#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৬
ইমারজেন্সি রুমের বাহিরে হাত মুঠো করে স্থির বসে রয়েছে মোহ। তার ওড়নায় লেগে থাকা জবজবে র;ক্ত শুঁকিয়ে গিয়েছে। মাছি ভনভন করছে র;ক্তের কারণে আশেপাশে। ক্ষণে ক্ষণে কিঞ্চিৎ কাঁপুনি দিয়ে উঠছে মোহের শরীর। স্বচ্ছের র;ক্তপাত ও শরীরের ক্ষ/ত দেখে আতঙ্ক বেড়েছে তার। যতই অসহ্য লাগুক মানুষটিকে তবুও মনে মনে একটিই কামনা করছে সে। সেটা হলো স্বচ্ছের সুস্থতা। আরো দীর্ঘক্ষণ প্রতীক্ষার পরেই ইমারজেন্সি রুমের লাইট যখন বন্ধ হলো নিজের অস্থিরতা চাপিয়ে রাখতে না পেরে দাঁড়িয়ে গেল মোহ। হনহনিয়ে এসে দাঁড়াল ডক্টরের সামনে। সে কিছু না বলতেই ডক্টর বললেন,
“জলদি এখানে নিয়ে এসেছিলেন। সে কারণে মৃ/ত্যু থেকে রেহাই পেয়েছেন। আর একটু ব্লি/ডিং হলে জীবন অনিশ্চিত হয়ে যেত।”
মোহ তীব্র আশঙ্কা নিয়ে শুধায়,
“এখন উনি ঠিক আছেন?”
“হ্যাঁ কপালে সামান্য চো/ট লেগেছে। সেই সাথে হাত আর পায়ে একটু সমস্যা হয়েছে। ঠিক হয়ে যেতে পারে। তবে কপাল থেকে বেশ ব্লি/ডিং হচ্ছিল। ভাগ্যিস র:ক্তের গ্রুপটা রেয়ার নয়। নাহলে কী যে হতো! এখনো অচেতন অবস্থায় আছেন। আশা করা যায় খুব দ্রুতই জ্ঞান ফিরবে।”
“থ্যাংক ইউ ডক্টর।”
মোহ ডক্টরের পাশ কাটিয়ে আস্তে করে রুমে ঢুকে পড়ে। এলোমেলো পায়ে এগোতেই দৃষ্টি বদ্ধ হয় সিঙ্গেল বেডে অবচেতন হয়ে থাকা পুরুষটির দিকে। বাম হাতে স্যালাইনের নল লাগানো। সরু ঠোঁটের ডান পাশ কেটে গিয়েছে। ডান গালটি ফোলা এবং লাল বর্ণ ধারণ করেছে। কপালে পড়েছে মোটা ব্যান্ডেজ যেটা সামনের চুলগুলোকেও ঢেকে নিয়েছে। হাতেও প্লাস্টার করা। সব মিলিয়ে যা-তা অবস্থা! স্বচ্ছের দুই নয়নের পানে তাকায় মোহ। আকাঙ্ক্ষী হয় মানুষটির লোচনের ধূসর বর্ণ দেখার অপেক্ষায়। পাশে থাকা ছোট্ট টুলে ক্লান্তির সাথে বসে পড়ে মোহ। এত চিন্তা, এত ছোটাছুটি তাকে অবসন্ন বানিয়েছে। তার দুটো চোখও বুঁজে আসছে। এমতাবস্থায় ফোনটা বেজে উঠল তার। চমকে উঠে ফোন বের করে একবার স্বচ্ছের দিকে তাকিয়ে একবার ফোনের দিকে তাকিয়ে তড়িঘড়ি করে জানালার কাছে চলে আসে সে। স্ক্রিনে ভেসে ওঠা মা নামটি দেখে দ্বিধায় পড়ে যায় কলটি রিসিভ করবে কিনা। সে জানে, কল ধরলে প্রথমেই মায়ের প্রশ্ন হবে কোথায় সে, এখনো ফিরছে না কেন? কলটি কেটে গিয়ে যখন আবারও নিজ ছন্দে বেজে ওঠে তখন বাধ্য হয়ে কল ধরে কথা বলতে উদ্যত হয় মোহ। তবে তার আগেই মিসেস সুফিয়া ফোনের ওপাশ থেকে প্রশ্ন করে বসেন,
“কী রে? কোথায় তুই? কতক্ষণ হয়েছে বাহিরে বেরিয়েছিস? এখনো ফিরছিস না কেন?”
মোহ আমতা আমতা করতে আরম্ভ করে। মস্তিষ্ক অস্থির হয়ে পড়ে কোনো এক বাহানা খুঁজতে। বাহানা খোঁজার কারণ সে এই মুহূর্তে স্বচ্ছকে ছেড়ে যেতে চায় না। সেই মুহূর্তে তার সঙ্গে সাথ দেয় বৃষ্টি। হুট করেই মেঘলা আকাশ থেকে পড়ন্ত ছোটো ছোটো ফোটার বৃষ্টি ঝুম বৃষ্টিতে পরিণত হয়। তা দেখে খুশিতে নেচে ওঠে মোহের মন। খুশিতে উৎকণ্ঠা হয়ে ধড়ফড়িয়ে বলে বসে,
“মা, বৃষ্টি শুরু হয়েছে তো!”
মিসেস সুফিয়া বেশ অবাক হলেন। সন্দিহান হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“বৃষ্টি এসেছে বিষয়টাতে তোকে এত খুশি মনে হচ্ছে কেন? আর বৃষ্টি জোরে তো সবেমাত্র এলো। একটু আগেও কম ছিল। তুই বেরিয়েছিস কম সময় তো হয়নি। কতক্ষণ আগে বাড়ি ফিরে আসার কথা তোর?”
মোহ এবার মায়ের কথায় ভড়কে গেলেও বিরক্তি হওয়ার ভান ধরল।
“মা! তুমি জানো ঢাকা শহরে কত জ্যাম। তাও এ কথা বলছ। এমনভাবে সন্দেহ করছ যে আমি পালিয়ে এসেছি। টেনশন করবে না আমি সময় মতো বাড়ি পৌঁছে যাব। তুমি জাস্ট ইথানের খেয়াল রেখো একটু। ও খেতে চাইবে না হয়ত। একটু জোর করে খাইয়ে দিও।”
হুড়মুড়িয়ে কোনোরকমে কল কেটে স্বস্তির শ্বাস মন ভরে নেয় মোহ। অতঃপর দৃষ্টি বাহিরে বর্ষিত পানির ফোঁটাতে আঁটকায়। আজকের বর্ষণ তাকে যেন নিজে থেকে এসে বলছে, ‘তুই অসহ্যকর মানুষটাকে ছেড়ে এখনি যেতে পারবি না। তোকে যেতে দেওয়া হবে না। তারই সংলগ্নে থাকতে বাধ্য করব তোকে।’
দীর্ঘ সময় কেটে গেল। স্বচ্ছ নিজের চোখ দুটো খোলার ক্ষমতা পেল। তবে নাড়াতে পারল না শরীরের কোনো অঙ্গ। সারা শরীরের ব্যথায় অবশ হয়ে এসেছে। পিটপিট করে তাকিয়ে উপরে শব্দ করে চলা একটি পুরোনো ফ্যান নজরে পড়ল। মাথাটা বাম পাশে ঘুরিয়ে দেখল হাতে স্যালাইনের নল লাগানো। স্যালাইন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ডান দিকে ঘাড় ঘুরাতেই এক নারী মূর্তির দেখা পেল সে। রমনির কোঁকড়া চুলের বেণী দেখে মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল সেই সাথে একটি নাম মনে এসে গেল আপনাআপনিই। অথচ স্বচ্ছের এই ঝিম ধরানো নারীটি নির্বিঘ্নে প্রকৃতির বর্ষণ উপভোগে ব্যস্ত। স্বচ্ছ দুর্বল গলায় ডাক দিলো।
“কে?”
আকাঙ্ক্ষিত মানবী পিছু ফিরে তাকাল। যাকে একদমই আশা করেনি স্বচ্ছ। মোহ ভেজা চোখেমুখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। স্বচ্ছ হতভম্ব হয়ে শুধাল,
“তুমি এখানে?”
প্রতিবারের মতো মোহের মুখ থেকে বাঁকা উত্তরই বেরিয়ে এলো।
“কেন আমি কি এখানে থাকতে পারি না?”
“সেটা কখন বলেছি? তুমি কখনো সোজা কথা বলতে পারো না?”
“না, পারি না। যে যেমন প্রশ্ন করে তার তেমনই উত্তর হওয়া উচিত।”
প্রতিত্তোর করতে করতে স্বচ্ছের নিকটে এলো মোহ। স্বচ্ছ আবারও মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে নিলো তাকে। আসলেই এই মেয়েটা তার সামনে? অথচ গত রাতেই কল ধরছিল না! স্বচ্ছ কৌতূহল নিয়ে জানতে চায়,
“তুমি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছ?”
“না। আমার আত্মা নিয়ে এসেছে। বাইক সামলে চালাতে পারেন না? হঠাৎ এক্সি’ডেন্ট করে বসলেন কেন?”
“সুস্থ লাগতে ভালো লাগছিল না তো তাই এক্সি:ডেন্ট করলাম।”
মোহ কপাল জড়িয়ে বলে ওঠে,
“এটা কেমন কথা?”
“কেমন কথা আবার?”
মোহ দাঁতে দাঁত চেপে বলতে থাকে,
“আপনাকে বাঁচাতে গিয়ে এদিকে আমি ফেঁসে যাচ্ছি আর আপনার ত্যাড়া কথা আমাকে শুনতে হচ্ছে। আমি ডক্টরকে ডাকতে যাচ্ছি। আপনার একবার চেকআপ করানো দরকার। এমনিতে সরকারি হাসপাতাল। আপনাদের প্রাইভেট হসপিটালের মতো কতটা সেবা দিতে পেরেছে জানি না।”
মোহ বাহিরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়। আগপাছ চিন্তা না করে তৎক্ষনাৎ তার হাতটা চেপে ধরল স্বচ্ছ। স্যালাইনের সুঁচ ফোঁড়ানো হাতে টান পড়ল তার। সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দিলো মোহের হাত। তবে নিজেকে স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় রেখে বলল,
“এতই যখন রাগ আমার উপর তবে কেন তুমিই আমাকে সাহায্য করলে? এড়িয়ে আসতে পারতে তো আমার র;ক্তাক্ত দেহ।”
মোহ চুপ থাকে এবার। মুখে আসে না একটি শব্দও। আসলেই তো! কেন সে এড়াতে পারল না? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে স্বচ্ছ আরো বলতে থাকে,
“তাছাড়া আমি, আমার বাবার দ্বারা কম ক্ষতি তো হয়নি তোমার আর তোমার পরিবারের। অনেক অ/ন্যায় করেছে আমার বাবা। তবুও কেন তার ছেলেকে সাহায্য করতে মরিয়া হয়েছ?”
মোহের মুখের বুলি ফুটল এবার। কাঁপা সুরে বলল,
“কারণ আপনারা যা করেছেন তার শোধ এভাবে তুলতে হবে তার তো কোনো মানে নেই। আপনি আমাকেও সাহায্য করেছিলেন। আমার ছেলেকে হসপিটাল অবধি নিয়ে গিয়েছেন।”
“সেই সাহায্যের শোধ এভাবে মিটিয়ে দিচ্ছো?”
“হয়ত।”
মোহের এই ছোট্ট, দায়সারা উত্তর হজম হলো না স্বচ্ছের। সে আরো কিছু শুনতে চেয়েছিল। তার প্রবৃত্তি সীমা অতিক্রম করে ফেলে যাচ্ছে। মোহের কথায় কথায় সে স্পষ্ট অনুরাগ খুঁজে পেয়েছে। সেটার কারণও ধরতে পেরেছে স্বচ্ছ। মোহ ফের বের হতে নিলো সেখান থেকে। আগের মতোই তার হাতটা ধরে ফেলল স্বচ্ছ। মোহ এবার রাগ দেখিয়ে কিছু বলতে চাইল। তবে স্বচ্ছ যেন মন ভোলানো আবদার করে বসল,
“আমার পাশে এসে একটু সময় বসো, প্লিজ।”
আবদারটি ফেলতে পারল না মোহ। আস্তে করে গিয়ে বসল স্বচ্ছের পাশে। অনেকটা ইতস্ততবোধ করে স্বচ্ছ নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আই এম সরি।”
চক্ষুদ্বয় বড়ো বড়ো করে বেশ সময় নিয়ে তাকিয়ে রইল মোহ। বিস্ময় কাটিয়ে জানতে চায়,
“হঠাৎ সরি কেন?”
“আমার বাবা তোমার বাবার সাথে যা করেছে তার জন্য। আমি লজ্জিত তোমার কাছে। তুমি হয়ত ভেবেছ আমি তোমার কথা বিশ্বাস করিনি। কিন্তু আমি তোমায় বিশ্বাস করেছি। বাবা যা করেছে তার জন্য তোমায় কী করে মুখ দেখাব বুঝতে পারছিলাম না। আমি তোমার বাবাকে ছাড়িয়ে আনতে গিয়েছিলাম। কিন্তু গিয়ে দেখি ততক্ষণে শৌভিক মীর তোমার বাবাকে ছাড়িয়ে নিয়ে চলে গিয়েছে।”
মোহ নীরব থাকে। উচ্চারিত করে না একটি শব্দও। যার কারণে মনের মাঝের অস্থিরতা ধাপে ধাপে বেড়ে ওঠে স্বচ্ছের। বেশ উৎকন্ঠিত হয়ে বলে,
“তুমি আমাকে বিশ্বাস করছ? নাকি বিশ্বাস করতে পারছ না?”
“করছি বিশ্বাস। আপনার চোখে ছোটাছুটি করা প্রতিটা অনুভূতি লক্ষ্য করছিলাম আমি। চোখ কখনো মিথ্যে বলে না।”
“তাহলে আমাকে বিশ্বাস করলে? আমার সরি এক্সেপ্ট করলে?”
মোহ মৃদু হেসে মাথা দুলায়। স্বচ্ছ সঙ্গে সঙ্গে হাফ ছেড়ে উপরদিকে তাকিয়ে বলে,
“যাক জীবনে প্রথম কাউকে সরি বলে সফল হতে পেরেছি।”
মোহের হাসি প্রগাঢ় হয়ে এবার। তার মনে হয় মানুষটাকে সে যতটা বিরক্তিকর মনে করেছিল সে ততটাও বিরক্তিকর নয়। বরং তার মাঝে কিছু মুগ্ধতাও রয়েছে।
চলবে…
[বি.দ্র. আসুন প্রথমেই দেরি করে দেওয়ার কারণ বলে ফেলি। আমি এইচএসসি ব্যাচ ২০২৩। এইত সামনে পরীক্ষা। রোজা শেষে টেস্ট এক্সাম। সাইন্সের স্টুডেন্ট। রোজা থেকে কতটা ছোটাছুটি। শরীর খারাপ, সবসময় হঠকারিতা। অবিশ্রামে থাকা মস্তিষ্ক কখনোই গল্প লিখতে পারে না। গল্পের একেকটা শব্দ লিখতে সুস্থ মস্তিষ্কের প্রয়োজন হয়। যারা পাঠক আছে তারা আরামে ২ মিনিটে পড়ে অভিযোগ তুলতেই পারে। কিন্তু লিখতে মন মানসিকতা প্রবল থাকতে হয়। আপনাদের এত কথা শুনি ইচ্ছে করে নয়। তবে হ্যাঁ এবার থেকে আশা করি এক দিন পর পর গল্প দিতে পারব। চাপ অনেকটা কমে গেছে। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]