কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন #পার্ট_১৩ জাওয়াদ জামী

0
568

#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_১৩
জাওয়াদ জামী

সেদিনের পর থেকে শুভ যতটা পারে কান্তাকে এড়িয়ে চলে। হাজার প্রয়োজনেও কান্তার সাথে কথা বলেনা। তবে সে সেদিনের ঘটনা ভুলেনি, আর না ভুলেছে আরমানের করা অপমানগুলো।সে সুযোগের অপেক্ষায় আছে। সুযোগ পেলেই সেদিনের অপমানের জবাব দিয়ে দিবে।

কান্তা আর খালা মিলে ড্রয়িংরুম পরিষ্কার করছিল। আকলিমা খানম এবং রাজিয়া খানম দুজনেই বসে বসে ওদের কাজ দেখছে আর গল্প করছে।

” মম, তোমার টিচার ছেলের বউ দেখছি খুব কাজের! একা হাতেই সব কাজ করে বাড়ির সবাইকে কনভিন্স করার চেষ্টা করছে নাকি? এ খুব চালাক মেয়ে, বুঝলে? এর থেকে সাবধানে থাকতে হবে। নয়তো দেখবে এ বাড়ি থেকে সবাইকে তাড়িয়ে ও নিজে রাজত্ব করছে। তোমার মাষ্টার ছেলে নিজের দল ভারি করতে বিয়ে করে এনেছে। ”

” মুখ সামলে কথা বল, দেওরা। বাসায় এসেই আমার পিছনে লাগবে, আর আমি তোমাকে ছেড়ে দিব এটা কিন্তু ভেবোনা। আমার সাথে কথা বলতে হলে ভেবেচিন্তে বলবে। নইলে দেখবে কথা বলার জন্য ঐ মুখই থাকবেনা। মনে রেখ, তোমাকে সাইজ করতে আমি একাই যথেষ্ট। তোমার ভাইয়াকে এখানে কোন দরকার পরবেনা। ”

” এই মেয়ে, তুমি আবার আমার ছেলের সাথে দুর্ব্যবহার করছ? আর একবার যদি আমার ছেলের সাথে এভাবে কথা বলেছ, তবে এক থা’প্প’ড় মে’রে তোমার গাল ফা’টি’য়ে দিব। ” আকলিমা খানম তেড়ে আসে।

” ভুলেও এমন কাজ করার কথা মাথায় আনবেননা, আম্মা। তবে ক্ষতিটা আপনারই হবে।
আপনি কি চোখে কম দেখেন, নাকি চোখে ঠুলি পরে থাকেন? নাকি কানে কম শুনেন? আপনার বেয়াদব ছেলে বাসায় এসেই আমাকে পিঞ্চ মে’রে কথা বলছে, সেটা আপনার চোখে পরছেনা? ছেলেকে শাসন না করলেন ঠিক আছে, কিন্তু তাকে সহবৎ শেখাতে দোষ কোথায়! কিন্তু আপনি তা না করে, আমাকে কথা শোনাচ্ছেন! নেহাৎই আপনি আমার শ্বাশুড়ি, তাই আপনার এমন দোমুখো কাজকর্ম মানতে হচ্ছে। ”

” এই যে ফ’কি’ন্নি’র ঘরের ঝি? কাকে তুমি কি বলছ তা ভেবে দেখেছ? ডোবা-নালার মাছ সাগরে পরেছ, তাই সাপের পাঁচ পা দেখেছ। তাই এমন তেজ দেখাচ্ছ। তবে শুনে রাখ, তোমার তেজ মাটিতে মিশাতে আমার কিছু সময় লাগবে মাত্র। ” রাজিয়া খানম নিজের জায়গায় বসেই কান্তাকে হু’ম’কি দেয়।

” আমি নাহয় ফ’কি’ন্নি’র ঘরের ঝি, তা মানলাম। কিন্তু আপনার ব্যবহার দেখে তো মনে হয়না, আপনি ভদ্রঘরের ঝি। কথায় আছেনা, ব্যবহারেই বংশের পরিচয়। আপনার ব্যবহারেই বুঝা যায় আপনি কেমন ঘরে বেড়ে উঠেছেন । আজ এই মুহূর্তে আমি সবাইকে সাবধান করে দিচ্ছি, আমার সাথে ঠিকঠাক ব্যবহার করলেই তবে, আমার থেকে ভালো ব্যবহার আশা করবেন। মনে রাখবেন, ই’ট মা’র’লে পা’ট’কে’ল খেতেই হবে। আশা করি কথাটা মাথায় ভালোভাবে ঢুকিয়ে রাখবেন। আর কার তেজ কে মাটিতে মিশায় তা সময়ই বলে দিবে, দাদি শ্বাশুড়ি। ” কান্তা খালাকে বাকি কাজ করতে বলে নিজের রুমে চলে আসে।

গোসল সেরে নামাজ আদায় করে, রান্নাঘরে যেয়ে খালার সাথে বসে খেয়ে নেয়। ততক্ষণে বাড়ির সকলের খাওয়া শেষ। কান্তা খাওয়া শেষ করে নিজের রুমে আসে। এরপর কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি করে।

আজ কান্তা কোচিং-এ একটু তারাতারি এসেছে। ও নিজের ক্লাসরুমে এসে ব্যাগ রেখে বাইরে আসে। এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে খুঁজতে থাকে। আশেপাশে কাউকে না দেখে সব-কয়টা ক্লাসরুমে খুঁজে দেখার সিদ্ধান্ত নেয়। পরপর তিনটা ক্লাসরুমেই খুঁজে কাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তিকে না পেয়ে চতুর্থ রুমের দরজার সামনে এসে ভেতরে উঁকিঝুঁকি মা’র’তে থাকে।

” এখানে কি? এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে কি দেখছ?
নাকি কারও সাথে লাইন মা’রা’র চেষ্টা করছ! ” প্যান্টের পকেটে হাত রেখে কান্তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে আরমান।

হঠাৎ পেছন থেকে কারও কথা শুনে চমকে উঠে কান্তা। পেছন ফিরে আরমানকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, বুকে ফুঁ দেয়।

” এভাবে চো’রে’র মত কেউ পেছনে এসে দাঁড়ায়? ভয়ে যদি আমার হার্ট অ্যাটাক করত? বেয়াক্কেল লোক একটা। লাইন মারতে দিলেন কই! তার আগেই সিআইডির মত হাজির হয়েছেন। দেখি সাইড দেন আমি ক্লাসে যাব। আজ আপনার সাথে ঝ’গ’ড়া করার মুড নেই। ”

” ঝ’গ’ড়ু’টে বুড়ির ঝ’গ’ড়া করার মুড নেই! এটাও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে! কি দিন আসল। বিড়াল বলে মাছ খাবনা। তা ঝ’গ’ড়া করার মুড নেই কেন? ”

” বাসায় ব্যাপক ঝ’গ’ড়া করেছি। কিন্তু আপনি কি আমাকে বিড়াল বললেন? ”

” নাহ্ তোমাকে বিড়াল বলিনি। ঝ’গ’ড়ু’টে বুড়িকে বিড়াল বলেছি। আজকাল কারও সাপোর্ট ছাড়াই ঝ’গ’ড়া শিখে গেছ! জীবনে অনেকদূর যাবে দেখছি। ”

” আজ আপনার খাওয়া বন্ধ। আমাকে একসাথে ঝগড়ুটে বুড়ি এবং বিড়াল বলেছেন। ” দাঁতে দাঁত পি’ষে বলল কান্তা।

কয়েকজন মেয়ে ওদেরকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের ক্লাসরুমে যাচ্ছিল। কান্তা আর আরমানকে একসাথে দেখে ওরা বাঁকা চোখে তাকায়।

” স্যার, আপনিতো আমাদের পাত্তা দেননা। কিন্তু এই মেয়ে কোচিং-এ এসেছে দুইদিন হলো। এই দুইদিনেই তার মাঝে কি দেখলেন যে এভাবে চিপকে আছেন? ” কয়েকজন মেয়ের মধ্যে থেকে একজন বলে।

” আমি কি করব, না করব সেটা আমাকেই ভাবতে দাও। মনে রেখ, তোমরা আমার স্টুডেন্ট। তাই নিজেদের স্টুডেন্টের জায়গায়ই রাখ। আমি কার সাথে কথা বলব সেই চিন্তা আমাকেই করতে দাও। স্টুডেন্ট হয়ে একজন টিচারের বিষয়ে ইন্টারফেয়ার করার দুঃসাহস আর দেখিওনা৷ নিজেদের ক্লাসে যাও আর ভবিষ্যতে কোন টিচারকে এমন প্রশ্ন করার সাহস করোনা। নাউ গেট লষ্ট। বেয়াদব কত প্রকার ও কি কি তা তোমাদের দেখে বুঝতে পারছি। ” রা’গে আরমানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে।
আর সেই মেয়েরাও ভাবেনি তাদের এমন চরমভাবে অপমানিত হতে হবে। তারা সুরসুর করে নিজেদের ক্লাসরুমের দিকে পা বাড়ায়।

কান্তাও এমন কান্ডে বেশ ভড়কে গেছে। কি থেকে কি হয়ে গেল! এমন অবুঝের মত কাজ করা মোটেও ঠিক হয়নি। ওর এই বাচ্চামির জন্য মেয়েরা কি মনে করল। এরকম নানান কথা চিন্তা করছে কান্তা।

” কি হলো! এভাবে খা’ম্বা’র মত দাঁড়িয়ে আছ কেন? আজ কি ক্লাস করার ইচ্ছে নেই! তবে সেই ইচ্ছেকে আপাতত মা’টি’চা’পা দাও। তুমি না চাইলেও আমি তোমার হাত-পা বেঁ’ধে পড়তে বসাব। ”

” আমি কি একবারও বলেছি ক্লাস করবনা। শুধু শুধু আমাকে ঝাড়ি দেন। গোমড়ামুখো ভূ’ত একটা। খোঁ’চা মারায় যদি কেউ পিএইচডি করে তবে সেটা আপনিই হবেন৷ দয়ামায়াহীন নিতাই মাষ্টার। ”

” শেষ? নাকি আরও আছে? ”

” কি শেষ! ”

” আমাকে গা’লি দেয়া শেষ? যদি শেষ না হয়, তবে তারাতারি গা’লি দিয়ে ক্লাসে যাও। এখন সবাই দরজার কোন দিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে আমাদের দেখছে, আরেকটু সময় থাকলে সামনে এসে দাঁড়িয়ে সার্কাস দেখবে। ”

” আচ্ছা যাচ্ছি তবে। ফোঁকলা বুড়োর বোধহয় দাঁত নেই, তাই হাসতে জানেনা। ” কান্তা আর দাঁড়ায়না। নিজের ক্লাসরুমে চলে যায়।

আরমানও হেসে প্রস্থান করে।

কান্তা ক্লাসে আসলে কয়েকটা মেয়ে ওকে আরমানের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। কান্তা সত্যি কথা বলতে যেয়েও বলেনা। আরমান যেখানে ওদের সম্পর্কের কথা কোন ছাত্র-ছাত্রীকে জানায়নি, সেখানে ওর আগ বাড়িয়ে বলতে যাওয়া বোধহয় উচিত হবেনা।
তাই কান্তা সুকৌশলে সবার প্রশ্ন এড়িয়ে যায়।

কান্তা বাসায় এসে দেখল পরিস্থিতি থমথমে। কেউ ওর দিকে একটিবারের জন্যও তাকাচ্ছেনা।
ও লক্ষ্য করল ড্রয়িংরুমে একজন গুটিসুটি মেরে বসে আছে। আকলিমা খানম ও রাজিয়া খানম দুজনেই সেই ব্যক্তিকে নানান কটুকথা শোনাচ্ছে।

” তোমার সাহস হয় কি করে, আমার বাসায় আসার? চরিত্রহীনের দল, লোভীর বংশধর। আমার সবকিছু গ্রাস করতে এসেছ? একবার সুযোগ পাওনি, এখন আবার এসেছ গ্রাস করার মতলবে ? সেটি হচ্ছেনা। প্রয়োজনে তোমাকে পুলিশে দেব। লোভী বাবা-মা’র সন্তান যে কখনও ভালো হয়না, তার চাক্ষুষ প্রমান তোমরা দিলে। ” রাজিয়া খানমের গলায় রা’গ, ক্ষো’ভ ঝড়ছে।

” আম্মা, আমি এখানে কোন মতলব নিয়ে আসিনি। আমি এখানে কেন এসেছি সেটা আপনাকে আগেই বলেছি। ” ড্রয়িংরুমে বসা ব্যাক্তি বলে।

” একদম চুপ। মুখেমুখে কথা বলবেনা। বেড়িয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে। আমরা নেহাৎই ভদ্রলোক, তাই এখনও তোমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিইনি। যতসব ছোটলোকের দল, ভিক্ষুকের দল আমার বাড়িতে এসে ভিড় করে। আমার বাড়ির ভিক্ষা না পেলে এদের পেটের ভাত হজম হয়না। ”

রাজিয়া খানমের কথার তেজে সেই ভদ্রলোকটি মাথা নিচু করে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। যেতে যেতে চোখের কোনে জমা হওয়া জলটুকু মুছে নেয়।

কান্তা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল।
ও স্তব্ধ, বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে রাজিয়া খানমের দিকে। একটা মানুষ কতটা নিকৃষ্ট হলে কাউকে এমনভাবে বলতে পারে! সেই সাথে অচেনা ব্যাক্তির প্রতি জন্ম নেয় সহানুভূতি।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here