কখনো নিজে ধরা দেবে না। আমাকে ছিনিয়ে নিতে হবে। মিহিরের দিকে তাকিয়ে হলেও আমায় শক্ত হতে হবে।
__________
#চলবে_ইনশাআল্লাহ…
#NUSRAT_TABASSUM_METHILA
[ ডিয়ার রিডার্স,
অসুস্থতাজনিত কারণে আজকের পর্বটি তুলনামূলক ছোট হয়েছে। এজন্য আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। আর কিছু কথা,
গঠনমূলক মন্তব্য প্রত্যাশী। আপনারা একদম সাড়া দিচ্ছেন না গল্পে। আমি এর ফলে লেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছি। এমন হলে অতি শীঘ্রই ইতি টানতে হবে আমাকে। কারো মনে আঘাত দিয়ে থাকলে ক্ষমা প্রত্যাশী। ]
[ রিচেক হয়নি। ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]